পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল পর্ব (২য় অংশ)


পদ্মশংঙ্খ নামে এক অতি তেজস্বী মুনি ছিলেন। একদিন ঝড়ে তাঁর আশ্রমের কাছে এক গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল। সে ডালের কোটরে ছিল দুটো পাখির ডিম। মুনি ডিমদুটো অক্ষত দেখতে পেয়ে তার যত্ন নিতে লাগলেন। কিছুদিন পরে সে ডিম দুটি থেকে দুটো খুব সুন্দর পাখির বাচ্চা বের হল। মুনি পরম মমতায় তাদের বড় করতে লাগলেন। এভাবে ধীরে ধীরে সে আশ্রমে পাখি দুটি থেকে বংশ বৃদ্ধি পেল। পুরো আশ্রম সবসময় কলকাকলিতে মুখর হয়ে থাকত। মুনিও সন্তানস্নেহে তাদেরকে পালন করতেন।

একদিন মুনি কোন এক কাজে গেছেন বাইরে। রাতে আর আশ্রমে ফিরতে পারলেন না। সন্তানতুল্য পাখিগুলোর চিন্তায় কোনমতে রাতটা পার করেই সকালে এসে দেখেন পুরো আশ্রমে পাখির কোন চিহ্ন নেই, আওয়াজ নেই! ধ্যানে বসে জানতে পারলেন একদল সাপ এসে রাতে সবপাখিগুলোকে খেয়ে গেছে। সন্তান হারানোর শোক বুকে নিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন,”এজন্মে আমার পাখিগুলোকে রক্ষা করতে পারলাম না। পরজন্মে আমি যেন নাগহন্তা হয়ে জন্মগ্রহণ করি। সকল সাপ যেন হয় আমার শত্রু”। এই বলে তিনি দেহত্যাগ করলেন।

সেই মুনিই পরজন্মে চম্পকনগরের কোটিশ্বর বণিকের পুত্ররূপে জন্মলাভ করলেন। নাম হল চন্দ্রধর বা চাঁদ সওদাগর। নাগকূলের এই জন্মজন্মান্তরের শত্রুকেই কি না শিষ্যরূপে চাইলেন পদ্মাবতী - নাগদেবী মনসা!

একদিন মনসা পিতা শিবের কাছে এক আর্জি নিয়ে দাঁড়ালেন,” সকল দেবদেবীর পূজা আছে মর্ত্যে। আমিও আমার মহিমা প্রচার করতে চাই।“ শিব খানিক চুপ করে থেকে তাঁকে বললেন,”সারা পৃথিবীর যেখানে খুশি যাও, শুধু চম্পকনগরে যাবে না। কারণ, সেখানে আছে চাঁদ সওদাগর, যে সুযোগ পেলেই তোমার বিনাশ করবে। আর তোমার বোনকে সাথে রেখো, সে সর্বক্ষেত্রে তোমার সাথী হবে।“ তখন মনসা পিতাকে প্রণাম করে বোন নেতাকে সাথে নিয়ে মর্ত্যে যাত্রা করলেন নিজের মহিমা প্রচার ও পূজা পাবার জন্যে।

ধীরে ধীরে চারদিকে জাগ্রত নাগদেবী হিসেবে মনসার পূজা চালু হয়ে গেল, শুধু চম্পকনগরে ছাড়া। সেখানে চাঁদ সওদাগর সব সাপ মেরে উজার করে ফেলেছেন। খবর পেয়ে মনসা ভুলে গেলেন শিবাদেশ, নাগকূলের রক্ষার জন্য তিনি কৌশলের আশ্রয় নিলেন।

চম্পকনগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মাছে ভর্তি গণ্ডকী নদী। মনসা মায়াজালে সে নদীর সব মাছ অদৃশ্য করে দিলেন। জেলেরা প্রতিদিন প্রচুর মাছ পায়। একদিন এসে তারা দেখল কোন মাছ নেই। হাহাকার পরে গেল তাদের মাঝে। তখন মনসা এক সাধারণ নারীর বেশে এসে বললেন তাঁকে নৌকায় করে চম্পকনগরে পৌঁছে দিলেই মাছ পাওয়া যাবে। জেলে সর্দার জালু আর মালু মনসাকে নগরে পৌঁছে দিতেই আবার জেলেদের জালে মাছ উঠতে শুরু করল। মনসার মায়ায় জালে উঠে এল দুটো সোনার ঘট। মনসা তখন নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের ঘটদুটো বাড়িতে নিয়ে প্রতিদিন পূজা করতে বললেন। এ পূজা থেকেই জালু আর মালু প্রচুর ঐশ্বর্যের মালিক বনে গেল।

জালু-মালুর ভাগ্য ফেরার খবর শুনে একদিন দেখতে এলেন চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী সুনুকা। দেবী মনসার কথা জানতে পেরে তিনি একটি ঘট চেয়ে নিলেন পূজার জন্য। জন্মজন্মান্তরের নাগশত্রু চাঁদের বাড়িতেই এবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল মনসার আসন। সুনুকাকে দেখাও দিলেন দেবী। এভাবেই নিত্য পূজা চলছে। একদিন খবর গেল চাঁদের কানে। তাঁর বাড়িতে হচ্ছে নাগদেবীর পূজা! ছুটে গিয়ে দেবী পার্বতীর দেয়া হেমতালের লাঠির আঘাতে পূজার বেদী ভেঙ্গে দিলেন তিনি, ঘটটিও। তছনছ হয়ে গেল মনসার পূজার আয়োজন। স্বামীর ক্রোধ দেখে আর দেবীর কুপিত হয়ার ভয়ে পূজাস্থল ছেড়ে পালিয়ে গেলেন স্ত্রী সুনুকা।

সাধারণ এক মরণশীল মানুষের কাছে দেবীত্বের অবমাননা! মনসার দেহেমনে অপমানের বিষজ্বালা। নেতার পরামর্শে আর মনসার আদেশে পাণ্ডুনাগ দংশন করল চাঁদের ছয় পুত্রকে। কিন্তু পূর্বজন্মের তপস্বী পদ্মশংখ যিনি এ জন্মে চাঁদ বণিক, গুপ্তবীজমন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে মৃতপুত্রদের দেহে আবার প্রাণ সঞ্চার করে দিলেন। মনসার অপমানের আগুনে যেন ঘি পড়ল। দেবী মনসা আবার হেরে গেলেন।

তখন নেতা বুদ্ধি দিল - “ যে মহাজ্ঞানের কারণে চাঁদ এত শক্তিশালী, সে মহাজ্ঞান হরণ কর।“

তখন নেতা বুদ্ধি দিল - “ যে মহাজ্ঞানের কারণে চাঁদ এত শক্তিশালী, সে মহাজ্ঞান হরণ কর।“ মনসা এবার সুনুকার বোন কনকার রূপ ধরে গেলেন চাঁদের কাছে। সুন্দরী শ্যালিকার ছলাকলায় চাঁদ বশ হয়ে বলে ফেললেন নিজের মহাজ্ঞান মন্ত্রটি। অন্যদিকে ধন্বন্তরি ও শঙ্খ নামের চাঁদ বণিকের দুই বৈদ্য ও ওঝাকেও মেরে ফেললেন মনসা। এভাবে গুপ্তজ্ঞান, চিকিৎসক আর ওঝাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন চাঁদ সওদাগর। আর এ সুযোগেই মনসা এলেন নাগসৈন্যদের নিয়ে। মনসার হুকুমে অনন্ত বাসুকি নাগের দংশনে চাঁদের ছয়পুত্র মারা গেল। এবার আর কোন প্রতিকার নেই চাঁদের কাছে। তিনি চোখের জল আর বুকের জ্বালা চেপে রেখে ভেলা সাজিয়ে ছয় পুত্রের মৃতদেহ ভাসিয়ে দিলেন গণ্ডুকীর বুকে।

চাঁদ ভেঙ্গে পড়লেন ঠিক, কিন্তু মনসার কাছে মাথা নত করলেন না। ফলে মনসা জিতেও জয় পেলেন না। কারণ, মনসাতো চাঁদ সওদাগরের পরাজয় নয়, পূজা চান। তাই এবার নেতার সাথে বসলেন এক সুদূরপ্রসারী পরামর্শে। তারপর তিনি গেলেন ইন্দ্রপুরীতে দুই নর্তকী ঊষা আর অনিরুদ্ধকে নিয়ে আসতে। স্বর্গে তখন নাচের আসর বসেছে। অপ্সরারা সবাই নৃত্যের জন্য প্রস্তুত। মনসার বিষদৃষ্টিতে অবশ হয়ে গেল ঊষা আর অনিরুদ্ধ। নাচের তাল কেটে যাওয়ায় অপ্সরাধিপতি ইন্দ্র ভয়ঙ্কর ক্ষেপে গেলেন। অভিশাপ দিয়ে বসলেন এদের দুজনকে,” তোমরা দেবতাদের আনন্দভঙ্গ করলে? তোমরা এখন থেকে স্বর্গচ্যুত হলে। যাও, মানুষ হয়ে পৃথিবীতে বাস কর গিয়ে।“ পরিকল্পনা কাজ দেয়ায় এবার মনসা গিয়ে ধরলেন ইন্দ্রকে,”দেবরাজ, এ দুজনকে আমাকে দিয়ে দিন। আমি এদেরকে আমার ভক্ত করব।“

ঊষা আর অনিরুদ্ধের কান্নাকাটিতে কিছুটা নরম হয়ে ইন্দ্র তখন মনসাকে বললেন,”ঠিক আছে এখন থেকে ষোল বছর এরা তোমার ভক্তরূপে রবে। ষোল বছর পর এরা আবার এখানে ফেরত আসবে।“ মনসা এবার গেলেন শিবের কাছে। গিয়ে বললেন,”পিতা, আমাকে এই বর দাও যেন এই অনিরুদ্ধ চন্দ্রধরের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে আর ঊষা জন্ম নেয় উজানী নগরে।“ পিতা সায় দিলেন,”তথাস্তু”। ফিরে এলেন মনসা মর্ত্যে, সাথে ঊষা আর অনিরুদ্ধের কায়াহীন মায়াবী উপস্থিত - অনেক পরে ঘটবে এমন এক কাহিনির শুরুর জন্য।

বেশ কিছুদিন পরের কথা। চাঁদ সওদাগর যাবেন লঙ্কায়, বাণিজ্য করতে। সাজসাজ ব্যাপার। গুরুদেব জানালেন দেবী মনসা কুপিত, এ অবস্থায় যাত্রা বিপজ্জনক। তখন ব্রহ্মার আরাধনা করলে ব্রহ্মা তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন,”পার্বতীর দেয়া হেমতালের লাঠি হাতে থাকতে তোমার কোন ভয় নাই। তুমি মন-পবনের কাঠ দিয়ে ডিঙ্গা তৈরি কর। এ ডিঙ্গার নাম দিবে – মধুকর”। এরপর শিবের পূজা করে আশীর্বাদ নিলেন তিনি। দুই আরাধ্য দেবতার আশীর্বাদ নিয়ে এবার লোক পাঠালেন গভীর অরণ্যে মন-পবনের কাঠ আনতে। কিন্তু কাঠ নিবে কিভাবে? মনসার নাগেরা সমস্ত মন-পবনের গাছগুলোকে ঘিরে রেখেছে। তখন দুর্গাকে স্মরণ করলে দেবীর ইশারায় নাগেরা সরে গেলে কাঠ নিয়ে এল লোকেরা। পবনপুত্র হনুমান সে ভারি কাঠের বোঝা চম্পকনগরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এলেন।

নির্দিষ্ট শুভ দিনে সকল দেবদেবীর পূজা আর চণ্ডিকার পূজা শেষ করে চাঁদ সওদাগর প্রস্তুত। যাবার আগে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী সুনুকার থেকে বিদায় নিয়ে এলেন। এ সময় শেষ চেষ্টা হিসেবে দেখা দিলেন মনসা। বললেন,”চাঁদ, তুমি সবার পূজা করলে, আমারটাও করতে। আমি তোমার ছয় পুত্রকে বাঁচিয়ে দিব, অগাধ ধনসম্পদ দিব।“ উত্তরে হেমতালের লাঠি দিয়ে মনসাকে তাড়া করলেন চাঁদ। অপমানিত মনসা শাপ দিলেন,”এর ফল তুমি পাবে।“

কুলগুরুর আশীর্বাদ নিয়ে চাঁদ সওদাগর রওনা হয়ে গেলেন। এ বিদেশ যাত্রার কিছু দিন পরেই সুনুকা এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। ছেলের রূপের আলোতে চারদিক যেন ভরে উঠল। যে দেখে সেই বলে ওঠে,”এতো যেন শাপগ্রস্ত দেবতা!” পুত্রের মুখ দর্শনে মা যেন ভুলে গেলেন আগের ছয় পুত্রের মৃত্যুর স্মৃতি। তার নাম রাখা হল লক্ষ্মীধর বা লক্ষ্মীন্দর। মায়ের স্নেহের ডাকে লখিন্দর।

লখিন্দরকে কোলে করে এসে দাড়ালেন সুনুকা রাজ-জ্যোতিষীর কাছে। কুষ্ঠি-ঠিকুজি গণনা করে জ্যোতিষী ঘোষণা করলেন,”এই শিশুটি মহা ভাগ্যবান, অদৃষ্টলিপিতে দেবযোগ প্রবল।“ এমন দেবদুর্লভ কান্তিময় শিশুর জন্য এমনটাই তো হবার কথা।

মায়ের মুখে হাসি ভালভাবে ফুটে ওঠার আগেই জ্যোতিষী তাঁর বাক্য শেষ করলেন বজ্রাঘাতের মত সেই পুর্বনির্দিষ্ট শব্দচয়নে -” কিন্তু বিবাহ কালে বাসরঘরে রয়েছে সর্পদংশনে মৃত্যুযোগ!“


প্রাসঙ্গিক লেখা