পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল পর্ব (৩য় ও শেষ অংশ)


চৌদ্দ ডিঙ্গা আর মনপবনের নাও ‘মধুকর’ নিয়ে লঙ্কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন চাঁদ সওদাগর। যাত্রাপথে সাগরের এক কূলে দেখা গেল হরগৌরীর বাসর। সাধারণ মাঝিমাল্লার কাছে হরগৌরী ততটা আরাধ্য নয় যে নৌবহর থামিয়ে পূজা নিবেদন করতে হবে। কিন্তু শিব-ভক্ত চাঁদের কাছে সে মন্দির পরমাশ্রয়। তাই ডিঙ্গা ভিড়িয়ে চাঁদ সেখানে পূজা দিলেন। আবার আরেকদিন দেখা দিল মনসার জাগ্রত মন্দির। জলেজংগলে বাসকারী শুদ্রজাত মাঝিদের কাছে ‘মনসা দেবী’ ভক্তির নাম। চাঁদ সেখানেও ডিঙ্গা ভেড়ালেন, কিন্তু পূজার জন্য নয় ; বরং সে মন্দির ভেঙ্গে দিয়ে এলেন। মাঝিমাল্লারা ব্যাপারটাকে ভালভাবে নিল না। কিন্তু চাঁদ নির্বিকার! এভাবে কূলহীন সাগরে ভাসতে ভাসতে ডিঙ্গি ভিড়ল একদিন সিংহল কূলে। লঙ্কারাজ চন্দ্রকেতু চাঁদ বণিকের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে রাজকোষের অর্ধেক ধনরত্ন তাঁকে উপহার দিয়ে দিলেন। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চাঁদ বণিক আবার সাগরে ভাসলেন। এভাবে একদিন পৌঁছে গেলেন লঙ্কাপুরীতে।

রাক্ষসরাজ্য লঙ্কাপুরীতে সাড়া পড়ে গেল। অশান্ত সাগরপথের বাধা পেরিয়ে সহজে কোন নাবিক বা সওদাগর সেখানে যায় না। বিভিন্ন রত্নপণ্যসম্ভারে বোঝাই চাঁদ সওদাগরের জাহাজ পেয়ে সবাই খুশি। এদিকে রাক্ষসরাজ বিভীষণকে মনসা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন,”সাবধান রাজা! এ সওদাগর বাণিজ্যের জন্য আসেনি ; এসেছে বিষাক্ত খাদ্য নিয়ে তোমার প্রাণ হরণ করতে।“ রেগে গিয়ে বিভীষণ চাঁদকে কারারুদ্ধ করলেন। কারাগারে বসে দিনরাত চোখের পানি ফেলেন আর দুর্গাকে ডাকেন চাঁদ। শেষে দুর্গা সদয় হয়ে স্বপ্নে দেখা দিলেন রাজা বিভীষণকে,”এ কী করেছ তুমি রাজন? আমার ভক্ত এক পরম সাধুকে তুমি মিথ্যা ভয়ে কারাগারে আটকে রেখেছ! তাকে মুক্তি না দিলে এ অপরাধে তুমি সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে।“ বিভীষণ ঘুম ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি চাঁদকে মুক্তি দিলেন এবং বারবার ক্ষমা চেয়ে তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করলেন। বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বিপুল মণিমানিক্য সোনাদানা দিয়ে বিদায় দিলেন চাঁদকে।

বিশাল লাভের বাণিজ্য শেষে দেশে ফিরছেন এবার চাঁদ সওদাগর। একাই ফিরছেন না তিনি, সাথে সাথে ফিরছে মনসার ক্রোধ। সাগরের প্রতিটা ঢেউয়ের ফেনা যেন উদ্যত নাগের ফণা! মনসা পবনদেবকে নির্দেশ দিলেন প্রচণ্ড ঝড় তুলতে। সে ঝড়ে সমস্ত লোকলস্কর ধনরত্নসহ সকল ডিঙ্গা ডুবে গেল। বহু কষ্টে উলঙ্গ অবস্থায় ভাসতে ভাসতে চাঁদ বণিক এক দ্বীপে গিয়ে উঠলেন। সেখানে ভাগ্যক্রমে পাওয়া এক বন্ধুর সাহায্যে ফিরে এলেন নিঃস্ব অবস্থায় চম্পকনগরে। চোখের সামনে বিপুল ক্ষতির শোক বুকে নিয়ে গৃহে ফিরে নবজাত পুত্রকে দেখলেন চাঁদ। লখিন্দরের রূপ যেন নিমেষে সব শোক ভুলিয়ে দিলে তাঁকে।

এভাবে দিন যায়, সময় গড়ায়। লখিন্দর বড় হয়। এখন সে বিবাহের যোগ্য এক রূপবান যুবক। ঘটক ছুটল দেশে বিদেশে। অবশেষে উজানীনগরের রাজা মুক্তেশ্বরের কন্যা পরমা সুন্দরী বেহুলার সাথে বিবাহ স্থির হল। সবাই যখন ঘটককে বাহবা দিচ্ছে, ভাবছে অনেক খোঁজখবরের সম্বন্ধ এই বিবাহ, অলক্ষ্যে তখন নিয়তি হাসছেন। কারণ এই ঘটনা ঘটানোর জন্যই প্রায় ষোল বছর আগে মনসা গিয়েছিলেন ইন্দ্রের নাচসভায়।

জ্যোতিষীগণ অনেক হিসেবনিকেশ কষে বিবাহের ক্ষণ নির্ধারণ করলেন। বাসর ঘরে সর্প দংশনের পূর্বগণনা মাথায় রেখে চাঁদ বণিক ডাকলেন নামকরা কামার বিনোদকে। বললেন এমন এক লোহার বাসর ঘর বানাতে হবে যেখানে একটা পিঁপড়া ঢুকারও জায়গা না থাকে।

চাঁদ সওদাগর ঘরটির চারদিকে পাহারার ব্যবস্থা করলেন। নিজেও হেমতালের লাঠি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু কালীনাগ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই ঢুকে পড়ল আর সতী বেহুলার নিদ্রার সুযোগে লখিন্দরের পায়ে কামড় বসাল। বিষের জ্বালায় জেগে উঠলেন লখিন্দর।

তেমনটাই বানিয়ে দিল বিনোদ কামার। মনসা দেখলেন এতো মহা সমস্যা! তাঁর প্রতিজ্ঞা বিফলে যেতে বসেছে! তাই রাতে মনসা বিনোদ কামারকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে ভয় দেখালেন নির্বংশ করার। চাঁদ বণিকের হাতের চেয়ে অনেক লম্বা মনসার হাত। তাই ভয় পেয়ে মনসার কথামত বিনোদ সেই ঘরে সূচের মত সূক্ষ্ম এক ছিদ্র করে দিল। বিবাহের সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবার পর দম্পতিকে ঢুকিয়ে দেয়া হল সে বাসর ঘরে। চাঁদ সওদাগর ঘরটির চারদিকে পাহারার ব্যবস্থা করলেন। নিজেও হেমতালের লাঠি নিয়ে ঘুরতে লাগলেন। কিন্তু কালীনাগ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই ঢুকে পড়ল আর সতী বেহুলার নিদ্রার সুযোগে লখিন্দরের পায়ে কামড় বসাল। বিষের জ্বালায় জেগে উঠলেন লখিন্দর। দেখলেন কালীনাগ পালাচ্ছে। তিনি তক্ষুণি তার লেজটি কেটে নিলেন। বেহুলা তখন মনসার মায়ায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার ঘুমের মাঝেই মৃত্যু ঘটল লখিন্দরের। মৃত্যুর আগে নিজের রক্ত দিয়ে পত্রে লিখে গেলেন - বেহুলা যেন তাঁর মৃতদেহটি নিয়ে দেবপুরে যান। বেহুলা জেগে উঠে স্বামীর মৃতদেহ, পত্রখানা আর কালীনাগের কাটা লেজটা পেলেন। বুক চাপড়ে শাপ দিলেন তিনি কালীনাগকে। তখন থেকে কালনাগিনীর নাগ হয় না, সে কখনো স্বামীর সোহাগ পায় না।

চম্পকনগরে নামল শোকের রোল। পুত্রহীন নিথর শোকাতুর চাঁদ সওদাগর ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন সৎকারের। কিন্তু বেহুলা বেঁকে বসলেন। তিনি স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যাবেন দেবপুরে তাঁর স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে। অকাল বৈধব্যের শোক আর সতীত্বের শক্তিই তার সাহস। অবশেষে সাধারণ বেশে বেহুলা তাঁর স্বামীর দেহ নিয়ে উঠলেন এক বিরাট ভেলায়। বহু বাধাবিঘ্ন, ভয় জয় করে সে ভেলা এসে পৌঁছল দেবপুরে। এ যাত্রায় বেহুলাকে সাহায্য করলেন আর কেউ নন, মনসার পরামর্শদাতা নেতা।

নেতার সাহায্যেই স্বর্গলোকে দেবতাদের নাচের আসরে নৃত্যের সুযোগ পেলেন বেহুলা। নাচের সভায় দেখা গেল সবাই এসেছেন, আসেননি শুধু মনসা দেবী। তাঁর শরীর অসুস্থ তাই। কিন্তু নতুন নর্তকীর নাচ বোন দেখবে না, তাই কি হয় ? গণেশ গেলেন বোনকে ডাকতে। ফলে সভায় আসতে বাধ্য হলেন মনসা।

বেহুলার নাচে মুগ্ধ হয়ে দেবতারা তাঁকে বর দিতে চাইলে তিনি চাইলেন তাঁর স্বামীর জীবন। তখন মনসার কুকীর্তির কথা প্রকাশ হয়ে গেল। প্রথমে মনসা তা অস্বীকার করলেও বেহুলা যখন আঁচল থেকে কালীনাগের কাটা লেজটা বের করে দেখালেন, সবাই বুঝে ফেললেন সত্যটা।

এরপর বেহুলা মনসার কাছে মিনতি করে বললেন,” মা, তুমি আমার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দাও, আমি চম্পকনগরে তোমার পূজা প্রতিষ্ঠা করে দিব।“ মনসাও তো তাই চান। এরজন্যই তো এত কিছু। তখন তাঁর আদেশে যমরাজ লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। একইসাথে সে সভায় বেহুলা-লখিন্দরের আসল পরিচয় প্রকাশ পেল। অনিরুদ্ধ ও ঊষার ষোল বছরের মর্ত্যবাসের মেয়াদও তখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

মনসা চাঁদ সওদাগরের ছয় পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিলেন, ফিরিয়ে দিলেন ধনরত্ন লোকলস্কর বোঝাই চৌদ্দটি ডিঙ্গাও। সুস্থ জীবিত স্বামীকে নিয়ে চম্পকনগরে ফিরে আসলেন বেহুলা। আর চাঁদ সদাগরেরও মনে পরিবর্তন এল। তিনি মহাধুমধামে মনসা পূজা করলেন। পুরো চম্পকনগরে মনসার পূজা শুরু হল। চাঁদ তাঁর সিংহাসনে লখিন্দরকে বসিয়ে দিয়ে দেবার্চনায় মন দিলেন। কিন্তু ওদিকে ঘনিয়ে এসেছে বিদায়ের ঘন্টা। বেহুলা-লখিন্দরের বিদায়। তবে এবারের বিদায়ের আবহে শোকের চাইতেও যেন বেশি বিজয়ের ছটা। প্রেম আর সতীত্বের বিজয়।

ষোড়শ বৎসর পরে অনিরুদ্ধ ঊষা, 
বলে আজি এতদিনে পূর্ণ হৈল আশা।।
মনের আনন্দে দোঁহে নৃত্য আরম্ভিল, 
অতি চমৎকার নৃত্য করিতে লাগিল।

এভাবেই হাসি-আনন্দ সুখে-দুঃখে ভরা “পদ্মা পুরাণ” শেষ হয়।

মানব মন বড়ই বিচিত্র, পাঠকের মনতো আরো বেশি। যেখানে “পদ্মাপুরাণ” পাঠ শেষে প্রেমভালবাসার ঘন রসায়নে প্রেমিক-মন আর ভক্ত-হৃদয় সিক্ত হয়ে ওঠে, তখন বেরসিক পাঠকের মনে আরেক ধরণের দুষ্টু প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করে - দেবাদিদেব শিব সহ হিন্দুপুরাণের দেবতা-মুনি-ঋষিরা এত কামজর্জর কেন? কেন ভারতীয় পুরাণের এখানে সেখানে এত ঘন ঘন রেতঃপাত? কিভাবে লিঙ্গের মত একান্ত গোপন লজ্জাশীল একটা অঙ্গ প্রকাশ্য পূজার বস্তু হয়? শুধু ভারতীয় পুরাণেই কি লিঙ্গপূজা আছে, নাকি আরো কোন পুরাণেও এর অস্তিত্ব আছে?

উত্তর আছে বটে। তাছাড়া ভারতীয় পুরাণ বুঝতে চাইলে এগুলোর একটা ধারণা রাখাও দরকার।

আসুন পুরাণগুলোর পাতা আবার একটু উল্টাই। তবে এবার আর শুধু ভারতীয় পুরাণে সীমাবদ্ধ না থেকে একটু ঘুরে আসি আরো কিছু পুরাণ থেকে - মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, ফিনিসীয়, গ্রিক, রোমান তথা প্যাগান ধর্মীয় পুরাণ থেকে কেতাবি, এমনকি অতি সাম্প্রতিক ঝড় তোলা ড্যান ব্রাউন পর্যন্ত। জেনে আসি বিভিন্ন পুরাণে এবং ধর্ম বিশ্বাসে লিঙ্গপূজা বা যৌনপূজার ইতিবৃত্ত।

কথা দিচ্ছি - প্রশ্নগুলোর উত্তরেও আখ্যান-উপাখ্যান-তথ্য-কাহিনি আছে অনেক। শেষ পর্যন্ত এর কিছু কিছু কপালে ভাঁজ ফেলার মত, হয়ত বিশ্বাসকে ধাক্কা দেয়ার মতও।

তবে তা চিন্তা ও হজমের জন্য আপনাকেও হতে হবে প্রাপ্তমনস্ক।
কি, হতে পারবেন তো ?


প্রাসঙ্গিক লেখা