সাকিব আল হাসান: কাঁধে যার ১৬ কোটি মানুষের ভার
এক দশকেরও বেশি সময় আগের কথা। বাংলাদেশ দল সফর করছে জিম্বাবুয়ে। সিরিজের পঞ্চম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দলে দেখা গেলো দুই নতুন মুখ। একজন মুশফিকুর রহিম। এক বছর আগেই যার টেস্ট অভিষেক হয়েছে লর্ডসে। আরেকজন সাকিব আল হাসান। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে ব্যাটে-বলে চমকজাগানিয়া পারফর্ম করে দলে জায়গা পেয়েছিলেন যিনি। এই লেখাটা তাকে নিয়েই।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে লিকলিকে গড়নের যে ছেলেটা প্রথমবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন, আজ তিনিই শক্ত কাঁধে বইছেন ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার ভার। যে ভার তাকে দমিয়ে দেয়নি এতোটুকু, বরং দিনে দিনে তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন বিশ্ব ক্রিকেটেরই এক অমূল্য সম্পদ। প্রত্যাশার ভার বহন করা যার কাছে ব্যাট হাতে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে একটার পর একটা বল মাঠের বাইরে আঁছড়ে ফেলার মতোই সহজ। কিংবা যার কাছে প্রত্যাশা পূরণ করাটা দুর্দান্ত একেকটা আর্ম বলে ব্যাটসম্যানের স্টাম্প উপড়ে ফেলার মতোই স্বাভাবিক।
ক্রিকেটের সব কঠিন কাজ সহজ ও স্বাভাবিকভাবে করতে পারা সাকিব এখন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বের ভারও এখন তার কাঁধে। ক্রিকেটার সাকিব নেতা হিসেবেও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন কিনা, তা বলে দিবে সময়ই। আপাতত দেখা নেয়া যাক সাকিবের উত্থানের গল্পটা।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে সাকিব বল হাতে ১০ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে নিয়েছিলেন এক উইকেট। ব্যাট হাতে ৪৯ বলে করেছিলেন ৩০ রান। মাঠ ছেড়েছিলেন দলকে জিতিয়ে। ওই সময়ে যে কজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার জয়ের স্বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, সাকিব তাদের একজন এবং যে জয়ে ছিলো তারও গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
সাকিব এরই মধ্যে ১৮০টি ওয়ানডে, ৫১টি টেস্ট এবং ৬১টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে করেছেন নয় হাজারের বেশি রান। যা তামিম ইকবালের পর দেশের হয়ে সর্বোচ্চ। নিয়েছেন সাড়ে চারশর বেশি উইকেট। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। পারফর্ম্যান্স বিবেচনায় তিনিই তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার। পরিসংখ্যানের পাতা না উল্টিয়েই এ কথা বলে দেয়া যায়।
বিশ্বের আর কোনো ক্রিকেটার নিজ দেশের হয়ে একই সঙ্গে তিন ফরম্যাটের সেরা হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য কিছু করতে পারেননি। সাকিব পেরেছেন। একজন ক্রিকেটার যে এমনও একটা কীর্তি গড়তে পারেন, তার নজির সাকিবই প্রথম দেখিয়েছেন।
এ তো গেলো একটি অবিশ্বাস্য কীর্তির কথা। সাকিবের এমন আরো একটি কীর্তি আছে, যাকে কেবল ‘অবিশ্বাস্য’ বিশেষণে প্রকাশ করা যায় না।
বছরের পর বছর সাকিব অবস্থান করেছেন তিন ফরম্যাটের সেরা অলরাউন্ডারদের শীর্ষস্থানে। সময়ে সময়ে অবশ্য তিনটির কোনোটি থেকে সাকিব নেচে নেমে গেছেন, তবে শীর্ষস্থানে ফিরতে তার খুব একটা সময়ও লাগেনি। এভাবে তিন ফরম্যাটের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার কীর্তি আর কারো নেই।
একজন ক্রিকেটার যে তিন ফরম্যাটেরই সেরা অলরাউন্ডার হতে পারেন— সেটা তো আসলেই সাকিবই প্রমাণ করেছেন। সাকিব এটা না করলে, পৃথিবী হয়তো জানতোই না যে এমন কিছুও একজন ক্রিকেটার করতে পারেন! ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি সময় তিন ফরম্যাটের সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। বছর শেষে ‘রানওয়ে লিডার’ স্বীকৃতি দিয়ে আইসিসিও এ জন্য সম্মানিত করেছে তাকে।
সাকিবের অবিশ্বাস্য অলরাউন্ড পারফর্ম্যান্সগুলোর মধ্যে একটা হলো একই টেস্টে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে এমন কীর্তি ছিলো মাত্র দুজনের— ইয়ান বোথাম ও ইমরান খানের। তাদের পাশে নাম লেখিয়েছেন সাকিবও। ২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে এই কীর্তি গড়েন তিনি।
সাকিব সম্প্রতি ওয়ানডেতে পাঁচ হাজার রান এবং ২০০ উইকেট নেয়া ‘প্রিমিয়াম’ অলরাউন্ডারদের তালিকায়ও নাম উঠিয়েছেন। তার আগে এই কীর্তি গড়েছেন মাত্র চারজন অলরাউন্ডার। যেখানে আছেন জ্যাক ক্যালিস ও আব্দুল রাজ্জাকরাও। গর্বের ব্যাপার হলো আগের চারজনের তুলনায় অনেক কম সময়ে ওয়ানডেতে পাঁচ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন সাকিব।
এতো গেলো মাঠের সাকিবের কথা। মাঠের বাইরের সাকিবও দুর্দান্ত। তার পেশাদারিত্ব, মিডিয়া সামলানোর দক্ষতাও অন্য ক্রিকেটারদের কাছে আদর্শ।
সেরারা সব সময়ই সমালোচকদের তীর্যক কথার লক্ষ্য হন। সাকিবের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সময়ে-অসময়ে তার বিপক্ষে তৈরি হয়েছে নানা সমালোচনা। এর কোনোটাতে সাকিবের কোনো দায় ছিলো না। কোনোটাতে আবার তার কারণেই তৈরি হয়েছে সমালোচনার তেতো সব কথা।
কিন্তু সাকিব কখনো বিচলিত হননি। বরং ব্যক্তিত্বের সম্মোহন এবং মাঠের পারফর্ম্যান্সে প্রতিবারই দিয়েছেন দাঁতভাঙা জবাব। প্রতিবারই সাকিব ঘুরে দাঁড়িয়েছেন প্রবল বিক্রমে। যা বন্ধ করে দিয়েছে সমালোচকদের মুখ। কখনো কখনো মাঠ ও মাঠের বাইরের সাকিব সমালোচকদের ডুবিয়ে দিয়েছেন অপার মুগ্ধতায়, যা সমালোচকদের পরিণত করেছে তার একনিষ্ঠ ভক্তে!
বছরের পর বছর ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত সব পারফর্ম্যান্স উপহার দিয়ে পুরো দেশ মাতিয়ে রেখেছেন সাকিব। এই মাতামাতির মধ্যে একটা ব্যাপার সেভাবে মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়নি। তা হলো— বাংলাদেশ ক্রিকেট সাকিবের বিকল্প কাউকে এখনো প্রস্তুত করতে পারেনি। ৩০ বছর বয়সী সাকিব আরো কয়েক বছর জাতীয় দলে থাকবেন নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু তার পরে কে ধরবেন হাল, এ নিয়ে এরই মধ্যে দুশ্চিন্তার চোরাস্রোত বইছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে।
ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের আশা, ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যাওয়ার অনন্য যে নজির সাকিব গড়ে যাচ্ছেন, তা নিশ্চয় বছরের পর বছর ধরে অনুপ্রাণিত করবে বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাকিব দেখাবেন সফলতার পথ। তাকে স্বপ্নের সীমানা বানিয়ে দৌড়াবে অনেকেই। এভাবে নিশ্চয় একদিন সাকিবের ভবিষ্যত-শূন্যতাও দূর করে দিবেন নতুন কোনো সাকিব।