বিভিন্ন পুরাণে যৌনতা - ১/১৪


প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁদের অধিকাংশের মতে খ্রিষ্টের জন্মের হাজার বছরেরও আগে থেকে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল। ঐ প্রাচীন সময় থেকেই এ সংস্কৃতিতে মানুষের জীবনের মূল চারটি লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে দেয়া হয় – ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। আর এ চারটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনের চারটি অবস্থানও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস।

ব্রহ্মচর্য আশ্রমে গুরুর আশ্রয়ে থেকে ধর্ম ও চরিত্র গঠনের ছাত্রজীবন অধ্যায় শেষ করার পরপরই একজনকে গার্হস্থ্য বা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে হোত। অর্থাৎ, যৌবনে কাম-শিক্ষালাভ ছিল বাধ্যতামূলক। কাম বলতে আমরা যদিও আজ যৌনতাকেই বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু তখন কাম ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এমনকি ধর্মের ব্যাখ্যাতেও।

মূলত কামই সৃষ্টি, আর সৃষ্টির জন্যই কাম প্রয়োজন। মৎস্যপুরাণে আছে, ব্রহ্মা যখন বেদাভ্যাসে রত ছিলেন, তখন তাঁর দশজন মানস পুত্র জন্মায়। মানসপুত্র বলেই এরা সবাই অযোনিজ এবং মাতৃহীন। ফলে কামের উদ্ভব তখনো ঘটেনি। এর পরপরই ব্রহ্মা তাঁর বুক থেকে ধর্ম, হৃদয় থেকে কাম এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে ক্রোধ-লোভ-মোহ-অহংকার ইত্যাদি সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ, ব্রহ্মা থেকেই কামের উদ্ভব। ব্রহ্মাসম্ভূত বলে হোক, বা জীবনের প্রয়োজনে হোক, কামকে ভারতীয় পুরাণ এমন এক স্তরে নিয়ে গেছে যেখানে ধর্ম আর কামের সম্মিলন অতি সাধারণ ব্যাপার।

পুরাণ মতে, নরনারীদের জীবনের নিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্ত নিয়মনীতি, বিধান রচনা করেন মনু। এঁকে ভারতীয় আইন শাস্ত্রের জনক বলা হয়। এরপর বৃহস্পতি রচনা করেন অর্থশাস্ত্র। মহাদেবের অনুচর নন্দী হরপার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র। মহর্ষি উদ্দালিকের পুত্র শ্বেতকেতু তা থেকে এক গ্রন্থ রচনা করেন। বাভ্রব্য নামে একজন উত্তর ভারতীয় ঋষি তাকে সাত ভাগে ১৫০টি পরিচ্ছেদে বিশ্লেষণ করেন। ভাগগুলো এরকম – ১) সাধারণ কথা, ২) নরনারীর যৌনমিলন ও তৃপ্তি, ৩) যুবতী নারীদের কাম জাগরণ, ৪) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দৈহিক আনন্দ, ৫) পরস্ত্রীর সাথে সম্বন্ধ ও পরস্ত্রীর সাথে কাম, ৬) বারাঙ্গনার কাম বৃত্তান্ত, ৭) শারীরিক সৌন্দর্য ও কামশক্তি বৃদ্ধির উপায়।

ঋষি বাভ্রব্যের গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের আরো কিছু ঋষি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। যেমনঃ চারায়ন লেখেন – সাধারণ কাম বিচার, সুবর্ণাভ লেখেন – যৌন কাম বিচার, ঘোটকমুখ লেখেন – যুবতী নারীর বিচার, গোমর্দীয় লেখেন – স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার, গণিকাপুত্র লেখেন – পরস্ত্রীগমন বিচার, দত্তক লেখেন – পতিতাদের কাম বিচার, কুচুমার লেখেন – দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার।

এসব বিচ্ছিন্ন গ্রন্থগুলোকে একত্রিত করে আরো বিশদ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তত্ত্বগুলোকে সুন্দর ভাষায় স্পষ্ট করে আলোচনার জন্য বারাণসীর চতুষ্পাঠীর ছাত্র ঋষি মল্লিনাগ বাৎস্যায়ন রচনা করেন বিশ্ববিশ্রুত গ্রন্থ “কামসূত্রম”। সাতটি অংশ, ছত্রিশ অধ্যায়, ৬৪টি বিষয় ধারণ করে আছে ১২৫০টি অপূর্ব সুন্দর শ্লোক। নরনারীর যৌনানুভূতিতে অধিক আনন্দলাভের উপায় এবং সামাজিক বিধিবিধানের সমন্বয় করে এটা রচিত হয়। শুধুমাত্র অজ্ঞানতার কারণে সাধারণ লোকের কাছে “কামসূত্রম” এবং রাস্তায় পাওয়া পর্ণোবই একই রকম মনে হলেও আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী এবং যৌনবিদদের কাছে কামসূত্রের গুরুত্ব আলাদা।

যা হোক, ব্রহ্মা তাঁর হৃদয় থেকে সেই যে কাম চেনালেন, সে পথে হাঁটলেন দেবতাকূল-মুনিগণ-গান্ধর্ব-অপ্সরা-অসুর-মানব সবাই। কখনো এ কাম এসেছে প্রেম কিংবা লোলুপতার আবরণে, কখনো জোরপূর্বক ধর্ষণের পীড়নে, কখনো প্রয়োজনের স্বার্থে; কখনো আবার সে কামকে প্রশমিত করার জন্য দেবদেবীদেরই এগিয়ে আসতে হয়েছে।

ইন্দ্রের অহল্যা ধর্ষণতো আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এবার বলি রাবণ কর্তৃক রম্ভা ধর্ষণের কাহিনি। স্বর্গের নর্তকী রম্ভা কুবেরের পুত্র নবকুলের নিকট অভিসার-গমন কালে রাবণ তাকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়ে। দেবলোকের নিয়মানুসারে একজনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বরাদ্দ নারীতে অন্য কেউ উপগত হতে পারে না। কিন্তু এত নিয়ম মানার মত তো আর রাবণ নন। তিনি রম্ভাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। রম্ভা পরে নবকুলকে ঘটনা জানালে নবকুল রাবণকে এই বলে অভিশাপ দেন- যদি রাবণ কোন নারীর অনিচ্ছায় তার প্রতি বল প্রয়োগ করে ধর্ষণ করতে যায়, তবে রাবণের মাথা সাত খন্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। ( এই জন্যই সীতাকে অপহরণ করে নাগালে এনে রাখলেও রাবণ তাকে ভোগ করতে পারে নাই। অর্থাৎ, সীতার সতীত্ব রক্ষার কৃতিত্ব যতটুকু সীতার, তারচে’ বেশি শাপের। )

স্বয়ং কামের স্রষ্টা ব্রহ্মাও এক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে আছেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একবার পৃথিবী ভ্রমণ করতে করতে এসে উপস্থিত হলেন মহর্ষি শান্তনুর আশ্রমে। শান্তনু তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ব্রহ্মার সেবায় এগিয়ে এলেন শান্তনুর স্ত্রী অমোঘা। আশ্রমবাসিনী স্বল্প বস্ত্রপরিহিতা সুদেহী পরমাসুন্দরী অমোঘাকে দেখেই ব্রহ্মা কামপীড়িত হয়ে উঠলেন এবং তাঁর সঙ্গম প্রার্থনা করলেন। পতিপ্রাণা অমোঘা রুষ্ট হয়ে যেই না ব্রহ্মাকে অভিশাপ দিতে যাবেন, ব্রহ্মা তাঁর তেজবানবীর্য আশ্রমে ঢেলে দিয়ে চলে গেলেন। শান্তনু ফিরে এসে সব শুনে স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এ কী সুযোগ হারালেন অমোঘা, স্বয়ং ব্রহ্মার অঙ্কশায়িনী বলে কথা! তখন স্বামীর নির্দেশে অমোঘা সেই ফেলে আসা বীর্যের তেজ গ্রহণ করলেন এবং গর্ভবতী হন। যথাসময়ে ব্রহ্মার মত জলসহ এক পুত্র সন্তান হয় তাঁর। এ জলময় পুত্রকে এক কুন্ডের মধ্যে রাখলেন শান্তনু। ধীরে ধীরে সে জলের আকার বাড়তে থাকে এবং তা একসময় বিশাল নদের সৃষ্টি করে যার নাম ব্রহ্মপুত্র।

আবার শিব-দুর্গাপুত্র স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিকের তো আরেক কীর্তি। দেবতাদের ভয়ানক মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা তারকাসুরকে যখন যুদ্ধে দেবসেনাপতি কার্তিক পরাজিত ও নিহত করলেন, তখন দেবতারা খুশিতে কী করবেন কার্তিককে নিয়ে সে চিন্তায় পেরেশান। মাতা দুর্গাতো পুত্রকে ছাড়পত্র দিয়েই দিলেন এই বলে, ”পুত্র আমার, তুমি আমার ইচ্ছায় এবং শিবের কল্যাণে ত্রিভুবনে যা কিছু ভোগ্য, তা ভোগ কর।“

এখন দেবলোকের বাবুর্চির খাবার যতই উপাদেয় কিংবা ভোগ্য হোক, তাতে একঘেয়েমি আছে। একঘেয়েমি নাই যে খাবারে, বরং নিত্য নতুন বিচিত্র স্বাদ - কার্তিক তাই ভোগ করতে শুরু করলেন। কিছুদিন পর দেবতারা আর না পেরে দুর্গার কাছে অভিযোগ জানালেন যে দুর্গার দেয়া পারমিটের অপব্যবহার করে কার্তিক তাঁদের সকলের স্ত্রীদের নিয়মিত স্বাদ নিতে শুরু করেছেন। দেবকূলের লাইসেন্সের অসুবিধা হল এই যে চাইলেই তা ক্যান্সেল করা যায় না, ঈষৎ পরিমার্জন করা যায় মাত্র; তাও ফাঁকফোকর বুঝে।

দুর্গা এবার এক উপায় বাতলালেন - “যস্যাং তু রমতে স্কন্দঃ পার্বতী অপি তাদৃশী’ (যখনি কোন নারী রমণে যাইবেক স্কন্দ, পার্বতীই দেখিবেক)। তিনি কার্তিকের মনে নিজের ছাপ স্থায়ী করে দিলেন। একদিন ইন্দ্র আর বরুণের স্ত্রীদের কার্তিক গেছেন ভোগ করতে। এর আগেও এদের ভোগের সময় সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবার যখনি তাঁদের দিকে এগোচ্ছেন, তাঁদের চেহারার জায়গায় মাতা দুর্গার চেহারা ভেসে উঠছে। শুধু এদুজনেই নয়, অপ্সরা-নর্তকী-পতিতা যার দিকেই তিনি হাত বাড়ান, সেখানেই এসে যায় মায়ের মুখ! ব্যস, কার্তিকের নারীলিপ্সা চিরতরে ঘুচে গেল। এরপরে আর কখনোই কার্তিক কোন নারীসঙ্গ করেননি, করতে পারেননি।

( প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখনকার বহুলচর্চিত সংলাপ-“শয়তান, তোর ঘরে মা-বোন নাই?” – এর সাথে সুপ্রাচীন ঐ কাহিনির কোন যোগসূত্র নাই। )

উপনিষদের যুগে তো সামাজিক ব্যবস্থাই এমন ছিল যে, মুনিঋষিরা ‘চাহিবামাত্র’ অন্যের নারীকে জোর করে নিয়ে যেতে পারত। মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু একদিন দেখেন তাঁর মাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্রাহ্মণ, অথচ উদ্দালক কিছুই বলছেন না। শ্বেতকেতু পিতাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন এটাই নিয়ম - “হে পুত্র, ক্রুদ্ধ হয়ো না। এই সনাতন ধর্ম, গাভিদের ন্যার স্ত্রীরাও অরক্ষিতা।“ এমনকি পিতা এও জানালেন যে, শ্বেতকেতুর জন্মও একই ভাবে আরেক মুনির দ্বারা। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে শ্বেতকেতু বিধান দিলেন, “এখন হতে যে স্ত্রী স্বামী ছেড়ে অন্য পুরুষে আর যে স্বামী পতিব্রতা স্ত্রী ছেড়ে অন্য নারীতে সংসর্গ করবে, এবং পতি-আজ্ঞা পেয়েও যে নারী ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনে আপত্তি করবে – তারা সকলেই ভ্রুণ হত্যা পাপে পাপী হবে।“

উল্লেখ্য প্রথম দুটি বিধানে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক রক্ষা পেলেও শেষ বিধানে কিছু ছাড় রয়েই গেল। এই ছাড়পত্রের সুযোগেই পাণ্ডুর অনুরোধে তাঁর স্ত্রী কুন্তী তিন দেবতার সাথে ( সূর্যের কাছ থেকে কর্ণের জন্ম পাণ্ডু জানতেন না ) আর মাদ্রি অশ্বিনিকুমার ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে পাণ্ডবদের জন্ম দেন।

আবার, কুরুবংশীয় চেদিরাজ উপরিচরবসু মৃগয়াকালে নিজের সুন্দরী স্ত্রীর স্মরণে কামাতুর হয়ে পড়েন। তখন তিনি স্খলিত বীর্য এক শ্যেনপক্ষির সাহায্যে স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন। পথে আরেক শ্যেন পাখির আক্রমণে সে বীর্য যমুনার জলে পড়ে যায় এবং অদ্রিকা নামের এক মাছরুপী অপ্সরা সে জল পানে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সে বীর্যে অদ্রিকার জন্ম দেয়া এক পুত্র ও এক কন্যাকে এক জেলে তার গৃহে লালন পালন করে। সে কন্যা বড় হয়ে অতিশয় রূপসী তরুণী হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু তার গায়ে মাছের গন্ধ থাকায় নাম হয়- মৎস্যগন্ধা। খেয়া পারাপারকালে পরাশর মুনি তাকে দেখে কামাতুর হয়ে পড়েন। মুনি তপোবলে মৎস্যগন্ধার মাছের গন্ধ দূর করে তাকে সুগন্ধ দান করেন এবং তার নাম দেন সত্যবতী। পরে এক দ্বীপে নিয়ে গিয়ে তার সাথে সঙ্গম করেন। এ থেকে জন্ম নেন এক পুত্র। দ্বীপে জন্ম বলে নাম রাখা হয় দ্বৈপায়ন আর গায়ের রং কালো বলে তার সাথে যুক্ত হয় কৃষ্ণ। ইনিই সেই বিখ্যাত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। পুরাণ রচয়িতা এই বেদব্যাসের ঔরসে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিদুর জন্ম নেন।

এরকম যৌনতার উচ্চনাদে ভরপুর ভারতীয় পুরাণ। তবে এ জাতীয় কয়েকটি জেনেই কেউ যদি ভাবেন যে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছেন, তো জেনে রাখুন আপনাকে স্তম্ভিত করার জন্য আরও অনেক উপাদান আছে এতে। আজকের দিনে আমরা যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলে থাকি ‘মায়ের পেট থেকে শিখে আসা’ কিংবা ‘রক্তে মিশে থাকা’ ইত্যাদি কথাগুলো, হিন্দু পুরাণে এর সাথে মানানসই রীতিমত যৌন উদাহরণও আছে ; এখন যারা পর্ণোচলচ্চিত্রে বিভিন্ন ভঙ্গি দেখে ‘রুচি বিকৃতি’ বলে আখ্যা দিয়ে ফেলেন, জেনে রাখুন এর কিছুকিছু প্রাচীন ভারতীয় মুনিরাও প্রয়োগ করেছেন, তাও কামশাস্ত্রের বহু আগেই।

এমনকি এক যৌনবিকৃতির ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় এ ‘বঙ্গ’ভূমি ! 
কী, ভুরু কুঁচকে ফেললেন যে ?

নড়েচড়ে বসুন। বলছি .........


প্রাসঙ্গিক লেখা