যে উদ্ভাবনগুলো বদলে দিয়েছে সভ্যতা - ২
মানব সভ্যতার আবিষ্কার বা উদ্ভাবনগুলোর ইতিহাস লিখতে গিয়ে যে ব্যাপারটা সবচাইতে বড় সমস্যা তৈরি করে সেটা হচ্ছে আবিষ্কারের সময়ের অনিশ্চয়তা। পাথরের তৈরি বিভিন্ন যন্ত্র ছাড়া বাদবাকী সকল যন্ত্রই মাটির সাথে এমনভাবে মিশে যেতে পারে যে দশ থেকে বিশ হাজার বছর সেগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তথাপিও গবেষকরা বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে পাওয়া বস্তুগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এর সময় নিরূপণ করে যাচ্ছেন। এভাবে কোন একটি জিনিষের বয়স এখন পর্যন্ত যত বেশী পাওয়া গিয়েছে, সেটাকেই ওটার প্রাথমিক আবিষ্কারের সময় ধরে নেয়া হয়। মানব সভ্যতা বদলে দেয়া এক হাজার উদ্ভাবন জানানোর উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় পর্বে আজকে আমরা হাজির হয়েছি আরো পাঁচটি উদ্ভাবন নিয়ে।
বড়শি (Fishhook)
বড়শির সাথে কমবেশী সকলেই পরিচিত। আজকের দিনেও বড়শি দিয়ে মাছ ধরার অভিজ্ঞতা অনেকের রয়েছে। আমাদের জানা ইতিহাসে খৃষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার পূর্বেও এই বড়শির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় তারও আগে থেকে মানুষ বড়শি তৈরি করে সেটা দিয়ে মাছ ধরেছে। বিভিন্ন ধাতু (যেমন ব্রোঞ্জ লোহা, তামা) আবিষ্কারের আগে মানুষ কাঠ, হাড়, পশুর শিং, শক্ত খোলস (শেল) ব্যবহার করে বড়শি বানাতো। ধারণা করা হয় মানুষ সর্বপ্রথম গাছের ডাল/কাঠ দিয়ে বড়শি তৈরি করে। মজার ব্যপার হলো ১৯৬০ সালেও এরকম কাঠের তৈরি বড়শির নজীর আছে।
মানুষ যখনই প্রথম বড়শি তৈরি করে থাকুক না কেন, এটা মানব সভ্যতাকে অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে।যেহেতু পৃথিবীর তিন ভাগের দুই ভাগই পানি সেহেতু পানির নিচের এই প্রোটিন ভাণ্ডার মানুষের কাছে আরো বেশী উন্মুক্ত করতে বড়শির বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
টালি স্টিক (Tally Stick)
দক্ষিণ আফ্রিকা ও সুইজারল্যান্ডের মাঝামাঝি অবস্থিত লেবম্বো পর্বতমালায় বেবুনের হাড়ের তৈরি এক প্রকার স্টিকের মত বস্তু পাওয়া যায় যাতে নানারকম দাগ কাটা ছিলো। এগুলোর বয়স খৃষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বছর। ধারণা করা হয় চন্দ্রমাস গণনা ও সাধারণ হিসাব রাখার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে কাঠ ব্যবহার শুরু হয় টালিস্টিক হিসেবে যা কয়েক শতক পূর্বেও ব্যবহার করা হয়েছে। মধ্যযুগে ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিলো এই টালি স্টিক। ১১০০ শতকে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম কিং হেনরী রাজকোষে কর ব্যবস্থাপনার কাজে টালি স্টিক ব্যবহার শুরু করেন। নানারকম নকশা কাটা হ্যাজেল কাঠের ছোট ছোট খণ্ডকে দুই ভাগ করে নিয়ে এই স্টিক তৈরি করা হতো যার অর্ধেক থাকতো রাজার নিজের কাছে বাকীটুকু রাজকীয় হিসাব নিকাশে ব্যবহার করা হতো। জালিয়াতি ঠেকানোর জন্য এটা করা হতো। এটিকে বৃটেনের প্রাথমিক দিকের মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরে ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড শুরু হওয়ার পর টালি স্টিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। কম্পিউটারে ইতিহাসেও এই টালি স্টিককে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। অ্যাবাকাস আবিষ্কারের আগেই টালিস্টিক আবিষ্কৃত হয়েছিলো।
ড্রিল বা ফুটো করার যন্ত্র (Drill Machine)
কোথাও ফুটো করার জন্য বাজার থেকে এখন যেকেউ ইলেকট্রিক ড্রিল মেশিন কিনে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই ড্রিল মেশিন সেই খৃষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বছরেরও আগে মানুষ তৈরি ও ব্যবহার করা শুরু করেছিলো? কাঠ, পশুর চামড়া, হার, পাথরে ফুটো করার জন্য মানুষ নানা ধরনের ড্রিল মেশিন তৈরি করা শুরু করে। পরবর্তীতে মিশরীয়রা এই ড্রিল মেশিনের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে। এমনকি খৃষ্টপূর্ব ৯ হাজার বছর আগে দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহার উপযোগী ড্রিল মেশিন তৈরি করতে শুরু করে মানুষ।
বিভিন্ন ধাতু আবিষ্কার করার পর সেগুলো ফুটো করা, কাটা ইত্যাদি কাজে ড্রিল মেশিনের ব্যাপক ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। এসব ড্রিল করার যন্ত্রের মাথায় ড্রিল পিট হিসেবে ধারালো পাথর থেকে শুরু করে চোখা করে নেয়া হার ও কাঠও রয়েছে। আধুনিক যুগে ড্রিল পিট হিসেবে খুব শক্ত হাই-কার্বন স্টিল ব্যবহার করা হয় যেগুলো দিয়ে অনেক কঠিন বস্তুও ফুটো করা সম্ভব। এমনকি পৃথিবীর বুকে ফুটো করে খনিজ পদার্থ আহরণ করার মত ড্রিল মেশিনও মানুষ তৈরি করেছে এবং অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে।
ড্রিল মেশিন উদ্ভাবন করার ফলে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ও যান্ত্রিক কৌশল সহজেই মানুষের আয়ত্বে আসে। একারণে, এটিকে মানব সভ্যতার অন্যতম বড় একটি উদ্ভাবন হিসেবে দেখা হয়।
ধারালো পাথরের ব্লেড (Sharp Stone Blade)
পৃথিবীর জানা ইতিহাসে পাথরের তৈরি জিনিষ পত্র ব্যবহারের নজীর দুই মিলিয়ন বছর আগেও মেলে। কিন্তু এটা ঠিক পরিষ্কার নয় কবে থেকে মানুষ পাথরকে ধারালো করে ব্লেড হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছে। গবেষকরা এখন পর্যন্ত খৃষ্টপূর্ব ৩০ হাজার বছর আগের এধরনের ব্লেডের দেখা পেয়েছেন।
যে পদ্ধতিতে পাথরকে এভাবে ধারালো করা হয়, তা লিথিক রিডাকশন (lithic reduction) নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে আরেকটি পাথর বা কাঠ দিয়ে পাথরটার গায়ে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলা ধারালো অংশটুকুকে ব্যবহার করা হয়। এই ধারালো পাথর খণ্ডগুলো হার, কাঠ ও বিভিন্ন বস্তুর সাথে জুড়ে দিয়ে ছুরি, বর্শা, তীর ও নানারকম অস্ত্র তৈরি করা হতো। এসব কাজে মূলত চকমকি পাথর বেশী ব্যবহার করা হতো কারণ ওটি অনেক শক্ত এবং সহজে ভেঙ্গে যেত না।
এই ধারালো পাথরের ব্লেডগুলো মানুষকে শিকার ও নানাধরনের যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যপকভাবে সাহায্য করেছে। মানুষের এগিয়ে চলার পথে এটাও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ছিলো।
সেলাই (Sewing)
মানুষ পোষাকের ব্যবহার শুরু করে প্রায় চারলক্ষ বছর আগে। কিন্তু সেলাই বা সূচীকর্মের নজীর পাওয়া যায় খৃষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বছর আগে। ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে এবং রাশিয়ার মস্কোর কাছাকাছি সূই পাওয়া যায় যেগুলোর বয়স খৃষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বছর। হাতির দাঁত ব্যবহার করা হয়েছিলো এগুলো বানাতে।
সুই এবং সেলাই মানব সভ্যতায় পোষাক শিল্পের ব্যপক উৎকর্ষ সাধন করে। একইসাথে বিভিন্ন সজ্জা ও পরিবহনের কাজে পশুর চামরা ও বিভিন্ন জিনিষের তৈরি ব্যাগ তৈরিতে সমর্থ হয় মানুষ। পশুর দাঁত, শক্ত বীজ ও মাছের কাটা এভাবে সেলাই করে ডেকোরেশনের কাজে লাগানোর নজীর পাওয়া যায় ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ডে। আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদের কাছেও সেলাইয়ের প্রযুক্তি পাওয়া যায়। তারা বিভিন্ন গাছের পাতা, পাখির পাখা সেলাই করে নানা ধরনের পোষাক ও সাজ-সজ্জা তৈরি করতো।
প্রথম ধাতব সূই তৈরি করা হয় ব্রোঞ্জ এজে, খৃষ্টপূর্ব ২০০০ থেকে ৮০০ এর ভেতরে। উত্তর আফ্রিকা এবং চীনে এযুগের কিছু সূই পাওয়া গিয়েছে। এমনকি বোতামের জন্য তৈরি বাটনহোল আবিষ্কার হয় খৃষ্টপূর্ব ৪২০০ সালে। খুব জটিল ধরনের সেলাই কাজ (Eg. Embroidery)-র নমুনা প্রথম পাওয়া যায় ব্রোঞ্জ এজের প্রাচীন মিশর ও ভারতবর্ষে। একই সময়ে চীনাদের রেশমি কাপড়ের নমুনা মেলে।