বিভিন্ন পুরাণে যৌনতা - ৪/১৪
সৃষ্টির শুরু থেকেই ‘ক্ষুধা’ বোধটির সাথে মানুষের পরিচয়। এ ক্ষুধা প্রাণ বাঁচানোর এবং প্রাণ সৃষ্টির। এ দুইয়ের মাঝে প্রাণ বাঁচানোর ক্ষুধাবোধ একেবারেই স্বাভাবিক ও সবার জন্য সমান। একই খাবার সবাই ভাগ করে নিয়ে খেতেও সেখানে কোন অসুবিধা নেই। তাই এ বোধকে নিয়ে কোন রূপক, উপমা কিংবা ভনিতার আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু যৌন ক্ষুধাটির রকমসকম আলাদা – সবাই মিলে ভাগ করে সেটা খাওয়া যায় না; বাছবিচার, পছন্দ-অপছন্দ, আড়াল ইত্যাদি অনেক কিছুই জড়িত এর সাথে। ফলে এ বোধের সাথে লজ্জা-দ্বিধা, আবার সময়ে শক্তি-ছলনা প্রভৃতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এর কারণে সূর্যের আলোর রাতের আঁধারকে ভেদ করা, কিংবা আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানিতে মাটির উর্বর ও ফলবতী হওয়া – এরকম আপাতসাধারণ ব্যাপার স্যাপারগুলোও লিঙ্গ বিভাজনের আওতায় এসে যায়। ফলে সূর্যের আলোর রাতের আঁধারকে ভেদ করার ক্ষমতা এবং আকাশের বৃষ্টিতে ভুমিকে সিক্ত করার ক্ষমতা বীর্যবান পুংলিঙ্গের সম্মান পায় ; পক্ষান্তরে আলোর কিরণবিদ্ধ রাত এবং বৃষ্টিসিক্ত ফলবতী ভূমি স্ত্রীলিঙ্গের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
সুর্যের তেজের বিদ্ধ করার ক্ষমতাটা সূর্যদেবের প্রতিভূ মিশরীয় ফারাওরা আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন যৌনশক্তির উদাহরণ হিসেবে।
এভাবেই বিভিন্ন লক্ষ্মণ মিলিয়ে প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে যৌনতা এসেছে স্বাভাবিকভাবেই, সে যুগের বা সময়ের প্রতিফলক হিসেবে। এর কিছু্কিছু মিশরীয় সমাজে প্রকাশ্যে পালিত হতেও দেখা যায়। যেমন সুর্যের তেজের বিদ্ধ করার ক্ষমতাটা সূর্যদেবের প্রতিভূ মিশরীয় ফারাওরা আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করেছিলেন যৌনশক্তির উদাহরণ হিসেবে। আর তাই ফারাও সম্রাটরা তাঁদের বাসর রাতের সফলতা প্রমাণের জন্য স্ত্রীর সতীচ্ছদের রক্ত মাখা সাদা কাপড় বাইরে এনে দেখাতেন। এগুলো স্ত্রীর কুমারীত্ব বা সতীত্ব প্রমাণের চেয়ে বেশি ছিল নিজের সূর্যবংশীয় পৌরুষ জাহির করা। কিন্তু মিশরীয় পুরাণে এর বাইরে আরো কিছু ব্যাপার এসেছে যা স্বাভাবিক যৌনতার বাইরে। যেমনটা আগের পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে মিশরীয় পুরাণে হস্তমৈথুনেরও উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার হল হস্তমৈথুন সহ যাবতীয় সব স্বাভাবিকতা বা বিকৃতির কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে - সৃষ্টির তাগিদকে!
সুপ্রাচীন হেলিওপোলিটান পুরাণের মতে, দেবতা আটুম ( Atum / Atem / Tem ) হলেন সর্বপ্রথম দেবতা এবং রা-এর প্রতিরূপ। ইনি স্বয়ম্ভু, অর্থাৎ তাঁর কোন পিতামাতা নেই, নিজেই নিজের স্রষ্টা। “বুক অব ডেড” ( Book of Dead ) মতে আটুমের উদ্ভব হয়েছিল সৃষ্টির আদিতে এক ‘বিশৃংখল জলরাশি’ ( Nun, the Chaos) থেকে। তিনি অন্য সকল দেবতা ও সৃষ্টির প্রভু।
আটুম ঘোষণা করেন, “আমি স্বয়ং নিজের মাধ্যমে সব সৃষ্টি করেছি। আমার পবিত্র হাতটিকে আমি স্ত্রী করেছি। তারপর আমার পবিত্র হাতের সাথে শিশ্নের সঙ্গম করেছি।”
অর্থাৎ, দেবতা আটুম পবিত্র হস্তমৈথুনের মাধ্যমেই সকল সৃষ্টিকার্য সমাধা করেছেন। এভাবেই তিনি জন্ম দেন জমজ দেবদেবী শু (shu) এবং তেফনাতের (Tefnut)। এই জমজ ভাইবোন শু আর তেফনাতের সন্তানেরা হলেন আইসিস, ওসিরিস, সেট প্রমুখ দেবতারা।
দেবতা আটুমের সেই সৃষ্টিশীল কীর্তির সম্মানে তখনকার ফারাওদের বছরের একটি বিশেষ সময়ে নীলনদে হস্তমৈথুন করাটা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কোন কোন মিশরীয় পুরাণবেত্তার মতে আটুম নিজের ছায়ার সাথে সঙ্গম দ্বারাই শু এবং তেফনাতের জন্ম দিয়েছিলেন।
এই যে আপন দুই ভাই ওসিরিস আর সেট, এদের শত্রুতার নেপথ্য কারণও আর কিছু না – যৌনতা, পরকীয়া। সেটের বোন এবং স্ত্রী ( sister-wife / bride-sister ) মরুর দেবী নেপথিস ( Nephthys ) ছিলেন সন্তানহীনা। একবার তিনি ভাবলেন সম্ভবত স্বামী-ভ্রাতা সেটের দোষেই তাঁর সন্তান হচ্ছে না।
সন্দেহ দূর করতে আর সুদর্শন ভাই ওসিরিসের রূপে কামমোহিত হয়ে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে প্রচুর মদ খাইয়ে মাতাল করে নিলেন এবং তাঁর সাথে সঙ্গম করলেন। মাতাল অবস্থায় ওসিরিস তাঁর মালাখানি বিছানায় ফেলে যান। সেট যখন তার শয্যায় ওসিরিসের গায়ের মালা খুঁজে পা্ন, তখন তিনি ঘটনাটি বুঝে ফেলেন। কিন্তু এ ঘটনার জন্য সেট ওসিরিসকে দায়ী ধরে নেন।
আবার যখন ওসিরিসের ঔরসে নেপথিস এক পুত্রের ( মমির দেবতা শেয়ালমুখো আনুবিস ) জন্ম দেন, সেটের এ ক্রোধ ব্যক্তিগত অপমানে রূপান্তরিত হয়। তখন থেকেই ওসিরিসের উপর প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। আর জন্ম হয় সেই অন্তহীন শত্রুতার।
স্বমেহনের পাশাপাশি দেবসমাজে সমকামিতার নিদর্শনও আছে মিশরীয় পুরাণে। পিতা ওসিরিসের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সংকল্প সারাক্ষণ অস্থির করে রাখত হোরাসকে আর অন্যদিকে ভাই ওসিরিসের বংশের দুর্নাম করার চিন্তায় ডুবে থাকত সেট। এদের লড়াই এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, যুদ্ধে হোরাস এক চোখ হারান এবং সেট হারান তাঁর অন্ডকোষ। তারপরেও বিরোধ থামেনি।
এ দু’জনের শত্রুতা পিতামহ রা-কে অস্থির করে তোলে। তিনি এদের দু’জনকে বিবাদ ভুলে এক হবার আদেশ দেন। এর প্রেক্ষিতে এক সন্ধ্যায় সেট হোরাসকে দাওয়াত দেন এবং রাতে মাতাল সেটের মনে আবার কুবুদ্ধি চাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি শয্যায় যান হোরাসকে ধর্ষণ করতে। হোরাস ঠিক সময়ে জেগে উঠেন এবং সেটের বীর্য হাত দিয়ে আটকে দেন। অসম্মানিত হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও অপমানের যন্ত্রনায় কাঁদতে কাঁদতে পরে সেখান থেকে হোরাস চলে আসেন মা আইসিসের কাছে।
আইসিস এর প্রতিশোধ নেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি হোরাসের লিঙ্গে এক শক্তিশালী মলম মাখিয়ে দেন এবং তাঁকে স্বমেহন করে বীর্যকে একটা পাত্রে জমিয়ে রাখতে বলেন। মলমের প্রভাবে অনেক বীর্য জমা হয়। সে বীর্য আইসিস সেটের বাগানে সব কয়টা লেটুস পাতার উপরে মাখিয়ে রাখেন। তিনি জানেন প্রতিদিনের প্রাতরাশের টেবিলে সেটের প্রথম খাওয়াই হল তাজা লেটুস পাতা। পরদিন সকালে সে লেটুস মুখে দেয়া মাত্র বীর্য সেটের মুখে ভেতরে-বাইরে লেগে যায় এবং খবর ছড়িয়ে পড়ে সেটের মুখে হোরাস বীর্য ঢেলে দিয়েছেন। অর্থাৎ হোরাস সেটকে তার লিঙ্গমেহনে বাধ্য করেছেন। ফলে চিরদিনের জন্য সেট দেবসমাজে কালিমালিপ্ত হয়ে যান। এভাবে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিলেন হোরাস।
যেহেতু লেটুস পাতার কথা এসে গেল, দেবতা মিনের কথা আসবেই। লেটুস আর পিঁয়াজ ছিল প্রাচীন মিশরের কামোদ্দীপক খাবার। উর্বরতার দেবতা মিন (Min) বা খেম (Khem)-এর প্রিয় খাবার ছিল এই তাজা লেটুস - যেগুলো একটু লম্বা আর রসালো, চিপলে দুধের মত রস বের হয়। প্রাচীন মিশরের যৌন দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন মিন। সবচে’ আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর মূর্তিটি। দেবতা মিনের প্রতীক ছিল - বাম হাতে ধরে থাকা উত্থিত এক বিশাল পুরুষাঙ্গ।
তিনিই ছিলেন মিশরীয় পুরাণের প্রথম প্রকাশ্য লিংঙ্গপ্রদর্শনাকারী দেবতা।
এছাড়াও মিশরীয় উচ্চারণে ক্বাতিশা ( Qetesh / Kadesh ) নামে এক যৌনদেবীর অস্তিত্বও আমরা পাই প্রাচীন পুরাণে। ইনি এসেছিলেন কানানবাসীদের স্থানিয় ধর্ম থেকে, পরে মিশে গেছেন মিশরে। ‘পবিত্র যৌন উদ্দামতা আর যৌনানন্দ’ – এর দেবী ছিলেন তিনি। উত্থিত লিঙ্গধারী দেবতা মিনের পাশে সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে এক হাতে সাপ আর অন্য হাতে পদ্মফুল নিয়ে দন্ডায়মান অবস্থায় পূজিত হতেন এ দেবী।
পদ্মফুলের প্রসঙ্গ আসলো যেহেতু, বলে রাখা ভাল এটি সকল প্যাগান ধর্মেই যৌনতার প্রতীক। মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, গ্রিক, রোমান, এমনকি ভারতীয় পুরাণে দেবীদের হাতে পদ্মফুলের সমারোহ দেখা যায়।
পদ্মফুলের প্রসঙ্গ আসলো যেহেতু, বলে রাখা ভাল এটি সকল প্যাগান ধর্মেই যৌনতার প্রতীক। মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, গ্রিক, রোমান, এমনকি ভারতীয় পুরাণে দেবীদের হাতে পদ্মফুলের সমারোহ দেখা যায়। কখনো কখনো দেবতারাও পদ্মফুলের ছোঁয়ায় থাকতেন। পদ্মফুল বা লোটাসের ধর্ম হল এটি প্রকৃতির মূল পঞ্চভূতের মাঝে তিন ভুতকে ছুঁয়ে বেঁচে থাকে - এটি জন্মে মাটিতে, বেড়ে ওঠে পানিতে, পাপড়ি মেলে বাতাসে। সকল পুরাণে একে পবিত্র ফুল হিসেবে গণ্য করা হত। পাশাপাশি এটি ছিল নারী যৌনাঙ্গের প্রতীক। ভারতীয় পুরাণে এর পুংকেশরগুলোকে লিঙ্গের সাথে এবং পাপড়িকে যোনির সাথে তুলনা করা হয়েছে ; আর মিশরীয় ও গ্রিক পুরাণে পদ্মফুলের রাতে পাপড়ি বুঁজে থাকা আর ভোরের সূর্যের কিরণে এর পাপড়ি মেলে ধরাকে পুরুষের স্পর্শে যোনি উন্মুক্ত করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। মিশরে একে সেশেন (seshen) বলা হত।
উপকার কি অপকার জানি না, তবে যৌনতার কারণেই কিন্তু আমরা বছরে পাঁচটি বাড়তি দিন পেয়েছি ! কীভাবে ?
এই যে এখন আমাদের বছরে ৩৬৫ দিন, আগে এটি ছিল ৩৬০ দিন। সে সময় শু-এর কন্যা ন্যুট ( Nut ) ছিলেন রাতের আকাশের দেবী এবং শু-এর আরেক পুত্র গেব ( Geb ) ছিলেন পৃথিবীর দেবতা। ন্যুট এবং গেব – এ দুই ভাইবোন পরস্পরের প্রেমে পড়েন এবং তাঁদের নিয়মিত মিলন ঘটতে থাকে। পিতামহ রা এই ঘটনা জানতে পেরে দারুণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি শু-কে আদেশ দেন এদের পৃথক করে দিতে। শু-এর আদেশে বায়ু দেবতা গেবের দায়িত্ব কেড়ে নেন এবং ন্যুটকে আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যান। এদিকে ন্যুটের গর্ভবতী হবার লক্ষ্মণ প্রকাশ পেলে রা তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেন,” আমি অভিশাপ দিচ্ছি – আমার নির্ধারিত বছরের ৩৬০ দিনের কোন একটি দিন তোমার এ সন্তানের জন্মের দিন হবে না।“
অসহায় ন্যুট ধর্ণা দিলেন থোথের কাছে। দেবকূলে তিনিই সবচে’ বুদ্ধিমান। ন্যুটের কান্নায় দ্রবীভূত থোথ চালাকি করলেন চন্দ্রদেব খোনসুর ( Khonsu ) সাথে। নৈশ ভোজের আসরে বসে তিনি কথায় কথায় খোনসুর ক্ষমতা দেখতে চাইলে চন্দ্রদেব আগপর না ভেবে তাঁর কিরণকে বাড়িয়ে কমিয়ে আপন ক্ষমতার জাহির করে দিলেন। ব্যস, এটুকুই দরকার ছিল থোথের। চাঁদের আলোর এই বাড়তি কমতিটুকু প্রয়োজনমত ব্যবহার করে তিনি আরো পাঁচটি নতুন দিন সৃষ্টি করেন। তারপর এই বাড়তি পাঁচ দিন যুক্ত করে দিলেন বছরের সাথে এবং এগুলো রা-এর শাপমুক্ত।
( “বুক অব ডেড” মতে, থোথ এই বাড়তি ৫টি দিন বাজী ধরে রা-এর কাছ থেকে খেলে জিতে নেন। তা ঘটনা যাই হোক, মূলে ঐ যৌনতা।)
এই পাঁচদিনে ন্যুট জন্ম দেন তাঁর পাঁচ সন্তান – ওসিরিস, আইসিস, সেট, নেপথিস এবং হোরাস (ইনি সিনিয়র হোরাস, আইসিস-ওসিরিসের সন্তান হোরাস নয়)। আর আমরা পেলাম ৩৬৫ দিনের বছর।
এরকম আরো অনেক বিচিত্র কাহিনি আছে মিশরীয় পুরাণে যা যৌনতাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে। সবচে' বিষ্ময়ের ব্যাপার, রাজনৈতিক কারণেও সেখানে বিভিন্ন দেবতার আবির্ভাব ঘটেছিল, শুরু হয়েছিল প্রাণিপূজাও ! এগুলো পালিত হত মহা সমারোহে, কখনো শোভাযাত্রা সহকারে, কখনো পিরামিডের ভেতরে।
চলুন তাহলে, আমরাও ঢুকে পড়ি মিশরের আরো ভেতরে ..... পিরামিডের গহ্বরে।