মানুষের সাথে যোগাযোগ
“যখন রোমে থাকবেন, রোমানদের মতই আচরণ করুন।“ , প্রচলিত এই কথাটি আপনি হয়ত শুনে থাকবেন। আর তাই, অপরিচিত কোন জায়গাতে স্থানীয় সম্প্রদায় বা লোকজনের সাথে মানিয়ে চলার, তাদের বিশ্বাস অর্জনের সবচেয়ে সহজ উপায়টি হলো তাদের রীতি, প্রথা, কর্মপদ্ধতিকে তাদের মতো করে গ্রহন করে, সম্মান দেখিয়ে সেই অনুযায়ী আচরণ করা। ভিন্ন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এটি একটি সহজ এবং চমৎকার উপদেশ। কিন্তু সার্ভাইবাল সিচুয়েশনের মতো কঠিন পরিবেশে এটার সাথে আপনাকে আরো কিছু বিষয়ও জানতে হবে।
স্থানীর লোকজনের সাথে যোগাযোগ
টিকে থাকার স্বার্থে যদি কঠিন ও প্রতিকূল পরিবেশে আপনি অপরিচিত, অচেনা ও লোকাল কোন সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যে চাওয়ার কথা ভাবেন, তাহলে তার আগেই কিছু বিষয় নিয়ে সতর্ক ও সচেতন হয়ে যান। তার জন্য একটি ভালো পন্থা হলো তাদের সাথে মেশার আগেই তাদের কালচার বা সংস্কৃতি জানার চেস্টা করা। তারা কি খুব প্রাচীন কোন সংস্কৃতির ধারক নাকি আধুনিক? তাদের জীবনধারণ পদ্ধতি কী? কৃষক সস্প্রদায়, জেলে সম্প্রদায় অথবা বন্ধুসুলভ নাকি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণকারী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেস্টা করুন।
যেকোন সার্ভাইবাল সিচুয়েশনেই আপনি দেখবেন, ক্রস কালচারাল কমিউনিকেশন স্থান, কাল ও মানুষ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। এটা যেমন আপনাকে গোঁড়া প্রাচীন ধ্যান-ধারণাপন্থী লোকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে তেমনি আপনি আধুনিক সম্প্রদায়েরও দেখা পেতে পারেন। প্রাচীন বা আধুনিক যেটাই হোক না কেন, সেই সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে সঠিক ও মানানসই আচরণের মানদন্ডই তাদের কালচারের প্রতিনিধি। সেটা আপনার কাছে গ্রহনযোগ্য নাও মনে হতে পারে। যেরকমই হোক না কেন, তাদের মধ্যে স্বকীয় আইন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শ খুঁজে পাবেন। সেগুলো আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে অজানা ও অদ্ভুত মনে হলেও নতুন কোন পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে, তাদের কালচারের এই বিভিন্নদিকগুলো নিয়ে জানার ও বোঝার চেস্টা করুন। এই পূর্ব জানাটাই স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন অথবা এড়িয়ে চলা, দুটোতেই আপনাকে সাহায্য করবে।
স্বাভাবিকভাবেই অচেনা লোকের আচরণ আপনার অজানা থাকবে। তাদের থেকে আপনি সাহায্য পেতে পারেন আবার অবজ্ঞাও পেতে পারেন। তাদের আচরণ যদি বন্ধুসুলভ মনে হয় তাহলে আপনিও তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখান। তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্ম, রীতিনীতিকে সম্মান দেখিয়ে সঠিক আচরণ করুন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে যদি অজ্ঞ থাকেন অথবা শ্ত্রুভাবাপন্ন আচরণ দেখেন, সর্বোচ্চ চেস্টা করুন তাদের এড়িয়ে চলার। এবং নিজেকে আড়ালে রাখুন। এক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনের দৈনন্দিন আচরণ সম্পর্কে অর্জিত মৌলিক জ্ঞান আপনাকে সাহায্য করবে। তবে, সতর্ক পর্যবেক্ষণে যদি আপনার কাছে পুরোপুরি অজানা, অচেনা লোকদের বন্ধুসুলভ মনে হয়, একান্ত প্রয়োজনে আপনি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
তাদের আচরণ বন্ধুসুলভ বা নির্লিপ্ত যাই হোক না কেন, প্রাথমিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপনি সতর্কতার সাথে সম্মান দেখিয়ে কথা বলুন। এটা আপনার উপকার না করলেও অন্তত খারাপ কিছু থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। পরে তাদের নিজস্ব রীতিনীতির সাথে পরিচিতি হয়ে গেলে ভদ্রতা দেখান এবং শিষ্টাচার ও নিয়ম মেনে চলুন। কিন্তু সতর্ক থাকবেন। অনেকসময় আচরনে বন্ধুসুলভ মনে হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক মনোভাব, নির্দেশনা ও প্রচারণায় তারা আপনার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতে পারে। আবার বাইরে থেকে প্রতিকূল মনে হলেও অনেক জায়গায়, বিশেষ করে শহরাঞ্চল থেকে দূরের লোকালয়ের মানুষের সহযোগিতা পেতে পারেন। স্থানীয় রাজনৈতিকদের প্রতি বিদ্বেষ থেকে তারা অপরিচিতদের সাহায্য করে।
প্রথমবার যোগাযোগের সময় সম্ভব হলে কোন একক ব্যক্তির সাথে কথা বলুন। আরো ভালো হবে, প্রথমে আপনি না এগিয়ে তাকে এগোতে দিলে। কেননা বিপদে থাকলে অনেকে সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। চেস্টা করুন ঝামেলা এড়িয়ে চলতে এবং যতটুকু সম্ভব সাহায্য আদায় করে নিতে।
মনে রাখবেন, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে একটি ভাল সম্পর্ক স্থাপন অনেকাংশেই আপনার বন্ধুসুলভ আচরণ, ভদ্রতা ও ধৈর্যের উপরই নির্ভরশীল। ভয় বা অস্ত্র দেখিয়ে অথবা কোন আক্রমনাত্নক আচরণ দেখালে সেটা বরং আপনার জন্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে। তারা আপনাকে শ্ত্রু ভেবে নিতে পারে। তাই হাসিমুখে কথা বলুন। সাধারণত লোকাল মানুষজন লাজুক প্রকৃতির হয়। আবার তারা আপনাকে পাত্তা নাও দিতে পারে। সেক্ষেত্রে পরিচিত হওয়ার জন্য ধীরেসুস্থে আগান, তাড়াহুড়া না করাটাই ভালো।
সার্ভাইবাল বিহেভিয়ার
প্রাচীন সমাজগুলোতে বার্টার বা পণ্য বিনিময় এখনো প্রচলিত। অবশ্য বিনিময়ের জন্য ধাতব মুদ্রা ভাল। এটা আপনি দামীরত্ন বা উপহার সামগ্রী হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবেন। তবে দুর্গম ও নির্বাসিত এলাকাগুলোতে সাধারণত বিনিময়ের জন্য টাকা-মুদ্রা থেকে ম্যাচ, তামাক, লবণ, রেজার ব্লাড, খালি পাত্র অথবা জামা কাপড়ের মূল্য বেশি। আর তাই স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে বিনিময়ের জন্য লবণ, তামাক, রূপার টাকা অথবা এই ধরনের কাছাকাছি কিছু থাকলে সেটার ব্যবহার করুন। এছাড়া কাগজের টাকা সবত্রই পরিচিত। পরিশোধে পাওনার অতিরিক্ত না দেওয়াটাই ভালো। এটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। আবার আপনার জন্য বিপদও ডেকে আনতে পারে। বিনিময়ের সময় যথাসম্ভব চেস্টা করুন সম্মানের সাথে করতে। তাদের যেনো মনে না হয়, আপনি তাদের ছোট করছেন বা উপযুক্ত সম্মান দেখাচ্ছেন না।
ভাষার বিচিত্রতা যেহেতু একটি বড় সমস্যা, একে অন্যের ভাষা না বুঝলে ইশারায় কথা বলুন। আপনার প্রশ্ন বা চাহিদাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেস্টা করুন। ভাষা না বুঝলেও ইশারায় কোনকিছু বললে অনেকেই সেটা ধরতে পারে, এটা আপনার জন্যও সহায়ক হবে। তবে ভিন্ন কোন সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানানোর অন্যতম একটি বড় মাধ্যম হলো, সেই ভাষায় কথা বলা। সম্ভব হলে সেই স্থানের প্রচলিত ভাষার কিছু কিছু শব্দ, বাক্য শিখে নিন। ইংলিশ সার্বজনীন ভাষা হওয়ার কারনে ভাগ্য সহায়ক হলে তাদের মধ্যে ইংরেজি কিছুটা হলেও বোঝে এরকম কাউকে পেয়ে যেতে পারেন।
অনেক জায়গাতেই ধর্মীয়, পবিত্র, বিপদজনক অথবা কোন কারনে বিশেষ কিছু জায়গা নিষিদ্ধ থাকে। কিছু জায়গাতে আবার নির্দিষ্ট কিছু প্রানী হত্যাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এরকম কিছু আছে কিনা জানার চেস্টা করুন। মনে রাখবেন, যতটা সম্ভব শেখা ও জানাটাই একদিকে যেমন তাদের সাথে আপনার সম্পর্ক শক্তিশালী করবে অন্যদিকে পরবর্তীতে আপনারও কাজে লাগতে পারে। মানুষদের সাথে মিশুন। সেখানকার পরিবেশ বিপদ সম্পর্কে ধারণা নিন। সম্ভাব্য শত্রুদের সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করুন । কিন্তু স্বভাববশত মানুষ ভিন্ন কালচারের অচেনা মানুষকে না জানা, না চেনার কারণে শত্রু ভাবে। অথবা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। অনেকটা কাছের বলে প্রতিবেশিকে বিশ্বাস করা কিন্তু অচেনা বলে দূরের অপরিচিত কাউকে অবিশ্বাস করার মতো। আর তাই, কাউকে আপাতদৃষ্টিতে শত্রু মনে হলেও, সে আপনার শত্রু নাও হতে পারে।
অতি জরুরী আরেকটি বিষয়। প্রায়শ স্থানীয় লোকজনের বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ থাকে। সম্ভব হলে নিজের জন্য আলাদা করে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন এবং পজিটিভলি শারীরিক সংস্পর্শ (যেমনঃ কোলাকুলি করা, হাত মেলানো) এড়ানোর চেস্টা করুন। কোনরকম প্রতিরোধ বা বাধা না পেলে নিজের খাবার ও পানির ব্যবস্থা নিজেই করুন। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত বা ধর্মীয় কোন কিছুকে কারন হিসেবে দেখান। সাধারণত আঞ্চলিক লোকজন কারণ হিসেবে এগুলোকে সহজ ভাবে নেয়।
কারো হাত ধরা বা গায়ে স্পর্শ করা এসব ব্যাপারগুলোতে সতর্ক থাকুন। অন্যথায় বিপদে পরে যেতে পারেন। অনেক জায়গায় গায়ে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ থাকে। শারীরিক সম্পর্ক করা থেকে দূরে থাকুন।
আবার কিছু জায়গার মানুষের অতিথীসেবা আপনাকে অবাক করে দিতে পারে। তারা এতোবেশী অতিথিপরায়ণ হয় যে, অতিথীর জন্য নিজেদের খাবারের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এই পরিবেশে পড়লে, তারা যেটা খেতে দেয়, যেভাবে দেয়, সেভাবেই গ্রহন করা আপনার জন্য ভালো হবে। প্রয়োজনে উপস্থিত সবার সাথে খাবার ভাগ করে নিন। খুশি করার জন্য খাওয়ার সময় তাদের মতো করে খাওয়ার চেস্টা করুন। এবং আপনার ভাগের সবটুকু খাবার শেষ করার চেস্টা করুন।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারনে কিছু কিছু জায়গার মানুষ ওয়াদা পালন করাকে তারা মহান দায়িত্ব হিসেবে ভাবে। তাদের কাছে কোন ওয়াদা করলে সেটা রাখার সর্বোচ্চ চেস্টা করবেন। তাদের সাথে মিশুন। আপনার কাছে অদ্ভুত মনে হলেও, তাদের রীতিনীতি, আচরণ, সম্পদ এগুলোকে সম্মান দেখান। খাবার বা আশ্রয়ের জন্য অন্যকোনভাবে তাদের পাওনা পরিশোধ করুন বা কিছু উপহার দিন। এবং অবশ্যই গোপনীয়তাকে সম্মান দেখাবেন। কারো বাড়িতে আমন্ত্রিত না হলে যাবেন না।
রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তন
বর্তমানে দেশগুলোর মধ্যে আর্ন্তজাতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক মনোভাব এবং প্রতিশ্রুতি খুব দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। আর্ন্তজাতিক সম্পর্কে আপনার দেশের সাথে শত্রুতাপূর্ন সম্পর্ক বিদ্যমান এমন দেশের নাগরিকদের বন্ধু ভাববেন না। যদিও তারা খোলাখুলি শত্রুতা পোষণ করে না। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শে্র ভিন্নতার কারণে তারা আপনাকেও শত্রু ভাবতে পারে। রাজনৈতিক সম্পর্কের পটভূমি পরিবর্তন না হলে, তাদেরকে এড়িয়ে চলাটাই ভালো হবে। যদি চলতেই হয়, নিজের রাজনৈতিক দর্শন কিংবা রাজনৈতিক মতামত তাদের সাথে শেয়ার করতে যাবেন না। সার্ভাইভাল পরিস্থিতিতে আপনার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত টিকে থাকা।
** লেখাটা সার্ভাইভাল গাইড সিরিজের অন্তর্ভূক্ত