এই রূপালী গিটার ফেলে...


আশি সাল।

নিউইয়র্কের বিখ্যাত GuiterWorld চেইন মিউজিকের দোকানে বয়সে তরুন এক ছেলে ঘুরছে তার পছন্দের গীটারের জন্য। যেই দেশ থেকে সে এসেছে সে দেশে এরকম গিটারের দোকান তো দূরের কথা গিটার সামনা সামনি দেখেছে এমন মানুষই খুব কম।
দোকানে সাজানো সারি সারি গিটার থেকে ছেলেটি সাহস করে একটি গিটার ধরল, কিছুক্ষন আনমনে বাজালও। বাজানো শেষে গিটারটা রেখে ছেলেটি শুকনো মুখে পা বাড়ালো দরজার দিকে। 
ছেলেটির এই প্রথম নিউইয়র্ক আসা। এই গিটার কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। যে দলটির সাথে সে দেশ থেকে এসেছে সে দলেরও খুব কম মানুষকেই সে চেনে যে তাকে টাকাটা ধার দিতে পারবে।
বাইরে পা বাড়াতেই দোকানের ভিতর থেকে কেউ একজন তাকে ডাক দিলো। একজন বৃদ্ধ কাউন্টার থেকে ডাকছেন। বৃদ্ধ ছেলেটিকে নিয়ে গেল দোকানের পিছনের দিকের কিছু দামী গিটারের মাঝে।
বৃদ্ধ বলল, বাজাও। তোমার যেটা বাজাতে ইচ্ছা করে সেটা আমাকে তুমি বাজিয়ে শোনাও।
অবাক ছেলেটি কোনদিনও হাতে পায়নি এতো ভালো গিটার। নিউইয়র্কের সেই ছোট্টো দোকানের কোনে হৃদয়ের সমস্ত উজার করে বাজিয়ে গেল ছেলেটি। যখন খেয়াল হলো তখন ছেলেটি অবাক হয়ে দেখলো পুরো শপিং মলের লোকজন জড়ো হয়ে তন্ময় হয়ে শুনছে তার গিটার। সবাই বলছে, এমন গিটার বাজানো তারা বহুদিন শুনে নাই।

যখন খেয়াল হলো তখন ছেলেটি অবাক হয়ে দেখলো পুরো শপিং মলের লোকজন জড়ো হয়ে তন্ময় হয়ে শুনছে তার গিটার। সবাই বলছে, এমন গিটার বাজানো তারা বহুদিন শুনে নাই।
বৃদ্ধ জানালেন দোকানের প্রধান তিনিই। গিটারটা প্যাক করে ছেলেটিকে দিয়ে তিনি বললেন, প্রতিদিন অনেক মানুষের গিটার আমাকে শুনতে হয়। এমন প্যাশনেট ভাবে বাজাতে বহুদিন পরে কাউকে দেখলাম আমি। এই গিটারটা আমার দোকানের পক্ষ থেকে তোমাকে উপহার। 

এই ঘটনার দশ বছর পর।

নব্বই দশকের মধ্যভাগ ,আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। প্রথম প্রেমে পড়ার বয়স সেটা। কিন্তু আমাদের কোন বন্ধুদের জীবনে তখনো কোন প্রেমিকা নেই। বয়সটাই এমন, জীবনে আমাদের প্রেম না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের সব প্রেমেরই তখন একটা জীবন ছিলো। সেই আশ্চর্য জীবনটা চারপাশের সব কিছুরই প্রেমে পড়তে চায়, আর অদ্ভূত সব কষ্ট পায়।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের জীবনে রুপালী গিটার হাতে আবির্ভূত হলেন এক হ্যমিলনের বাঁশিওয়ালা। সেই প্রথম জানলাম আমাদের কষ্টগুলোর এক একটার নাম আছে, যাদুকর বাঁশিওয়ালা বললেন চলো বদলে যাই, সেইদিন থেকে আমাদের রাতগুলি আচমকা বদলে হয়ে গেল তারাভরা, ঘুমভাঙ্গা শহরে সেদিন ফেরারী মন নিয়ে জেগে উঠলাম স্কুল কলেজে পড়া হাজার হাজার আমরা। আমরা প্রেমে বাঁধা পড়লাম ব্যান্ড মিউজিক নামের আশ্চর্য এক জগতের।

আরো বিশ বছর পরে, ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে কনসার্ট হচ্ছে। নাম, ওল্ড ইজ গোল্ড কনসার্ট। নব্বই দশকের সেরা দশটা ব্যান্ড দল নিয়ে বামবার আয়োজন। কনসার্ট সফল হবে তো, মানুষ আসবে তো। দুরুদুরু বুকে বহুদিন পরে আবারো কনসার্টের টিকিট কিনলাম। 
রুপালী গিটার হাতের সেই ছেলেটি সেদিন আর বয়সে তরুন নেই। আমরাও আর কেউ কিশোর নই। মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যায় আমার আশে পাশে যারা ছিলো প্রায় সবাই আমাদেরই বয়সী। দেখা হতে লাগলো পুরানো বন্ধুদের সাথে। আশ্চর্য আমরা সবাই কিভাবে যেন এসেছি, স্টেডিয়াম পূর্ন করে আমরা অপেক্ষা করছি।

কনসার্টের শেষের দিকে তিনি এলেন। আমরা গলা মিলিয়ে গাইলাম যেন হাজার বছরের পরিচিত একএকটি গান। এমনি এক সময়ে গিটারে বেজে উঠলো অপার্থিব এক গানের সুর। আমরা বড় হবো, একদিন আমাদের ছেলেমেয়েরাও বড় হবে কিন্তু এই গানের সুর আর কথা কখনো পুরনো হবে না। কলেজ জীবনে বহুবার কনসার্টে শুনেছি আর চিৎকার করে গেয়েছি এই গান। কিন্তু এইবার, অনেক বছর পরে, যখন সেই বিশেষ গানটি শুরু হলো তখন টের পেলাম আমার চারপাশে নেমে এলো আশ্চর্য ধ্যানমগ্নতা। বাতাস ঘন হয়ে এলো, একটা করুন অন্ধকার যেন ঝুপ করে নিরবতার চাদর পরে সমস্ত স্টেডিয়ামকে ঘিরে ফেললো। আমি প্রথমে অনেকের মতই গানে গলা মেলাতে চাইলাম। কিন্তু, বুকের ভিতর থেকে হাহাকারের মতো কি যেন গলার কাছে বারবার আসতে চাইলো।

অবাক হয়ে পাশ ফিরে দেখলাম, আমার ভালোবাসার মানুষটা চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। যে বন্ধুদের দলটার সাথে গিয়েছিলাম তারা সবাই বিহ্বল হয়ে চোখের পানি থামানোর চেষ্টা করছে। দূরে, কাপলরা একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। সমস্ত স্টেডিয়াম জুড়ে এক অদ্ভূত দৃশ্য।
জীবনে আমরা বহুবার কৈশোরকে হারাই। সেই দিন, কনসার্টের মাঠে সেই গানটির সাথে, আমরা আরেকবার হারালাম আমাদের কৈশোর। 
কেউ যদি জানতে চায় আমার কৈশোরের গল্প তবে বলবো, আমি বেড়ে উঠেছিলাম কিছু লিজেন্ড'দের সময়ে, আমাদের কিছু একই রকম ভালোলাগা আর দুঃখের গল্প নিয়ে, সেই সময়টা অনেক অন্যরকম ছিলো।
তোমরা বুঝবে না।


প্রাসঙ্গিক লেখা