পৃথিবীর প্রাচীন পেশা যদি হয় কৃষিকার্য, তবে প্রাচীন প্রবৃত্তি হল যৌনতা। আর এ যৌনতাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে দ্বিতীয় প্রাচীন পেশা পতিতাবৃত্তি। এ পতিতা বা গণিকাবৃত্তিকে কখনো সম্মানিত ও পবিত্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে প্রাচীন আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, রোমান, এমনকি বাইবেলীয় সমাজ ও ধর্মশাস্ত্র ; আবার কখনো সে স্বীকৃতি কেড়ে নিয়ে তাকে সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণিতে পরিণত করে দিয়েছে তৎপরবর্তী সমাজ ও ধর্মীয় ব্যবস্থা। অথচ মজার ব্যাপার হল পতিতাদের স্বীকৃতি ভাল বা মন্দ যে বা যারাই দিক, পতিতাবৃত্তিকে তারা যেমন কেউ রোধ করতে পারেনি, তেমনি তাদের অধিকাংশই নিজেরাও সে যাত্রাপথে বিরত ছিলনা।
বাঙালি সবসময় রক্ষণশীল সমাজের প্রতীক। তা সত্ত্বেও পতিতাবৃত্তির ইতিহাস এখানেও বেশ পুরাতন। এমনকি ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিকে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি ও উঠতি বাবুগিরি প্রথায় এটা মোটামুটি অভিজাত স্বভাব হিসেবেই দেখা হত। তবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনগুলো তৎকালীন যুবসম্প্রদায়কে এ প্রবৃত্তি থেকে বের করে আনার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার মানে এই নয় যে, সোনাগাছি বা এজাতীয় নামকরা পতিতালয়গুলো উঠে গিয়েছিল ; তবে সেখানে যাতায়াতকারী আর সমাজের চোখে প্রকাশ্য কিংবা সম্মানের চোখে ছিলনা - এটুকুই।
এই পতিতাদের নিয়ে অনেক গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে যেখানে লেখকের চোখে কেউ হয়েছে সর্বনাশী, কেউ অসহায়া, কেউ লোভী ইত্যাদি বিভিন্ন আলোকে আলোকিত। কিন্তু খোদ সে সমাজ থেকে উঠে আসা কেউ নিজের জীবন নিয়ে লিখেছে এমন লেখা খুব কম। সেরূপ সাহসী লেখনীর মধ্যে আজো সমাদৃত সেকালের বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী নটী বিনোদিনীর “আমার কথা” (১৩১৯), তিনকড়ি দাসীর “আমার জীবন” (১৯০০) আর আমাদের আজকের আলোচনার মানদা দেবীর “শিক্ষিতা পতিতার আত্ম-চরিত” (১৩৩৬)।
অন্য সবক্ষেত্রে পতিতারা যেখানে বিপথগামিতার দায়ভার কোন না কোন পুরুষের উপর ফেলে দেয়, এখানে লেখিকা মানদা দেবী স্বয়ং বারবার স্বীকার করেছেন তার পদস্খলনের পিছনে দায়ী কৈশোর থেকে যৌবনের শুরুতে নিজের শারীরিক চাহিদাকে – তাঁর ভাষায় “প্রবৃত্তির উত্তেজনা’!
আজ পর্যন্ত কমপক্ষে কুড়িটিরও বেশি সংস্করণে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রকাশিত “শিক্ষিতা পতিতার আত্ম-চরিত” তার প্রথম প্রকাশ থেকেই আলোচিত ও বিতর্কিত। কারণ, অন্য সবক্ষেত্রে পতিতারা যেখানে বিপথগামিতার দায়ভার কোন না কোন পুরুষের উপর ফেলে দেয়, এখানে লেখিকা মানদা দেবী স্বয়ং বারবার স্বীকার করেছেন তার পদস্খলনের পিছনে দায়ী কৈশোর থেকে যৌবনের শুরুতে নিজের শারীরিক চাহিদাকে – তাঁর ভাষায় “প্রবৃত্তির উত্তেজনা’! আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হল তিনি এর জন্য বারবার দোষ দিয়েছেন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা তথা সংস্কৃতিকে যেখানে গল্প, নাটক, থিয়েটার, উপন্যাস সবখানে প্রেমের ও নারীপুরুষের মিলনের জয়জয়কার। তার মতে উঠতি বয়সে ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে যখন কোন কিশোরী এসকল সাহিত্যকলায় মজে যায় আর মা-বাবার স্নেহের স্থলে যখন যুবক শিক্ষক বা তরুণ নিকটাত্মীয়দের সাথে চলাফেরা বেশি করে, তখন এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এমনটাই !
মানদা দেবী যদি এটুকুতেই থামতেন, তবে বিতর্ক বা আলোচনা হয়ত এতদূর না-ও উঠতে পারত। কিন্তু তিনি তার লেখা তথা জীবনীতে যখন টেনে এনেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী সহ অসহযোগ আন্দোলন ও ভারতছাড় আন্দোলনকে, উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, দীনবন্ধু মিত্র সহ সব নমস্য ব্যক্তিদের, পাশাপাশি এখানে ঢুকে গেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বেশকিছু অজানা অন্ধকার দিক ; তখন এ লেখা স্বদেশীদের বোমার চাইতেও বেশি বিস্ফোরন্মুখ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল যে রমেশদা’র ছোঁয়ায় মানদা দেবীর প্রবৃত্তি জেগে উঠেছিল, যাকে বিশ্বাস করে কলকাতার সে সময়ের নামকরা ধনাঢ্য উকিলের কন্যা মানদা একবস্ত্রে পালিয়েছিলেন, সেই রমেশদা’ যখন তাকে ছেড়ে চলে যায়, আর কোন অবলম্বন খোঁজ না করে বলা যায় স্বেচ্ছায় জীবিকা আর জৈবিক চাহিদা মেটাতে তিনি এ পেশা বেছে নেন। এ কথা স্বীকার করার মত সাহস তিনি দেখিয়েছেন। সবশেষে তিনি যখন তাঁর লেখায় রমেশদা’র স্বরূপ উন্মোচন করে দেন, সেই রমেশদা’ও তার উত্তরে “আত্মকথা” নামক এক বই প্রকাশ করেন যা প্রকারান্তরে মানদা দেবীর অস্তিত্ব, বাস্তবতা আর ঘটনার সত্যতাকেই প্রমাণ করে। এ যেন আধুনিককালের “ন হন্যতে” বনাম “লা নুই বেঙ্গলী”র আদি সংস্করণ।
বাংলাদেশের প্রকাশনা “শব্দশৈলী” এ বইটিকে প্রকাশ করেছে। ১৬০ টাকা মুদ্রিত দামের ক্ষীণকায়া বইটি পড়লে একটি অত্যন্ত উঁচুমানের সাহিত্য পাঠ হয়, তা নয়। কিন্তু তৎকাল ও বর্তমানকালের সমাজ-অব্যবস্থার মিলটুকু দেখা যায়, আমাদের তথাকথিত ভদ্রতার মুখোশটুকু চেনা যায় আর সে সময়কার ঐতিহাসিক আন্দোলনের কিছু স্থানে পতিতাদের দ্বারা সংঘটিত সুকীর্তি ও কুকীর্তিটুকু জানা যায়।
বিশেষ করে যখন এই শেষাংশটুকু আর কেউ কখনো আলোচনা করে না।