বিভিন্ন অঞ্চলের বিপদজনক প্রাণীসমূহ


পরিবেশের অন্যান্য অংশের চাইতে প্রাণীজগতের কাছ থেকে জীবন নাশের হুমকি তুলনামূলক ভাবে কম হলেও আপনি নিশ্চয়ই বাঘ, সিংহ, ভল্লুক বা বিশালাকার কোন প্রাণীর সামনে স্বেচ্ছায় পড়তে চাইবেন না। তবে শুধু হিংস্র প্রাণীই নয়, চারণভূমিতে বিচরণ করে বেড়ানো বিশালাকার প্রাণী কিংবা শিং এবং খুঁড় আছে এমন প্রাণীদেরকেও এড়িয়ে চলা উত্তম। প্রাণীদের বিচরণ ভূমিতে চলাফেরার সময় সাবধানতা অবলম্বল করা উচিৎ, এই সাবধানতার জন্যই হয়তো আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন সমূহ বিপদ। আপনার আশ্রয়স্থলের আশেপাশে খোলা জায়গায় উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলে রেখে শিকারি প্রাণীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন না। বনে প্রবেশের বা পানিতে নামার আগে অবশ্যই মনোযোগের সাথে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নেবেন।  

বড় প্রাণীর চাইতে আকারে ছোট প্রাণীরা আসলে বেশি বিপদজনক। ক্ষুদ্র আকৃতি নিয়ে টিকে থাকার জন্য প্রকৃতি অনেক ছোট প্রাণীকেই দিয়েছে বিষদাঁত এবং তীক্ষ্ণ হূলের মতো ভয়ানক অস্ত্র। প্রতিবছর বিশালাকার হিংস্র প্রাণীর আক্রমণে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বহু গুন বেশি মানুষ মারা যায় ক্ষুদ্রাকৃতির বিষাক্ত সাপের কামড়ে। এমনকি মৌমাছির হূলের আঘাতেও বড় প্রাণীর আক্রমণের চাইতে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। এই ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণীদের আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে কারণ নিজের অজান্তেই আপনি তাদের কাছাকাছি চলে যেতে পারেন কিংবা তারাই আপনার কাছে চলে আসতে পারে আপনার অগোচরে। অন্যদিকে যে অল্প সংখ্যক মানুষ হাঙ্গর, কুমির বা বাঘ-সিংহের আক্রমণের শিকার হয় তাদের বেশিরভাগ নিজ ভুলেই শিকারির কবলে গিয়ে পড়ে। 

আপনার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে সচেতন থেকে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই আপনি এই প্রাণীদের জগতে টিকে থাকতে পারবেন। অতিরিক্ত কৌতূহল এবং অসতর্কতা আপনার বিপদ ঢেকে আনতে পারে, এমনকি আপনার মৃত্যুও ঘটাতে পারে। 

পোকামাকড় এবং কীটপতঙ্গ

পোকামাকড়রা অর্থোপড (Arthropod) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। অর্থোপড শব্দটা এসেছে গ্রিক ‘আর্থরন পস’ (Arthron pous) থেকে যার অর্থ জোড়া এবং পা। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর এই পরিবারের সদস্যদের কঙ্কালটা থাকে দেহের বাইরে একটা শক্ত খোলসের আকারে, দেহ থাকে বিভাজিত এবং পা থাকে জোড়া লাগানো। মাকড়সা এবং বিছা জাতীয় প্রাণীরাও এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত পোকামাকড়ের ৬, মাকড়সার ৮ এবং শতপদী, বিছা, কেন্নোর অনেকগুলো করে পা থাকে। আকারে ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও এই প্রাণীগুলোই কামড়ানোর বা হূল ফোটানোর সময় হয়ে উঠে বিষাক্ত। 

এদের বিষ বেশ যন্ত্রণাদায়ক হলেও মৌমাছি, বোলতা এবং ভোমরার কামড়ে সাধারণত মানুষ মারা যায়না - যদিনা এই বিষে আক্রান্ত মানুষের এলার্জির সংক্রমণ হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মাকড়সার কামড়েও সচরাচর মানুষ মারা যায় না; এটেল পোকা জনিত রোগও মানব শরীরে ছড়ায় খুব ধীর গতিতে। তবে মৃত্যু হোক বা না হোক, এসকল প্রাণীর ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলাটাই সবচাইতে ভালো প্রতিরোধ। যে সকল পরিবেশে বিছা বা মাকড়সা থাকার সম্ভাবনা আছে সেখানে প্রতিদিন সকালে উঠেই জামাকাপড় এবং জুতো ভালোভাবে পরীক্ষা করুন, একইসাথে বিছানা এবং আশ্রয়কেন্দ্রের ভিতরটাও ভালোভাবে দেখে নিন। পাথর বা কাঁটা গাছের গুড়ি উল্টানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন। 

বৃশ্চিক / বিছা (Scorpion)

সাধারণত মরুভূমি, বনভূমি, ক্রান্তিয় বনাঞ্চল, প্রায় গ্রীষ্মমন্ডলিয় এবং উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে বিছার আধিপত্য দেখা যায়। এরা সাধারণত নিশাচর হয়ে থাকে। মরুভূমির বিছাদের সমুদ্রপৃষ্ঠের চাইতেও নিচু ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি ‘ডেথ ভ্যালি’ থেকে শুরু করে ৩৬০০ মিটার বা ১২ হাজার ফুট উঁচু আন্দিজ পর্বতমালার আতাকামা মরুভূমি (Atacama Desert) পর্যন্ত সবজায়গাতেই বিচরণ করতে দেখা যায়। বেশির ভাগ জায়গাতেই এদের বর্ণ ধূসর বা কালো হলেও মরুভূমিতে পরিবেশের সাথে মিশে যাবার সুবিধার্থে এরা হলুদ এবং হালকা সবুজ রঙেরও হয়ে থাকে। এদের গড় দৈর্ঘ্য আড়াই সেন্টিমিটার (১ ইঞ্চি) হলেও মধ্য আমেরিকা, নিউ গিনি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জঙ্গলে ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) দৈর্ঘ্যের দানব আকৃতির বিছাও দেখা যায়। বিছার কামড়ে সচরাচর তাৎক্ষনিক মৃত্যু না হলেও শিশু, বয়োবৃদ্ধ এবং অসুস্থ লোকদের ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিছার সামনের দিকে দুইটা সাঁড়াশি আকৃতির থাবার উপযোগী কাঁটাযুক্ত পা থাকে, অনেক জোড়াযুক্ত লেজের অগ্রভাগে থাকে তীক্ষ্ণ হুল। এই বিছার অনুকরণে প্রকৃতি নির্বিষ হুইপ স্করপিয়ন (whip scorpion or vinegaroons) তৈরি করেছে, যাদের লেজ দেখতে অনেকটা চাবুকের মতো। এদের লেজের অগ্রভাগে কোন হুল নেই এবং এরা মোটেও বিষাক্ত নয়।

মাকড়সা (Spider)

উত্তর আমেরিকার ব্রাউন রেকলুস (Brown Recluse) বা ফিডলব্যাক স্পাইডার (Fiddleback Spider) কে চেনা যায় তার পিঠের উপরের ভায়োলিন আকৃতির দাগ দেখে। রেকলুস (নিভৃতচারী) নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এই মাকড়সা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এর কামড় সাধারণত খুব একটা ভয়ঙ্কর না হলেও আক্রান্ত জায়গার খুব দ্রুত পচন ধরে এবং যথাযথ চিকিৎসা না করালে অঙ্গহানিও ঘটতে পারে। 

লেটরোডেকটাস (Latrodectus) বা উইডো স্পাইডার (widow spider) প্রজাতির মাকড়সা সারা পৃথিবীব্যাপী পাওয়া গেলেও এই প্রজাতির সবচেয়ে পরিচিত মাকড়সাটা হচ্ছে উত্তর আমেরিকার ব্ল্যাক উইডো (Black Widow)। পৃথিবীর উষ্ণতম জায়গাগুলোতে বসবাসকারী এই মাকড়সা আকৃতিতে ছোট হয়। গাড় রঙের বালি-ঘড়ি (মাথা বেশ চওড়া, কোমর একেবারে সরু, নিচের দিকটা আবার চওড়া) আকৃতির এই মাকড়সার পেটে এবং পিঠে সাদা, লাল কিংবা কমলা রঙের দাগ থাকতে পারে। ব্ল্যাক উইডোর কামড়ে শরীরে যে বিষ ছড়ায় সেটা খুব দ্রুত মানুষের স্নায়ুকে বিকল করে দিতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বৃহৎ আকৃতির ফানেল ওয়েবস (Funnel Webs) মাকড়সাগুলো বাদামী কিংবা ধূসর রঙের হয়ে থাকে। গাঁট্টাগোট্টা ছোট ছোট পায়ের এই মাকড়সা গুলো তাদের কোন (funnel) আকৃতির জাল বেয়ে খুব দ্রুত যে কোন দিকে ছুটতে পারে বলে তাদের এই অদ্ভুত নামকরণ। স্থানীয় লোকজন এই মাকড়সাকে মৃত্যুর মতো বিভীষিকা রূপে দেখে। রাতের বেলা এই মাকড়সা যখন শিকারের জন্য ছোটাছোটি করে তখন তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে এদের এড়িয়ে চলার। ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার মতো এই মাকড়সার কামড়েও স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, সেই সাথে আক্রান্ত স্থানে প্রচণ্ড ব্যথার পাশাপাশি শরীর ঘামতে থাকে, কাঁপতে থাকে এবং অস্বাভাবিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়ে। এই মাকড়সার কামড়ে প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভুগতে হয়। 

বিশাল আকৃতির লোমশ মাকড়সা গুলো পরিচিত টারান্টুলা (Tarantula) নামে। এই মাকড়সা পশু পাখির দোকানে বিক্রি হতেও দেখা যায়। ইউরোপে এই মাকড়সার মাত্র একটা প্রজাতি থাকলেও এদের বিস্তৃত বিচরণ আমেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে। দক্ষিণ আমেরিকার এই মাকড়সার কয়েকটা প্রজাতি খুব ভয়ঙ্কর রকমের বিষ প্রয়োগ করতে সক্ষম হলেও বাকিরা মোটেও বিষাক্ত নয়। এই মাকড়সা আকারে একটা থালার সমান পর্যন্ত বড় হতে পারে। পাখি, ইঁদুর, টিকটিকি ধরার জন্য এদের সবারই রয়েছে বিষদাঁত। এই দাঁতের কামড়ে প্রচণ্ড ব্যথা এবং রক্তপাতের পাশাপাশি সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। 

শতপদী এবং কেন্নো (Centipedes and Millipedes) 

কেরি বা কেরা নামেও পরিচিত শতপদী এবং কেন্নো সাধারণত নিরীহ এবং বেশ ছোট আকৃতির হয়ে থাকে; যদিও গ্রীষ্মমন্ডলিয় এবং মরুভূমির কিছু প্রজাতি প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়। খুব অল্প পরিমাণ শতপদীর কামড় বিষাক্ত। তবে শতপদীর ক্ষেত্রে কামড় নয়, ভয় হচ্ছে কামড়ের পরের সংক্রমণের। এদের তীক্ষ্ণ হুল চামড়া ফুটো করে খুব গভীর গর্ত করতে সক্ষম। শরীর বেয়ে উঠতে থাকলে তাদের হুল ফুটানোর হাত থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে যে দিকে তারা চলছে সেদিকেই ব্রাশ করে ফেলে দেয়া, ভুলেও তাদের চলার উলটো দিকে তাদের সরানোর চেষ্টা করা যাবেনা। 

মৌমাছি, বোলতা এবং ভ্রমর (Bees, Wasps and Hornets)

মৌমাছি, বোলতা এবং ভ্রমরের অসংখ্য প্রজাতি রয়েছে, একইসাথে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এদের আচরণ এবং স্বভাবেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। গাড় লোমযুক্ত স্থূল শরীর দেখে সাধারণত মৌমাছি চেনা যায়, অপরদিকে বোলতা, ভ্রমর এবং ইয়েলো জ্যাকেট (Yellow Jacket, উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী এক ধরণের বোলতা) দেখতে সরু আকৃতির এবং প্রায় লোমহীন। কিছু মৌমাছি - মূলত যারা মধু সংগ্রহ করে তারা সংঘবদ্ধ ভাবে একত্রে বসবাস করতে পছন্দ করে। এদের যেমন চাষ করা যায় তেমনি বন্য পরিবেশে পাহাড়ের গুহায় বা গাছের খোলের ভিতরেও এরা বসবাস করে। অন্যান্য মৌমাছির মধ্যে সূর্যমুখী মৌমাছি (carpenter bees) যদিও গাছের খোলে আলাদা বাসা করে থাকে কিন্তু মাঝে মাঝে এদের ভোমরার (bumblebees) মতো মাটিতেও বসবাস করতে দেখা যায়। মৌমাছির কাছ থেকে প্রধান বিপদ হচ্ছে তাদের পেটে অবস্থিত কাঁটার মতো হুলের দংশন। হুল ফুটানোর সময় মৌমাছি বিষ থলি সহ পুরো হুলটাই তার শরীর থেকে আলাদা করে শিকারের গায়ে বিদ্ধ করে এবং নিজে মৃত্যুবরণ করে। প্রাণঘাতী এই মৌমাছিগুলো ছাড়া বেশিরভাগ মৌমাছিকেই লালন পালন করা যায়। অন্যদিকে বোলতা, ভ্রমর এবং ইয়েলো জ্যাকেটের রয়েছে তীক্ষ্ণ হুল এবং তারা আক্রমণকারীকে বারবার হুল ফুঁটাতে সক্ষম। 

এদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এদের এড়িয়ে চলা। ফুল বা ফল সংগ্রহের আগে খেয়াল রাখতে হবে সেখানে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত কোন মৌমাছি আছে কিনা। একইভাবে মাছ বা ছোট আকৃতির পাখি পরিষ্কার করার সময় নিশ্চিত করতে হবে সেখানে মাংসাশী ইয়েলো জ্যাকেটের উপস্থিতি নেই। মৌমাছি, বোলতা এবং ভ্রমরের হুলের আঘাত এবং বিষে বিপদের সম্ভাবনা সাধারণত খুব নগণ্য এবং হুল ফুটানোর ব্যথা দুই তিন ঘণ্টার মধ্যেই কমে যায়। কিন্তু কারো যদি এই বিষে এলার্জি থেকে থাকে তাহলে তীব্র যন্ত্রণা, অচেতন হয়ে পড়া এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আপনার যদি মৌমাছির বিষে এলার্জি থাকে কিন্তু আপনার কাছে এন্টিহিস্টামিন (antihistamine) জাতীয় ঔষধ বা তার বিকল্প না থাকে তাহলে টিকে থাকার এই লড়াইয়ে আপনার সামনে ঘোরতর বিপদ।

এঁটেল পোকা (Ticks)

মূলত গ্রীষ্মপ্রধান এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এঁটেল পোকা খুঁজে পাওয়া যায়। এরা দেখতে গোলাকার, আকারে ছোট। এদের শরীর সাধারণত নরম হলেও কারো কারো শরীরে শক্ত আবরণ রয়েছে। টিকে থাকতে এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য এদের উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের গায়ে আশ্রয় নিতে হয়। পরজীবী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণকারীর গায়ের রক্ত চুষে এরা বেঁচে থাকে, এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল এদের কারণে লাইম ডিজিজ (Lyme Disease), রকি মাউন্টেন স্পটেট ফিভার (Rocky Mountain Spotted Fever), মস্তিষ্ক-প্রদাহের (encephalitis) মতো রোগ ছড়ায় যেগুলার কারণে পক্ষাঘাত বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একবার রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে প্রতিকারের জন্য চিকিৎসকের সাহায্য ছাড়া আপনার নিজের খুব বেশি কিছু করার থাকবে না, তবে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে সময়। রোগ ছড়ানোর জন্য এঁটেল পোকাকে আপনার গায়ে লেগে থাকতে হবে কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা, কাজেই সারা শরীর পরীক্ষা করে এঁটেল পোকা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট সময় আপনি পাবেন। পশু পাখি পরিষ্কার করার সময়, ঘন গাছপালার ভিতর দিয়ে যাবার সময় কিংবা আশ্রয়ের জন্য প্রাকৃতিক উপাদান যোগাড়ের সময় সতর্ক থাকুন। সম্ভব হলে সব সময় পোকামাকড় প্রতিরোধক স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করুন। 

জোঁক (Leeches)

রক্তচোষা প্রাণী জোঁক মূলত গ্রীষ্মমন্ডলিয় এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করে। জঙ্গলাকীর্ণ, বদ্ধ বা পানির স্রোত খুব কম এমন জলাশয় পার হবার সময় প্রায় নিশ্চিত ভাবেই আপনি জোঁকের কবলে পড়বেন। ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে বনজঙ্গল; গ্রীষ্মমন্ডলিয় অরণ্য এবং জলাভূমিতে এদের সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। মিঠা পানির কচ্ছপ জাতীয় প্রাণীদের গায়েও এদের লেগে থাকতে দেখা যায়। শরীরে খুব সামান্য খোলা জায়গা থাকলেই জোঁক সেখানে জাঁকিয়ে বসতে পারে বলে তাদের বসবাসের অনুকূল এলাকায় কখনোই বিশ্রাম বা অবস্থান করা উচিৎ নয়। জুতো বেয়ে খুব সহজেই প্যান্টের নিচ দিয়ে শরীরে চলে আসতে পারে বলে জোঁক-প্রধান এলাকায় সবসময় প্যান্ট বা ট্রাউজার বুটজুতোর ভিতরে গুজে পড়া উচিৎ এবং নিয়মিত বিরতিতেই শরীরের উন্মুক্ত এবং সম্ভাব্য জায়গা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। জোঁক প্রবণ এলাকা থেকে সংগৃহীত পানি পান করার পূর্বে অবশ্যই ভালো ভাবে দেখে ফুটিয়ে কিংবা ফিল্টার করে পান করা উচিৎ। আকারে বেশ ছোট হয়ে থাকে বলে ভালোভাবে খেয়াল না করলে জোঁক চোখে পড়েনা, কাজেই অসাবধানতা বশত কোন ভাবে জোঁক যদি গিলে ফেলেন সেটা আপনার জন্য মহাবিপদ ঢেকে আনবে। গিলে ফেললেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়না জোঁক আপনার পরিপাকতন্ত্রে চলে যাবে, আপনার মুখগহ্বর থেকে পরিপাকতন্ত্র পর্যন্ত যে কোন জায়গায় সে তার চোষক দিয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারে এবং ভয়ঙ্কর রকমের সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

বাদুড় (Bats)

গল্প-কথায় বাদুড়কে যতটা ভয়ঙ্কর রূপে দেখানো হয় বাস্তবে বাদুড় আসলে ততটা ভয়ঙ্কর নয়। পৃথিবী জুড়ে বাদুড়ের রয়েছে অসংখ্য প্রজাতি এবং সত্যিকারের রক্তচোষা প্রজাতির বাদুড়ের উপস্থিতি রয়েছে শুধুমাত্র মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে। এরা আকারে খুব ছোট হয়, একেবারে নিঃশব্দে উড়ে এসে প্রাণীদের গায়ে- বিশেষ করে গরু এবং ঘোড়ার গায়ে বসে রক্ত চুষে নেয়। এদের লালায় একধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যেটা চামড়ার উপরিভাগকে অবশ করে ফেলে বলে চামড়ায় ছিদ্র করার সময় এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়না। একইসাথে এই লালা রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয়না বলে বাদুড় তার আহার শেষ করে চলে যাবার পরেও আক্রান্ত স্থান দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে, যে কারণে অনেক সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রানীর মৃত্যু ঘটে। সকল বাদুড়ই রেভিস (Rabies) জাতীয় রোগের জীবাণু বহন করে, এবং বাদুড়ের সাথে যে কোন ধরণের শারীরিক স্পর্শেই এই রোগ ছড়াতে পারে। বাদুড়ের কামড়ে অন্যান্য রোগ এবং জীবাণু সংক্রমিত হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাদুড়ের কামড় ছাড়াও বাদুড় পূর্ণ গুহায় অবস্থান করাটাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা সম্ভাবনা রয়েছে নিঃশ্বাসের সাথে বাদুড়ের বিষ্ঠার গুঁড়ো শ্বাসনালীতে প্রবেশ করার। বাদুড়ের বিষ্ঠায় এমন কিছু উপাদান আছে যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং রোগ সৃষ্টিকারী। পরিবেশে টিকে থাকার তাগিদে খাবারের জন্য আমাদের দেশীয় ফল-খেকো বাদুড় (Flying Fox) বা অন্যান্য বাদুড় রান্না করে খেলে রেভিস বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই, যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি নির্ভরশীল রান্নার পদ্ধতির উপর।    

সাপ (Snakes)

খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সাপের শরীর পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে মুহূর্তের মধ্যে বিষাক্ত সাপ সনাক্ত করার কোন অব্যর্থ উপায় নেই বলে সাপের কবল থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সকল ধরণের সাপকে এড়িয়ে চলা। যেখানে সাপের আধিক্য এবং বিষাক্ত সাপের উপস্থিতি রয়েছে সেখান থেকে খাবারের জন্য সাপ সংগ্রহ করার আশা ত্যাগ করা উচিৎ, কেননা সাপের কামড় খাবার আশঙ্কাটাও সেখানে প্রবল। সাপ প্রবণ এলাকায় চলাফেরা বা অবস্থানের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত সতর্কতাগুলো অবলম্বন করুন – 

  • হাঁটার সময় সতর্ক থাকুন এবং খেয়াল রাখুন কোথায় পা ফেলছেন। গাছের গুঁড়ি বা কাঁটা কাণ্ড এড়িয়ে চলুন, যদি একান্তই অতিক্রম করতে হয় তবে গুঁড়ির প্রান্তদেশে পা না রেখে একটু দূর থেকে গুঁড়ির উপর উঠে পড়ুন এবং অপর-পাশেও গুঁড়ির প্রান্তে না নেমে একটু দূরে নামুন।
  • গাছ থেকে ফল পাড়ার আগে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিন, জলাশয়ের আশ পাশ দিয়ে চলার সময় সতর্ক থাকুন।
  • কখনোই সাপকে বিরক্ত বা খোঁচাখোঁচি করবেন না। সাপ তার চোখ বন্ধ করতে পারে না বলে সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে এই ব্যাপারে আপনি কখনোই নিশ্চিত হতে পারবেন না। গোখরো, মাম্বা, র‍্যাটল স্ন্যাক সহ আরও কিছু প্রজাতির সাপ কোণঠাসা হলে বা বিপদ আঁচ করলে প্রচণ্ড রেগে যায় এবং বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ করতে পারে। এদের কারো কারো চলার গতি মানুষের দৌড়ানোর গতির চাইতেও বেশি হয়ে থাকে। 
  • পাথর বা গাছের গুঁড়ি সরানোর প্রয়োজন হলে লাঠি ব্যবহার করুন। 
  • চলাফেরার জন্য- বিশেষ করে রাতের বেলায় উপযুক্ত জুতো ব্যবহার করুন।
  • বিছানা বালিশ, আশ্রয়কেন্দ্র এবং জামাকাপড় ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।
  • কোন ভাবে সাপের মুখোমুখি হয়ে গেলে শান্ত থাকুন। সাপের শ্রবণ শক্তি নেই বলে ঘুমানোর বা রোদ পোহানোর সময় কোন অস্বাভাবিক আচরণ না করলে আপনি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন না। আপনার কাছ থেকে কোন বিপদের সম্ভাবনা না থাকলে বেশিরভাগ সময়ই সাপ পালিয়ে যাবে।
  • নিরাপত্তা বা খাবারের জন্য যদি সাপ মারতে হয় তাহলে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন। 
  • ঘুমন্ত মানুষের উত্তপ্ত শরীর সাপকে আকৃষ্ট করতে পারে, আশ্রয়স্থলের আশে পাশে সম্ভব হলে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে রাখুন।

সাপ মুক্ত এলাকা

সাপের বসবাসের অনুপযুক্ত বলে মেরু অঞ্চলে কোন সাপ নেই। এছাড়া নিউজিল্যান্ড, কিউবা, হাইতি, জ্যামাইকা, পুয়ের্তো রিকো, আয়ারল্যান্ড, পলিনেশিয়া এবং হাওয়াইতে বিষাক্ত সাপ নেই বলে ধরা হয়। 

গিরিগিটী

দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকা এবং মেক্সিকোতে বসবাসকারী গিলা মনস্টার (Gila Monster) গিরিগিটী জগতের সবচেয়ে বিষাক্ত এবং ভয়ঙ্কর গিরিগিটী। গাঢ় রঙের নকশা এবং গোলাপি রঙের ছোপ সমৃদ্ধ এই গিরিগিটী সাধারণত ৩৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার (১৪ থেকে ১৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে, এদের লেজ হয় খাটো আকৃতির এবং বেশ মোটা সোটা। এদের কামড় বেশ বিষাক্ত হলেও উত্যক্ত না করলে এরা সাধারণত কামড়ায় না।

ম্যাক্সিকান বিডেড (Mexican beaded) গিরিগিটীকে গিলা মনস্টারের আত্মীয় বলা যেতে পারে। তবে গিলা মনস্টারের মতো এদের শরীরে বিভিন্ন রঙের আলাদা আলাদা আঁকিবুঁকি থাকেনা বরং সবাই একই ধরণের ছোপ সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকায় বসবাসকারী এই গিরিগিটী যথেষ্ট পরিমাণে বিষাক্ত হলেও এদেরকে পোষ মানানো যায়। 

বিশাল আকৃতির গিরিগিটী কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon) প্রায় ৩ মিটার বা ১০ ফিট পর্যন্ত বড় হয়ে থাকে। ধরার চেষ্টা করলে এই গিরিগিটী ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। সাধারণত মৃত পশু পাখি খেয়ে বেঁচে থাকলেও বন্য শূকর, ছাগল, হরিণের মতো প্রাণীদের ঘায়েল করতে এদের কয়েক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনা। ইন্দোনেশিয়ান এই গিরিগিটীর ওজন ৩০০ পাউন্ড বা ১৩৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

নদী বা মিঠা পানির  বিপদ

স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিচ্ছি নদীতে বসবাসকারী জলহস্তী, এলিগেটর, কুমির এবং অন্যান্য বড় আকৃতির প্রাণীকে আপনি এড়িয়ে চলবেন, কিন্তু নদীতে আরও অনেক ছোট ছোট প্রাণী আছে যাদের ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। 

ইলেকট্রিক ইল (Electric Eel) দৈর্ঘ্যে ২ মিটার (৭ ফুট) এবং প্রস্থে ২০ সেন্টিমিটার (৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে। যে কোন পরিস্থিতিতে এদেরকে এড়িয়ে চলুন। শরীরের কোন কোন অংশে এরা এমনকি ৫০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। শিকার এবং শত্রুকে শক দিয়ে অবশ করে দিতে তারা এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। এদেরকে মূলত ওরিনোকো (কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা) এবং আমাজন (ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরু) নদীতে এবং এই দুটি নদী থেকে যে অসংখ্য নদীর সৃষ্টি হয়েছে তাদের অববাহিকায় পাওয়া যায়। এরা মূলত অগভীর পানির মাছ। অন্যান্য ইলের চাইতে এরা একটু মোটাসোটা, এদের পিঠের উপরের দিকটা কালো বা গাঢ় ছাই বর্ণের হলেও পেটের দিকটা হয় হালকা ধূসর। 

পিরানহা (Piranha) ওরিনোকো এবং আমাজনের আরেকটি ভয়ঙ্কর বিপদ এবং এদেরকে এদের উৎপত্তিস্থল প্যারাগুয়ে নদীর (Paraguay River – প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া) অববাহিকাতেও প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। পিরানহাদের আকার আকৃতি এবং গায়ের রঙে প্রচুর বৈচিত্র্য এবং পার্থক্য বিদ্যমান থাকলেও সাধারণত এদের শরীরের নিচের দিকটা কমলা রঙের এবং পিঠের দিকটা গাঢ় রঙের হয়ে থাকে। এদের ক্ষুরের মতো ধারালো ঝকঝকে সাদা দাঁত সহজেই নজরে পড়ে। প্রজাতি ভেদে এদের দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার (৫.৫ ইঞ্চি) থেকে শুরু করে ৫০ সেন্টিমিটার (২০ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে। এদের বিচরণের এলাকায় পানিতে নামার আগে সর্বোচ্চ ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করুন। রক্তের গন্ধ এদের আকৃষ্ট করে। শুকনো মৌসুমে অগভীর পানিতে যখন খাবার থাকে অপ্রতুল তখন এরা হয়ে উঠে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং যে কোন প্রাণীকে অবলীলায় দলবেঁধে আক্রমণ করে।

মিঠা পানির কচ্ছপ ধরার সময়ও কিছু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। উত্তর আমেরিকার স্নেপিং (snapping turtles) ও সফটশেল টারটেলস (spiny softshell turtle) এবং দক্ষিণ আমেরিকার মাতামাতা (Mata Mata)সহ আরও কিছু প্রজাতির কচ্ছপের ক্ষেত্রে এই সতর্কতা বাধ্যতামূলক। এই কচ্ছপ গুলো বিপদের সম্মুখীন হলেই আক্রমণ করে কামড়ে ধরবে এবং এরা এক কামড়েই হাত বা পায়ের আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। 

প্লাটিপাস (platypus) বা ডাকবিল প্লাটিপাস তার প্রজাতির একমাত্র সদস্য হিসেবে পৃথিবীতে টিকে আছে। এদেরকে চেনা যায় খুব সহজেই। এদের লম্বা শরীর ছোট ছোট ধূসর লোমে আবৃত, লেজ বিবরের (beaver) মতো ছোট এবং রয়েছে হাসের মতো চঞ্চু। খাবারের চমৎকার উৎস এই প্রাণী দৈর্ঘ্যে ৬০ সেন্টিমিটার (২৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত বড় হতে পারে, ওজন হয়ে থাকে এক থেকে আড়াই কেজি পর্যন্ত। কিন্তু ডিম পারা স্তন্যপায়ী বিরল বৈশিষ্ট্যের এই প্রাণী (পৃথিবীতে দুইটি প্রাণী এখনো বিদ্যমান, অপরটি spiny anteater) বিপদজনকও বটে। পুরুষ প্লাটিপাসের পিছনের দুই পা-তে বিষাক্ত কাঁটা রয়েছে যা মুহূর্তের মধ্য তীব্র এবং সংক্রামক ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্লাটিপাস এখন শুধু অস্ট্রেলিয়ায় দেখতে পাওয়া যায়, এরা বসবাস করে মূলত নদীর কর্দমাক্ত তীরে। 

উপসাগর এবং মোহনার বিপদ

নদী এসে যেখানে সমুদ্রে মিলিত হয় সেখানে বিপদের উপস্থিতি থাকে দ্বিমুখী। এ সকল জায়গায় মিঠা এবং লোনা পানি- দুই ধরণের বিপদেই আপনার পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অগভীর লোনা পানিতে এমন অনেক জীব বসবাস করে যাদের সংস্পর্শে তীব্র ব্যথা এবং সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে সামুদ্রিক সজারুর (sea urchin) কথা, এদের উপর পা দেয়া মাত্র কাঁটা ফুটে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হতে হবে এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অগভীর পানিতে চলাচলের সময় উপযুক্ত জুতো পায়ে রাখা উচিৎ এবং হাঁটার সময় স্বাভাবিক ভাবে পা তুলে না হেঁটে পানির নিচে পা টেনে টেনে হাঁটা উচিৎ। 

করাতের মতো খাঁজ কাঁটা লম্বা লেজওয়ালা শঙ্কর মাছ (Sting Ray) গ্রীষ্মমন্ডলিয় অঞ্চলের অগভীর পানির আরেকটি আতঙ্ক। শঙ্কর মাছের প্রজাতিদের মাঝে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও সকলেরই লেজের অগ্রভাগে তীক্ষ্ণ বিষাক্ত কাঁটা রয়েছে যা দিয়ে তারা তাৎক্ষনিক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রজাতি ভেদে আকার, আকৃতি এবং স্বভাবে অনেক পার্থক্য থাকলেও সব শঙ্কর মাছ দেখতে অনেকটা ঘুড়ির মতো হয়ে থাকে। মূলত আমেরিকা, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী এলাকায় এদের দেখা যায়। 

লোনা পানির বিপদ

লোনা পানির বেশ কিছু মাছ আছে যাদের সংস্পর্শে কোন ভাবেই আসা যাবেনা, কিছু মাছ আছে যাদের কখনোই খাওয়া যাবেনা। 

হাঙ্গর (Shark) হচ্ছে সমুদ্রের বা লোনা পানির সবচেয়ে ভীতিকর প্রাণী। হাঙ্গর আক্রমণ করলে সেটাকে এড়ানোর কোন উপায় থাকেনা বলে এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। হাঙ্গরকে এড়ানোর জন্য তাই আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হাঙ্গরের অসংখ্য প্রজাতি থাকলেও ভয়ঙ্কর মাংসাশী হাঙ্গরের প্রজাতি গুলোর রয়েছে বিশাল ছড়ানো চোয়াল আর দৃশ্যমান ক্ষুরধার দাঁত, অন্যদিকে নিরীহ হাঙ্গর প্রজাতির ছোট আকৃতির মুখ থাকে তাদের মাথার নিচের দিকে। তবে হোক ভয়ঙ্কর বা নিরীহ যে কোন হাঙ্গরই তাদের কামড় বা খসখসে চামড়ার ঘর্ষণের মাধ্যমে আপনাকে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে জখম করতে সক্ষম।

র‍্যাবিট ফিস (Rabbitfish or spinefoot) মূলত ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবাল প্রাচীরে বসবাস করে। তার ডানা বা পাখনায় তীক্ষ্ণ বিষাক্ত কাঁটা রয়েছে। এদেরকে ধরার যদি একান্তই দরকার পড়ে, তবে সতর্কতার সাথে ধরুন। প্রবালপ্রাচীরের অন্যান্য ভয়ঙ্কর মাছের মতো এই মাছটাকেও স্থানীয় লোকজন খাবারের জন্যই ধরে থাকে এবং মুহূর্তের অসাবধানতার কারণে মারাও যায়। খাবার জন্য মাছ ধরতে হলে বিষাক্ত নয় এমন মাছের দিকেই নজর দিন।

সার্জন ফিস (Tang fish of surgeon fish) গড়পড়তা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার (৮-১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয় এবং এদের দেহের বর্ণ খুবই চমকপ্রদ এবং রঙ্গিন হয়ে থাকে। এদের সার্জন ফিস বলার কারণ এদের লেজের কাছে শল্য চিকিৎসকের ব্যবহার্য ছুড়ির মতো কাঁটা রয়েছে। এই কাঁটার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে সংক্রমণ, বিষক্রিয়া এবং রক্তক্ষরণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

টোডফিস (Toad Fish) গ্রীষ্মমন্ডলিয় অঞ্চলে - মূলত আমেরিকার গালফ কোস্ট এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাস করে। ফ্যাঁকাসে রঙের এই মাছ ১৮ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার (৭ থেকে ১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যান্য মাছ এবং শিকার ধরার জন্য তারা বালির নিচে তাদের শরীর লুকিয়ে রাখে বলে সহজে এরা চোখে পড়েনা। এদের পিঠের দাঁড়া খুবই শক্ত, ধারালো এবং বিষাক্ত।

বিষাক্ত স্করপিয়ন ফিস (Poisonous scorpion fish) মূলত ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবালপ্রাচীরে বসবাস করলেও প্রায়শই এদেরকে ভূমধ্যসাগর সাগর এবং ইজিয়ান সাগরে খুঁজে পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যে এরা ৩০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার (১২ থেকে ২৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের গায়ের বর্ণে প্রচুর বৈচিত্র্য রয়েছে, এদের বর্ণ লালচে বাদামী থেকে শুরু করে পুরোপুরি বেগুনি, এমনকি ধুসর এবং হলুদাভও হতে পারে। এদের লম্বা, ঢেও খেলানো বিষাক্ত দাঁড়া এবং ডানার স্পর্শে তীব্র যন্ত্রণা হয় এবং তাৎক্ষনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে হয়। আটলান্টিক মহাসাগরে এদের জ্ঞাতিভাই থাকলেও তারা খুব একটা বিষাক্ত নয়।

স্টোন ফিস (stone fish) পাওয়া যায় প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরে। এদের উপর পা পড়লে বা অসাবধানে হাত দিয়ে ধরতে গেলে এদের শিরদাঁড়ার কাঁটার আঘাতে তীব্র যন্ত্রণা এবং বিষে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এদের পাথরের মতো এবড়ো খেবড়ো আকার এবং ম্যাটম্যাটে বাদামী রঙের কারণে পানির নিচে এদের সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। এরা ৪০ সেন্টিমিটার (১৬ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। 

উইভার ফিস (Weever fish) গড়পড়তায় ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তীরবর্তী এলাকার বালির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে রাখে বলে বালি থেকে আলাদা করে এদের সনাক্ত করা খুব কঠিন। এদের গায়ের রঙ অনুজ্জ্বল বাদামী বলে খুব সহজেই এরা বালির সাথে মিশে যেতে পারে। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বসবাসকারী এই মাছের পিঠে এবং কানকোতে বিষাক্ত কাঁটা রয়েছে।

সামুদ্রিক প্রাণী না হলেও উত্তর মেরুর সমুদ্রের তীরে বসবাসকারী মেরু ভল্লুকের (Polar Bear) কলিজায় রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রার ভিটামিন এ, যে কারণে এই কলিজা খেলে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। 

হকসবিল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের (hawksbill turtle) মাংসও বিষাক্ত। নিচের দিকে বাঁকানো নাক এবং ঘাড় ও সামনের পায়ের হলুদাভ ফুটকি ফুটকি দাগ দেখে সহজেই এদের চেনা যায়। বিশাল এই কচ্ছপের ওজন ২৭৫ কেজি (৬০০ পাউন্ড) থেকেও বেশি হতে পারে বলে এদের ধরাটা একটু কঠিন।

মোহনা, খাঁড়ি এবং হ্রদে বসবাসকারী অনেক মাছ খাবার হিসেবে বিষাক্ত হলেও ঋতুবদলের সাথে সাথে এরা খাবার উপযোগী হয়ে উঠে। তবে এরা মূলত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মাছ হলেও যে কোন জায়গাতেই অপরিচিত মাছ খাবার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। 

ব্যারাকুডা (Barracuda) এবং স্ন্যাপারের (Snapper) মতো নির্বিষ শিকারি মাছও বিষাক্ত মাছ গলাধঃকরণের কারণে হয়ে উঠতে পারে বিষাক্ত। যে সকল মাছ খাবার কারণে এরা বিষাক্ত হয়ে উঠে তারমধ্যে সবচেয়ে বিষাক্ত রূপে আবির্ভূত পটকা মাছের রয়েছে টিয়া পাখির মতো বাঁকানো ঠোট এবং খোলকের মতো দেখতে শিরদাঁড়া। এরা এদের শরীরকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে ফেলতে পারে। 

ব্লো ফিস (Blow fish) বা পটকা মাছ সারা পৃথিবীব্যাপী গ্রীষ্মমন্ডলিয় এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের তীরবর্তী সমুদ্রে বসবাস করে, এমনকি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু কিছু নদীতেও এদের পাওয়া যায়। স্থূলকায় গোলাকার শরীরের এই মাছের শিরদাঁড়া খুবই ছোট আকৃতির এবং বিপদের আভাস পেলে বা রেগে গেলে এরা এদের শরীরকে বলের মতো গোল করে ফেলে। রঙের তারতম্য এবং আকৃতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ এই মাছ ৭৫ সেন্টিমিটার (২৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এই মাছের রক্ত, যকৃত এবং ডিম্বাশয় এতোটাই বিষাক্ত যে মৃত্যু ডেকে আনার জন্য মাত্র ২৮ মিলিগ্রাম-ই (১ আউন্স) যথেষ্ট। যদিও বছরের কোন কোন সময় স্থানীয় লোকেরা পটকা মাছকে উপাদেয় খাবার হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।

রঙিন এবং বৈচিত্র্যময় ট্রিগার ফিস (Trigger Fish) মূলত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের সমুদ্রে পাওয়া যায়। এদের শরীর মূলত চ্যাপ্টা, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সমস্ত শরীরের প্রস্থ সমান কিন্তু শরীরের মধ্যভাগের উচ্চতা বেশি হয়ে থাকে। শিরদাঁড়ায় লম্বা ধারালো কাঁটাযুক্ত এই মাছ লম্বায় ৬০ সেন্টিমিটার (২৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই প্রজাতির সকল মাছকে পরিহার করা উচিৎ কেননা এদের বেশিরভাগই বিষাক্ত হয়ে থাকে।

বেশিরভাগ লোক যদিও হিংস্র স্বভাবের জন্য ব্যারাকুডাকে এড়িয়ে চলে তবু অনেকেই সুস্বাদু মাংসের জন্য এদের খেয়ে থাকে। গ্রীষ্মমন্ডলিয় অঞ্চলের এই শিকারি মাছ লম্বায় ১.৫ মিটার (৫ ফুট) পর্যন্ত লম্বা হয় এবং কোন প্ররোচনা ছাড়াই মানুষকে আক্রমণ করে থাকে। কদাচিৎ তারা তাদের শরীরে সিগুয়েটেরা( ciguatera) বিষ বহন করে ভয়ানক রকমের বিষাক্ত হয়ে উঠে। এসময় এদেরকে খাওয়া মানেই মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া। (সিগুয়েটেরা বিষ সংক্রান্ত বিস্তারিত জানার জন্য এই ফিচারের ‘খাবার প্রক্রিয়াকরণ’ অংশটি দেখুন)।

অন্যান্য বিপদজনক সামুদ্রিক প্রাণী 

নীল রঙের বৃত্তাকার ছোপওয়ালা অক্টোপাস, জেলি ফিস, মোচা এবং তুরপুন আকৃতির ঝিনুক বিপদজনক সামুদ্রিক প্রাণীর তালিকার অন্তর্ভুক্ত বলে এদের সম্পর্কে সর্বদাই সতর্ক থাকা উচিৎ।

যথাযথ ভাবে রান্না করতে পারলে অসাধারণ স্বাদের হয় বলে সব ধরণের অক্টোপাসেরই যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে তবে এই ব্লু-রিঙ্গড অক্টোপাসের (blue-ringed octopus) রয়েছে তাৎক্ষনিক মৃত্যু নিশ্চিত করার মতো ভয়ঙ্কর কামড়। সৌভাগ্যক্রমে এই অক্টোপাস শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রীফে পাওয়া যায়। আকারে এরা খুবই ছোট হয়ে থাকে এবং এদের ধূসর সাদা শরীরের উপর নীল রঙের বৃত্তাকার ছাপের জন্য খুব সহজেই এদের সনাক্ত করা যায়। খেতে সুস্বাদু হলেও গ্রীষ্মমন্ডলিয় অঞ্চলের প্রায় সকল প্রজাতির অক্টোপাসের কামড় বিষাক্ত বলে এদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। 

জেলি ফিসের আক্রমণে সচরাচর মৃত্যু না ঘটলেও এদের কামড় তীব্র যন্ত্রণাদায়ক। পর্তুগিজ ম্যান অফ ওয়ার (Portuguese man-of-war) নামে পরিচিত জেলিফিশ দেখলে মনে হয় সমুদ্রের পানিতে গোলাপি বা বেগুনী রঙের বড় আকৃতির একটা বেলুন ভেসে বেড়াচ্ছে। এদের বিষাক্ত কর্ষিকা বা নালীর মতো জট পাকানো প্রত্যঙ্গ পানির গভীরে ১২ মিটার (৪০ ফিট) নিচে পর্যন্ত প্রবেশ করে থাকে। বিশাল এই কর্ষিকাগুলো মূলত বিষাক্ত হূলের আবাসস্থল। জেলি ফিসের কারণে যে গুটিকতক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের বেশিরভাগের জন্যই দায়ী এই পর্তুগীজ ম্যান অফ ওয়ার। অন্যান্য জেলিফিশের কর্ষিকার সংস্পর্শেও তীব্র যন্ত্রণার সম্ভাবনা রয়েছে বলে যে কোন জেলিফিশের লম্বা কর্ষিকা এড়িয়ে চলুন, এমনকি পানিতে বা সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা মৃত জেলিফিশ হলেও।    

প্রায় গ্রীষ্মমন্ডলিয় এবং গ্রীষ্মমন্ডলিয় অঞ্চলের মোচা আকৃতির ঝিনুক গুলোর হারপূন বা কোঁচ আকৃতির বিষাক্ত হূল রয়েছে। এদের সকলের পিঠেই বিচিত্র রঙের জালের মতো চমৎকার নকশা কাঁটা রয়েছে। ঝিল্লি বা অতি পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকায় এদের রঙ কিছুটা ম্লান দেখাতে পারে। এই প্রজাতির কিছু কিছু ঝিনুক প্রচণ্ড বিষাক্ত হয়ে থাকে, ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু প্রজাতি এমনকি তাৎক্ষনিক মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। আইসক্রিম কোন বা মোচার মতো দেখতে যে কোন ঝিনুক এড়িয়ে চলুন।

তুরপুন আকৃতির ঝিনুক দেখতে মোচা আকৃতির ঝিনুকের চাইতে লম্বা এবং পাতলা হলেও প্রায় একই রকম বিষাক্ত। নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মমন্ডলিয় সমুদ্রে এদের পাওয়া যায়। ভারতীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরের এই প্রজাতির ঝিনুকগুলোর বিষাক্ত হূল রয়েছে। এদের মাংস বিষাক্ত বলে এই প্রজাতির ঝিনুক খাওয়া থেকেও বিরত থাকুন। 

* লেখাটি সার্ভাইভাল গাইড ফিচারের অন্তর্ভূক্ত।

প্রাসঙ্গিক লেখা