বিভিন্ন পুরাণে যৌনতা - ৩/১৪
পৃথিবীর আদিমতম ধর্মগুলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে সবচে’ প্রাচীন যে দেবতা আর পূজার অস্তিত্ব সকল ধর্মেই পাওয়া যায়, তা হল সূর্য দেবতা এবং যৌনপূজা। দেবতাদের নাম ছিল ভিন্ন, স্বভাবে এক। যেমনঃ হিন্দুশাস্ত্রে সূর্যদেব (Surya) হলেন আর্যদের উপাস্য দেবতা, গ্রিকদের সূর্য দেবতা হেলিওস (Helios) যিনি কিনা আরেক সূর্যদেবতা এপোলোর বহু আগে থেকেই ছিলেন, মিশরীয়দের সূর্যদেব রা (Ra / Re), ইনকাদের ইন্টি (Inti), অ্যাজটেকদের টোনাতিউ (Tonatiuh), মেসোপটেমিয়ায় উতু বা শামাস (Utu / Shamash), পার্শিয়ান বা ইরানীদের ছিলেন মিথরাস(Mithras) ইত্যাদি। নর্স, আফ্রিকান ইত্যাদি পৌরাণিক ইতিহাস আগেরগুলোর তুলনায় বেশ পরের বলে কথা এখানে আপাতত উল্লেখ করলাম না।
অন্যান্য দেবদেবী বা পূজায় জাতি-দেশ-পরিবেশ-সংস্কৃতি ভেদে ভিন্নতা থাকলেও যেহেতু একই সুর্য আর তার তেজ সবার মাথার উপরে ছিল, তাই সূর্যের পূজা সব ধর্মেই পাওয়া যায় আদি পূজা হিসেবে। যৌনতার ক্ষেত্রেও একই ব্যাখ্যা কার্যকর। মরুভূমির বা বরফাচ্ছাদিত এলাকার মানুষ কৃষিকে আশ্রয় করে বেঁচে উঠেনি ; আবার উর্বর সমতল ভুমির এলাকার মানুষদের কখনোই বালু বা বরফের জন্য প্রাণপাত করার প্রয়োজন পড়েনি। তাই মরুর দেবতা বা তুষার দেবতার পূজা সব জায়গায় বা ধর্মে দেখা যায় না।কিন্তু যৌনতার পরিচয় ও প্রয়োজন সর্বত্র বিরাজমান, সর্বদাই বিদ্যমান। তাই একে কেন্দ্র করে সব প্রাচীন ধর্মে দেবতা এবং পূজা সৃষ্টি হয়েছে। এর কিছু এসেছে অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কার থেকে, কিছু কল্পনা আর ভয় থেকে, কিছু নিঃসন্দেহে গোত্রপতি-কুলগুরু-পুরোহিতদের ব্যক্তিগত লালসার উপায় থেকে। এগুলোর কোনকোনটির ব্যাপারে প্রামাণিক তথ্য পাওয়া গেলেও লিঙ্গ বা যৌনপূজার ব্যাপারে কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে নি যে কোথা থেকে এর উদ্ভব। তবে অধিকাংশের মতে প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ থেকেই এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে বিভিন্ন ধর্মে।
যৌনপূজার উদ্ভব যে কোথায় আগে হয়েছিল, তা সুনিশ্চিত না হলেও এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে সূর্যপুজা আর যৌনপূজা প্রায় সমসাময়িক। আলো বা প্রখর তেজের কারণে আর উর্বরতার প্রতীক হিসেবে সূর্যপূজার শুরু। আর এর প্রায় সাথেই পশুপাখি বিশেষ করে সর্পপূজাও আরম্ভ হয়। সর্পপূজা যৌনপূজারও এক অংশ। প্রাচীন ধর্ম প্রচলিত ছিল এমন প্রতিটা দেশেই সর্পপূজা চালু ছিল। ভারতবর্ষে তো সঙ্গমরত সাপের ‘জোড়-লাগা’ একটি অতি ব্যবহৃত শব্দ। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, এমনকি এখনও আছে যে, যেখানে এই মৈথুন ঘটেছে সেখানকার মাটি বা ধুলা কাপড়ে বেঁধে নিয়ে কোমড়ে রাখলে সে পুরুষ প্রচন্ড যৌনশক্তির অধিকারী হয়। প্রায় সাত হাজার বছর আগের সুমেরে পৃথিবীর প্রথম লিখিত ভাষা ক্যুনিফর্মের (Cuneiform) মাটির ফলকে সাপের বন্দনা আছে। মিশরের মঙ্গলের প্রতীক ছিল উদ্যত ফণার সাপ। যদিও প্রতীক হিসেবে ভারত, ইউরোপ আর মেক্সিকোতে সেটা আবার ছিল অমঙ্গলের সাথে সম্পর্কিত।
আরেক পশু ষাঁড়ের উপাসনাও যৌনপূজার সাথে সম্পর্কিত। এটাও খুব সম্ভবত ভারত থেকেই গেছে মিশরের এপিসের পূজায়। ইউরোপার গল্পের সাথেও ষাঁড় জড়িয়ে আছে। ষাঁড় বলিষ্ঠ কামের প্রতীক। মিশরে অবশ্য পশুপাখির প্রতিকৃতি নিয়ে যৌনপূজার আগেই সরাসরি চালু হয়েছিল লিঙ্গপূজা। এখন সেসব নিয়েই কথা বলব আমরা। মিশরীয় পুরাণ যেহেতু বহু প্রাচীন, তাই এটা দিয়েই শুরু করি।
প্রাচীন মিশরীয় জীবনে যৌনতা ছিল একেবারেই খোলামেলা আর সাধারণ ব্যাপার। ভাই-বোনের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তো ছিলই, এমনকি অন্য নিষিদ্ধ সম্পর্কেও তারা জড়াতে দ্বিধা করত না। সামাজিক রীতিনীতি এতটাই যৌনকাতর হয়ে পড়েছিল যে, প্রয়োজনের তাগিদে আর নিষিদ্ধ সম্পর্কের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং গর্ভপাত দুইই ব্যবহার করত। সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তারাই আবিষ্কার করেছিল।
প্রাচীন প্যাপিরাসে তাদের অনেক চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ তৈরিতে কুমিরের মল ব্যবহার করার কথা পাওয়া যায়। আরেক জনপ্রিয় ব্যবস্থা ছিল দু’তিন বছরের জন্য স্থায়ী জন্মরোধের। একাজে তারা প্রথমে বাবলা গাছের বিচি খেজুর গুঁড়ার সাথে মধু মিশিয়ে শুকিয়ে নিত। তারপর তুলাবীজের গুঁড়া এর সাথে মিশিয়ে একটু ভিজিয়ে এটাকে ঢুকিয়ে দিত যোনিপথে। ব্যস, দু’তিন বছরের জন্য ব্যবস্থা হয়ে গেল স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণের।ফলে অবারিত হয়ে গেল বৈধ-অবৈধ সব যৌনসম্পর্কের দ্বার আর বন্ধ হয়ে গেল গোপন সম্পর্কের কথা ছড়িয়ে যাবার ভয়।
যেহেতু এটি বাস্তবসত্য যে, পুরাণ থেকে জাতি তৈরি হয় না, বরং জাতি পুরাণ তৈরি করে, কাজেই প্রাচীন মিশরীয় জাতির জীবনযাত্রার ছাপ তাদের পুরাণে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। শুধু প্রশ্ন হল – কিভাবে তাদের পুরাণ এই যৌনতাকে আশ্রয় বা বৈধতা দিয়েছিল?
যেহেতু এটি বাস্তবসত্য যে, পুরাণ থেকে জাতি তৈরি হয় না, বরং জাতি পুরাণ তৈরি করে, কাজেই প্রাচীন মিশরীয় জাতির জীবনযাত্রার ছাপ তাদের পুরাণে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। শুধু প্রশ্ন হল – কিভাবে তাদের পুরাণ এই যৌনতাকে আশ্রয় বা বৈধতা দিয়েছিল? উত্তর আছে প্রাচীন মিশরের সবচে’ জনপ্রিয় পুরাণের কাহিনি আইসিস-ওসিরিসের প্রেমকথার মাঝে। এটি ছাড়াও আরো বহু আছে মিশরীয় পুরাণের যৌনাবেদনমুলক কাহিনি, তবে এ কাহিনির সাথে জড়িয়ে আছে মিশরের লিঙ্গপূজার ইতিহাস। আসুন, শুরু করা যাক।
পরকালের বিচারক, শস্য ও পূণর্জন্মের দেবতা, মৃতপুরীর রাজা এবং পরজন্মের দেবতা হলেন ওসিরিস(Osiris)আর আইসিস (Isis) হলেন মাতৃত্বের, জাদুবিদ্যার এবং রোগ নিরাময়ের দেবী। আইসিস এবং ওসিরিস সম্পর্কে আপন ভাইবোন এবং জমজ। পুরাণে আছে, মাতৃজঠরে থাকতেই ওসিরিস তাঁর বোন আইসিসকে ভালবেসে ফেলেন। পরে তাঁরা বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী হন।
ওসিরিস যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার দু’দিন পরে জন্ম নেন তার ভাই - মরুভূমি, বিশৃংখলা এবং ঝড়ের খারাপ দেবতা - সেট (Seth)। দু’ভাই সব দিক থেকেই পরস্পরের উল্টো। ওসিরিসের ত্বক ছিল কালচে যা মিশরের উর্বর মাটির প্রতীক; আর সেটের মুখ লাল এবং ত্বক মিশরের প্রাণহীন মরুভূমির মত ফ্যাকাশে। সেটের প্রতিকৃতি বিভিন্ন প্রানী যেমন শুকর, গাধা, জলহস্তী বা ওকাপি ইত্যাদি বিভিন্নভাবে বিবেচিত হয়।
মিশরের প্রথম ফারাও সূর্যদেবতা রা (Ra/Re) বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তিনি সূর্যের নৌকা বেয়ে স্বর্গে চলে যান। তারপর থেকে ওসিরিস সিংহাসনে বসেন। তাঁর সুশাসনে সবাই খুশি। শুধু খুশি নন তাঁর ভাই সেট। একবার ওসিরিস সবাইকে কৃষিকাজ শেখানোর জন্য পৃথিবী ভ্রমণে বের হলেন। তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজ্য পরিচালনা করছিলেন তাঁর স্ত্রী আইসিস।
সে সময়ে সেট গোপনে খুব সুন্দর নকশাদার কফিনের মত এক বাক্স তৈরি করলেন। সোনা, রুপা আর গাঢ় নীল লাপিস লাজুলি খচিত দারুণ জাঁকজমকপূর্ণ বাক্সটা ছিল ওসিরিসের মাপে তৈরি। ওসিরিস রাজ্যে ফিরে এলে তাঁর সম্মানে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করা হয়। সেখানে সেট বাক্সটি হাজির করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন সভাস্থ যে ব্যক্তির দেহের মাপ এ্রর সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে, সেই হবে এ মহামূল্যবান বাক্সের মালিক। সবাই চেষ্টা করল, কিন্তু কারো মাপই ঠিক হয় না। সবশেষে ওসিরিস শুয়ে পড়লেন। একেবারে পুরোপুরি মাপমত মিলে যেতেই দড়াম করে সেট কফিনটার ডালা বন্ধ করে দিলেন। আর সেটের ৭২ জন অনুসারীরা গলিত সীসা ঢেলে সেটাকে চিরতরে আটকে দিয়ে নীল নদে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কফিনটি তলিয়ে যাবার সাথেই নিভে গেল ওসিরিসের জীবন।
সেট মিশরের সিংহাসন দখল করে নিলে আইসিস পালিয়ে যায় নীলের পাশে এক গভীর বনে। সেখানে তিনি জন্ম দিলেন ফ্যালকন বা ঈগল পাখির মাথাওয়ালা দেবতা হোরাসের যিনি পরবর্তীতে রাজপদ নির্বাচন, যুদ্ধ, শিকার এবং আকাশের দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন। এদিকে মৃতদেহ সৎকার না করলে আত্মা পরকালে যেতে পারবে না, তাই আইসিস বের হলেন স্বামীর মৃতদেহের সন্ধানে। বহু খোঁজাখুঁজির পর সে কফিনের সন্ধান পাওয়া গেল লেবাননে। ছোটছোট বাচ্চারা ভেসে আসা কফিনটা খুঁজে পেয়ে সেটাকে এক ঝাউ গাছের নীচে লুকিয়ে রেখেছে। তারপর নানা ঘটনার পর আইসিস কফিনটি এবং স্বামীর দেহ হাতে পান। তিনি দেহটিকে লুকিয়ে নিয়ে আসেন মিশরে ছেলেকে দেখানোর জন্য। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেট তা জেনে ফেলেন এবং লাশটিকে কেড়ে নিয়ে কেটে ১৪ টুকরো করে চারদিকে ছড়িয়ে দেন। অনেক কষ্ট করে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় আইসিস ১৩টি টুকরো একত্রিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু ওসিরিসের লিঙ্গটি কোথাও পাওয়া গেল না। কারণ সেটি গিলে ফেলেছিল নীল নদের পবিত্র মাছ অক্সিরাইঙ্কাস (Oxyrhynchus)। তখন আইসিস স্বামীর মৃতদেহের অন্যান্য অংশগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরকালে প্রেরণের জন্য আনুবিস আর থোথের শরণাপন্ন হন।
মৃতদেহ সৎকারের দেবতা এবং সমাধিক্ষেত্রের রক্ষক দেবতা আনুবিস (Anubis) আর লেখন পদ্ধতির আবিস্কারক জ্ঞানী থোথ (Thoth) ওসিরিসের দেহকে মমি করে ফেলেন। এটাই হল পৃথিবীর প্রথম মমি। এদিকে হারিয়ে যাওয়া লিঙ্গের প্রতিমূর্তি হিসেবে ডুমুর কাঠের এক বিশাল লিঙ্গ তৈরি করা হয় এবং সেটাকে সম্মান জানাতে আইসিস নির্দেশ দেন। সে কাঠের লিঙ্গ হয়ে ওঠে দেবতা ওসিরিসের প্রতীক। আর এর মাধ্যমেই প্রাচীন মিশরে লিঙ্গপূজার উদ্ভব।
তবে একথা সত্যি যে, আইসিস নিজে কিন্তু ওসিরিসের লিঙ্গটিকে যৌনপূজার প্রতীক হিসেবে হাজির করেন নি। অন্যান্য ধর্মের মতই এখানেও এ দায়িত্বটুকু ভন্ড লোলুপ পুরোহিতরাই পালন করেছিলেন। নাহলে, দেশের সবচে’ কাম্য সুন্দরী তরুণীদের ভোগের উদ্দেশ্যে মন্দিরের সেবাদাসী করার আর উপায় কী?
যা হোক, এতটা সময় ধরে পুরাণে যৌনতা শুনতে শুনতে যারা অভ্যস্থ বা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, তাদের জন্য নতুন শব্দ নিয়ে আসছি এবার। তা হল - স্বমেহন এবং সমকামিতা।
জ্বি, এগুলোও যথেষ্ট করেছেন মিশরীয় প্রাচীন দেবতারা। এবং এগুলোর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কত কত ঘটনা ! বড় বিচিত্র আর মজাদার আখ্যান একেকটা !
বলছি শুনুন ..................