দীর্ঘ সময় টানা বসে থাকলে মস্তিস্কের ক্ষতি হয়


জীবনের অনেক কাজের ক্ষেত্রেই যেমন ব্রেইনকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, ঠিক তেমনি আবার সেই কাজের জন্য দিনের বেশিরভাগ সময় আমাদের বসে কাটাতে হয়। হোক সেটা স্কুলে, অফিসে বা ছোটখাট ঘরোয়া কাজেও। কিন্তু গবেষকদের মতানুসারে আপনি যদি বেশিরভাগ সময় বসে কাটিয়ে থাকেন, আপনার সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। তারা বলেছেন, দিনের দীর্ঘসময় বসে কাটিয়ে দেওয়া আপনার ব্রেইনের কার্যকারিতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।। সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষনায় দেখিয়েছে তারা, কিভাবে এই বসে থাকা আপনার ব্রেইনের জ্বালানি (Fuel) সরবরাহে প্রভাব ফেলে কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

ব্রেইন হলো আপনার শরীরের গ্লুকোজ বা শ্বেতসার জাত শর্করা ভক্ষক। এটা আপনার শরীরের মোট ওজনের মাত্র ২ শতাংশ কিন্তু এটা প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার প্রায় ২০% ক্ষয় করে যার অধিকাংশই গ্লুকোজ রুপে। এটাকে বলা হয় ব্রেইনের মৌলিক জ্বালানি। যদি কোন কারনে এই জ্বালানি সরবরাহে বাধাগ্রস্ত হয়, তা আপনার ব্রেইনের সেলকে   দূর্বল করে ফেলে এমনকি সেলের ক্ষতিও করতে পারে। আর তাই ব্রেইনের সুস্থতা গ্লুকোজ সরবরাহে পর্যাপ্ততার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।

এক্ষেত্রে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশী বা কম হওয়া আপনার ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর যা স্মৃতিভ্রংশ (Dementia) এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। আবার গ্লুকোজের মাত্রার উঠানামাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।  High এবং Low এর মধ্যে গ্লুকোজের মাত্রার উঠানামা আপনার  জ্ঞান বা বুদ্ধিভিত্তিক সম্বন্ধীয় কার্যাবলি ( Cognitive Function) এর দক্ষতাকে কমিয়ে দেয়। এটাকে বলা হয় গ্লুকোজ ভ্যারিয়াবিলিটি (Glucose variability) । একারণে আপনার ব্রেইনের সুস্থতার জন্য গ্লুকোজের নিয়মিত পর্যাপ্ত সরবরাহ প্রয়োজন, যেটা খুব বেশীও না আবার কমও না।

ব্রেইন বা মস্তিষ্কে দীর্ঘ বা অতিরিক্ত সময় বসে থাকার প্রভাব

দীর্ঘসময় বসে থাকা মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এটা অনুমিত যে, আপনি যদি দিনে আট ঘন্টারও বেশি সময় বসে কাটিয়ে দেন কিন্তু প্রতিদিন ৬০-৭৫ মিনিট সময় পরিমিত থেকে কঠিন ব্যায়ামের পিছনে ব্যয় করেন, তাহলে এক্ষেত্রে আপনার মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যাবে। যদিও এটা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যপার। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের  যতটুকু সময় ব্যায়ামের পিছনে ব্যয় করতে বলেছিল, এটা প্রায় তার দিগুণ সময়। তবে এক্ষেত্রে আপনি যদি ব্যায়ামে এত সময় ব্যয় না করতে চান, বসে থাকার সময়টুকু কমিয়ে আনার চেস্টা করুন। স্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে এটা পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।

ইমেজঃ দ্য কনভারসেশন
বেশ কিছু গবেষণায় এসেছে যে, খাবার খাওয়ার পর পুনরায় আবার কাজ বা অন্যকিছুর জন্য বসে না পরে তার পরিবর্তে হালকা হাটাচলা  ব্রেইনের জন্য ভাল। এটা ব্রেইনের গ্লুকোজের প্রয়োজনীয় মাত্রা নিয়ন্ত্রনে বেশি কার্যকরী। এমনকি গ্লুকোজ ভ্যারিয়াবিলিটিকেও বেশি উঠা নামা থেকেনিয়ন্ত্রন করে। অন্যভাবে বলা যায়, হাটাচলার কারনে কর্মক্ষম মাংশপেশিগুলো  গ্লুকোজের কিছু অংশ ব্যবহার করে এটার সন্তোষজনক মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

একটানা কষ্টকর ব্যায়ামের চাইতে সারাদিন ধরে করা শারীরিক পরিশ্রম বেশী কার্যকরী।​​

গবেষণা এটাও প্রমাণ করেছে যে, গ্লুকোজ এর পর্যাপ্ত মাত্রা নিয়ন্ত্রনের জন্য সকালে একসাথে করা পরিমিত বা কঠিন ব্যায়াম থেকে অধিকতর ভালো সারাদিন ধরে করা হালকা কঠিন শারীরিক কার্যাবলি। এমনকি যদি আপনার হালকা কঠিন কাজগুলির জন্য ব্যয়িত শক্তির পরিমান, একসাথে করা বেশি কঠিন কাজের ব্যয়িত শক্তির সমপরিমানও হয়। সহজ কথায়, একটানা কষ্টকর ব্যায়ামের চাইতে সারাদিন ধরে করা শারীরিক পরিশ্রম বেশী কার্যকরী।

দীর্ঘ সময় বসে থাকা এবং আপনার ব্রেইনের কর্মক্ষমতা

অতিরিক্ত সময় বসে থাকার সাথে ব্রেইনের কার্যাবলি কিভাবে সম্পর্কিত এক্ষেত্রে গবেষণায় মিশ্র ফলাফল এসেছে। স্মৃতি বা মেধা সম্পর্কিত কাজগুলোতে একটানা দীর্ঘসময় বসে কাজ না করা ভালো। এসব কাজের মাঝে নিয়মিত বিরতিতে উঠে হাটাচলা করা বা কোন ধরনের পরিশ্রমের কাজ করা ব্রেইনের কার্যকারিতাকে বাড়িয়ে তুলে। তবে এটার উপর ল্যাবরেটরির গবেষণায় পক্ষে ও বিপক্ষে দুইধরনের ফলাফল এসেছে।

কয়েক বছর ধরে অনেক মানুষের উপর করা আরেকটি গবেষণায় দীর্ঘ সময় বসে থাকা ও ব্রেইন কার্যাবলির হ্রাসের মধ্যে সম্পর্ক খুজে পেয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন পরিমাপক ব্যবহার করার কারনে কোন একটি নির্দিষ্ট সিন্ধান্তে আসা কঠিন। সাধারনত, এসব গবেষণায় অংশগ্রহনকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহন থাকে বলে ফলাফল সবসময় সঠিক আসে না যা আবার অনেকসময় ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি মিলে না।

এগুলো তো গবেষণালব্ধ প্রমাণ। থিওরিটীক্যালি বা তাত্ত্বিকদিক দিয়েও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলোর ক্ষেত্রে আপনার ব্রেইনের কর্মক্ষমতার উপর হাঁটাচলার প্রভাব রয়েছে।  নিউ মেক্সিকোর হাইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা সেটার ব্যাখা  দিয়েছেন এইভাবে যে  হাঁটার সময় পা রক্তের শিরার মধ্যে দিয়ে প্রেসার ওয়েভস পাঠিয়ে ব্রেইনে রক্তের প্রবাহ (Blood flow) কে বৃদ্ধি করে। আর এই রক্তের প্রবাহ ব্রেইনে গ্লুকোজের সরবরাহ নিয়ন্ত্রক যা ব্রেইন হেলথের উপর প্রভাব ফেলে। যেমন- আমরা জানি যে  আলঝেইমারস এর মতো রোগের ক্ষেত্রে ব্রেইনে রক্তের প্রবাহ কমে গেলে সেটা খুব দ্রুত ব্রেইনের কর্মক্ষমতাকেও হ্রাস করে দেয়। 

আপনি কী করতে পারেন

নির্ভুল প্রমাণের অভাবে বিজ্ঞানীদের জন্য বসে থাকার সাথে ব্রেইনের কর্মক্ষমতার সম্পর্ক নির্ধারন অনেকটা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। কারন, কিছু নিরীক্ষণ দেখা গিয়েছে যে, বসে থাকার সময় কমালে সেটা ব্রেইনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলোর সক্ষমতা না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দিয়েছে। 

ব্রেইন হেলথ এবং বসে থাকা, একটির উপর আরেকটির প্রভাব নিরুপণের ক্ষেত্রে চুড়ান্ত গবেষণালব্ধ প্রমাণের অভাব থাকা সত্বেও, দীর্ঘ সময় বসে থাকাতে অনুৎসাহিত করা হয়েছে কেননা এটা গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রনকে দুর্বল করে স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি খাবার খাওয়ার পর একটানা বসে থাকা গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রনব্যবস্থাকেও দুর্বল করে দেয়। অতএব, খাওয়ার পর কিছুক্ষন হাঁটুন। প্রয়োজনে ডিনার শেষ করে ডিশ ওয়াশে পরিবারের অন্য সদস্যকে সাহায্য করুন। আপনি অনেক ভাবেই সারাদিন বসে না থেকে হালকা হাঁটাচলার মধ্যে যেমন কাজও করতে পারবেন তেমনি আপনার স্বাস্থ্যের উপর এটার পজেটিভ প্রভাভের সুফল ও ভোগ করতে পারবেন।​

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম অবলম্বন


প্রাসঙ্গিক লেখা