বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে পুরাণের প্রভাব (শেষ অংশ)


বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর ধরে ধরে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব পৌরাণিক শব্দগুলোর কোনটি সরাসরি পুরাণ থেকে এসেছে; কোনটি রামায়ন-মহাভারত হয়ে, কোনটি আবার বেদ-উপনিষদের ব্যাখ্যাদানের প্রসঙ্গ থেকে এসব ছোট ছোট ব্যবহারিক শব্দের বিশাল পৌরাণিক ভিত প্রস্তুত করেছে। 

অকালকুষ্মাণ্ডঃ 

ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারী দু’বছর ধরে গর্ভবতী, অথচ সন্তানের জন্ম হচ্ছে না। ওদিকে পাণ্ডু একেএকে পাঁচ পুত্রের পিতা হয়ে গেছেন। অপুত্রক ধৃতরাষ্ট্রের সিংহাসন হাতছাড়া হয় অবস্থা। দুঃখে ক্ষোভে গান্ধারী নিজেই নিজের গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেললেন। গর্ভপাতের ফলে একটি কুষ্মাণ্ড বা কুমড়া আকৃতির মাংসপিণ্ড বের হয়ে এল। আর মুখে মুখে প্রচার হয়ে গেল গান্ধারী অকালে এক কুষ্মাণ্ড অর্থাৎ কুমড়া প্রসব করেছেন। সেখান থেকেই এসেছে ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ শব্দটি।

অগস্ত্য যাত্রাঃ 

বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি অগস্ত্যের নামে এই ‘অগস্ত্য যাত্রা’। দেবলোকের অপ্সরা যজ্ঞমিত্রকে দেখে সুর্যের এবং উর্বশীকে দেখে বরুণের একইসাথে বীর্যপাত ঘটে। সে বীর্য গিয়ে পড়ে যজ্ঞকুম্ভে। এ দুই প্রাচীন দেবতার বীর্য হতে জন্ম নেয় দুই শ্রেষ্ঠ ঋষি বশিষ্ট ও অগস্ত্য। ঋগ্বেদ মতে অগস্ত্য তাই সূর্য ও বরুণের পুত্র। এই অগস্ত্য আবার ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু।

বিন্ধ্যপর্বতের একবার খেয়াল হল সূর্য যেমন উদয়কালে সুমেরু পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে, তাকেও তেমনি প্রদক্ষিণ করবে। তাই সে তপস্যাবলে ক্রমশ উপরের দিকে বাড়তে শুরু করে। এতে সুর্যের গতিপথ বিঘ্নিত হবার আশংকা তৈরি হল। তখন দেবতাদের অনুরোধে অগস্ত্য তার কাছে গেলেন।

গুরুকে দেখে নত হয়ে বিন্ধ্য প্রণাম করলে গুরু তাকে সোহাগ করে বললেন, “বাবা বিনু, আমি দক্ষিণে যাচ্ছি। এদিকে তোমার উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ফেরার সময় তুমি বাবা আমার বুড়ো হাড়গুলোকে তোমাকে টপকানোর পরীক্ষায় আবার ফেলো টেলো না। তাই আমি যতক্ষণ না ফিরি, তুমি একটু কষ্ট করে এভাবেই দম নিতে থাকো।“ এই বলে অগস্ত্য সেই যে গেলেন, আর সে পথে ফিরলেন না। ফলে বিন্ধ্যের আর বৃদ্ধি হল না। এ কারণেই যে যাত্রায় আর ফেরার সম্ভাবনা নেই বা কম, তাকে ‘অগস্ত্য যাত্রা’ বলে। অগস্ত্যের সে যাত্রা ছিল ১ ভাদ্র। এখনো ভাদ্র মাসের ১ তারিখে কেউ কেউ শুভ কোন কাজে কিংবা দূরের যাত্রায় যায় না।

অনামিকাঃ 

মহাদেব শিব একবার ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে চতুর্মুখ ব্রহ্মার একটা মুণ্ডু ঘাড় থেকে খসিয়ে দেন। ব্রহ্মার মুণ্ডুবিয়োগ বলে কথা! না জানি কী সেই মারাত্মক অস্ত্র! কিন্তু স্বর্গীয় ময়নাতদন্তে অস্ত্রের কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না। পরে দেব-ফরেনসিক ল্যাবে জানা গেল মহাদেব শুধু কড়ে আঙ্গুলের পাশের আঙ্গুলের খোঁচাতেই একাজ করে ফেলেছেন। মহাদেবের রাগ থামলে তিনি অনুতপ্ত হয়ে সে আঙ্গুলকে অভিশাপ দিলেন,”ওরে পাপাঙ্গুল!আজ থেকে তোর কোন নাম থাকবে না।“ সেই থেকে ঐ আঙ্গুলটির নাম ‘অনামিকা’। আবার কারো নাম জানা না থাকলেও এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। (শাস্তিপ্রাপ্ত ঐ বিশেষ আঙ্গুলেই কেন বিয়ের আংটি পড়ানো হয়, বিষয়টি ভাববার মতন।)

গজকচ্ছপের লড়াইঃ 

মহাভারতের আদিপর্বের উপাখ্যান গজকচ্ছপের লড়াই। মহর্ষি বিভাবসু ছিলেন স্বভাবে বদরাগি। ঋষি হওয়া সত্ত্বেও ধনসম্পদের মায়ামোহ তিনি কাটাতে পারেন নাই। দুষ্টলোকের প্ররোচনায় মিলমিশ ভুলে গিয়ে সম্পদের ভাগ করতে বসলেন ছোটভাই সুপ্রতীকের সাথে। কিন্তু মনোমত না হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে বিভাবসু ছোটভাইকে হাতি হবার অভিশাপ দিয়ে বসলেন। সুপ্রতীকই বা ছাড়বেন কেন? বড় ভাইকে কচ্ছপ হবার অভিশাপ দিয়ে দিলেন। দুই অভিশাপই ফলে যায়। এখন হাতি আর কচ্ছপ ধনসম্পদ নিয়ে করবেটা কী? কিন্তু রাগের মাথায় সেটা আর চিন্তায় আসলো না তাদের। তারা সে অবস্থাতেই লড়াই চালিয়ে গেলেন অনর্থক এবং অবিরাম।সে থেকেই ভাই-ভাই কিংবা জ্ঞাতিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদকে ‘গজকচ্ছপের লড়াই’ বলা হয়।

চ্যালা-চামুন্ডাঃ 

পুরাণ মতে, চন্ড-মুন্ড বধের সময় দেবী দুর্গার ভ্রূকুটি ললাট থেকে চামুন্ডা দেবীর উদ্ভব। দেবীর হাতে অস্ত্র, দন্ড । দেহের বর্ণ গাঢ় নীল পদ্মের মত। দেহ অস্থিচর্মসার। দীর্ঘ রক্তবর্ণ জিহ্বা, বিকটাকার দাঁত। জটাধারী আর বাঘের চামড়াপরিহিতা এই দেবীর সঙ্গিসাথীরাও যেমন তেমন কেউ নয়- ডাকিনী, প্রেতিনী, শাঁখিনী এরা। এমনিতে দেবী নিজেই বিকটাকার মূর্তিধারী, তায় সেরের উপর সোয়া সেরের মত তার সাথে যোগ হয়েছে রক্তহিমকরা ভয়ংকর চেহারা আর স্বভাবের সাথীগুলো। এখান থেকেই মূল নেতা বা ষণ্ডার সাথী বা চ্যালাদের বুঝাতে এসেছে ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ শব্দটি। (ইংরেজিতে হলে ব্যাকরণসম্মতভাবে বলতে পারতাম ‘দ্য চ্যালাস অব দি চামুণ্ডা’।)

ঠুঁটো জগন্নাথঃ 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার পরমভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্মের ভক্তিতে খুশি হয়ে তাঁকে দেখা দেন এবং একটা কাঠের উপর তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন, যে মূর্তিতে তিনি নিজেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবেন। কাঠ তো পাওয়া গেল, কিন্তু উপযুক্ত কারিগর পাচ্ছিলেন না। একদিন এক রহস্যময় ব্রাহ্মণ এসে জানাল সে ছুতোরের কাজ জানে। কিন্তু সে ব্রাহ্মণ আবার এক শর্ত জুড়ে দেয়। শর্ত হল - সে এক বন্ধ ঘরে কাজ করবে এবং কাজ শেষের ঘোষণা সে নিজে না দেয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বিরক্ত করতে বা দেখতে আসতে পারবে না !

রাজা শর্ত মেনে নিলে কাজ শুরু হল। সবাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের ঠক ঠক শব্দ শোনে আর কৌতূহলে মরে। কিন্তু উঁকি দিতে পারে না। একদিন হঠাৎ ভেতর হতে কোন শব্দ আসা বন্ধ হয়ে যায় ! না কাঠ ঘসার, না কাঠ খোদাইয়ের, কোন শব্দ নাই। সবাই ভাবল ব্রাহ্মণ আবার মরে টরে গেল কিনা ! কারণ, এর মধ্যে খাবার খেতেও ব্রাহ্মণ বাইরে আসে নাই। ছটফটে থাকতে না পেরে সবাই দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ল। গিয়ে দেখে ভেতরে কেউ নেই, শুধু পড়ে আছে হাত-পা ছাড়া এক কাঠের জগন্নাথের মূর্তি। পরে জানা গেল সে ব্রাহ্মন ছিল আর কেউ নয়, স্বয়ং স্বর্গের স্থপতি বিশ্বকর্মা। শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় তিনি অসম্পূর্ণ জগন্নাথ রেখে আবার ফেরত গেলেন। রাজা জানতে পেরে বুক চাপড়ে কাঁদেন আর হায় হায় করেন,”এ ঠুঁটো জগন্নাথ নিয়ে আমি কী করবো? একে আমি ফেলে দিতে পারবো না, এতে তো পুজোও হবে না!” তখন থেকে এরকম অসম্পূর্ণ কাজ যা থেকে কোন ফল আসবে না, আবার কাজটি শেষও করা যাবে না – এমন বুঝাতে এসেছে – ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ শব্দটি।

বিদুরের খুদঃ

বেদব্যাসের রূপঘটিত কারণে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ আর পাণ্ডু ফ্যাকাশে হওয়ায় সত্যবতী এক সুস্থ ও সুদর্শন বংশধরের আশায় পুণরায় অম্বালিকাকে বেদব্যাসের কাছে পাঠান। কিন্তু অম্বালিকা একবার ‘ন্যাড়া’ হয়েছেন, দ্বিতীয়বার কি আর বেদব্যাসতলায় যাবেন? তিনি এবার শূদ্রবংশীয় এক রূপসী দাসীকে নিজের মত সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেদব্যাস ত্রিকালজ্ঞ ঋষি, বর্তমানের পাশাপাশি অতীত-ভবিষ্যতও দেখতে পান। আশ্চর্যের ব্যাপার, সদ্যমাত্র অতীতে অম্বালিকাকে এত ঘনিষ্ঠ পেয়েও বেদব্যাসের নজর কতটুকু ব্যাসার্ধে আটকে ছিল কে জানে, দাসীতে আর অম্বালিকায় তিনি কোন ফারাক পেলেন না! দাসীকেই অম্বালিকা ভেবেই উপগত হলেন। বেদব্যাসের ঔরসে সে শূদ্র দাসীর গর্ভে জন্ম নিলেন বিদুর।

পূণ্যাত্মা বলে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ছিলেন বিদুর। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বন্ধের জন্য পাণ্ডবদের দূত হয়ে হস্তিণাপুর আসলেন কৃষ্ণ। দূর্যোধনের আয়োজনের বিশাল রাজভোগ উপেক্ষা করে কৃষ্ণ গেলেন বিদুরের কাছে মধ্যাহ্ন ভোজে। তখন বিদুরের আহার শেষ এবং একেবারে খুদের মত যতসামান্য আহারই ছিল তার ঘরে। কিন্তু সে সামান্য নগণ্য আহারেই তৃপ্ত হলেন কৃষ্ণ, মনে হচ্ছিল যেন ঠেসে রাজভোগ খেয়ে ফেলেছেন। সে থেকেই সামান্য কিন্তু আন্তরিক দান ‘বিদুরের খুদ’ নামে কথিত।

রোমহর্ষক / লোমহর্ষকঃ 

পুরাণ মতে, রোমহর্ষণ বা লোমহর্ষণ হলেন বেদব্যাসের অন্যতম প্রধান শিষ্য। বেদ বিভাজনের পর বেদব্যাস রোমহর্ষণকে ইতিহাস ও পুরাণ পাঠের শিক্ষা দান করেন। গুরুর আদেশে তিনি আবার বাকি ঋষিদের এ পুরাণ কীর্তণ করতেন। বেদ-পুরাণ পাঠের সময় উত্তেজনায় তাঁর গায়ের পশম(রোম/লোম) হর্ষিত হচ্ছিল অর্থাৎ শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকেই কোন কারণে উত্তেজনায় গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসেছে ‘রোমহর্ষক/লোমহর্ষক’।

সংজ্ঞা হারানো / সংজ্ঞা ফিরে পাওয়াঃ 

আদিদেব সূর্যের স্ত্রী ছিলেন সংজ্ঞা। স্বামীর তেজ কোনমতে সহ্য করে সংসারটা মোটামুটি চালিয়েই নিচ্ছিলেন। কিন্তু দিনদিন সে তেজ বাড়তে থাকায় একসময় “দুচ্ছাই, নিকুচি করি” বলে চলে গেলেন পিতৃগৃহে। যাবার আগে নিজের ছায়া সৃষ্টি করে রেখে গেলেন স্বামীর জন্য। সুর্যদেব সারা দুনিয়া আলোকিত করলেও এখানে নিজেই রয়ে গেলেন অন্ধকারে। ছায়াকেই সংজ্ঞা ভেবে সংসার করতে লাগলেন। জানতেই পারলেন না যে তিনি ‘সংজ্ঞা হারিয়েছেন’ (অর্থাৎ এ জ্ঞান তাঁর ছিল না)। পরে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি জানতে পারলেন তাঁর তেজের কারণে তাঁর স্ত্রী পালিয়ে গেছে। তখন তিনি বিশ্বকর্মাকে দিয়ে নিজেকে সাইজ করে নিলেন। সংসার টিকিয়ে রাখার মত সহনীয় পর্যায়ে এলে তাঁর স্ত্রী আবার তাঁর কাছে ফিরে আসে। অর্থাৎ সূর্যদেব ‘সংজ্ঞা ফিরে পান’। সুর্যদেবের সে স্ত্রী হারানো আর পাওয়া থেকেই আমরা পেয়েছি ‘সংজ্ঞা হারানো’ আর ‘সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া’।

ষড়যন্ত্রঃ 

তন্ত্র সাধনায় ছয়টি আভিচারিক প্রক্রিয়া বা বন্ধন পালন করা হয়। এগুলো হল- মারণ (প্রাণ হরণ করা), মোহন (চিত্তবিভ্রম ঘটানো), স্তম্ভন (যাবতীয় প্রবৃত্তি নষ্ট করা), বিদ্বেষণ (অন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা), উচ্চাটন (স্বদেশ/স্বজাতি/পরিবারের প্রতি বিভ্রম ঘটানো), বশীকরণ (বশে আনা)। এ ছয় প্রক্রিয়া্র লক্ষ্যই হল নিজের স্বার্থ উদ্ধার আর অন্যের ক্ষতি সাধন। এ ছয় বন্ধনপ্রক্রিয়া থেকেই ক্ষতিকর পরিকল্পনা অর্থে এসেছে ‘ষড়যন্ত্র’ কথাটি।

এরকম অজস্র ঘটনাসম্ভূত প্রবাদ আছে আমাদের কাছে। আবার কাহিনি এক অথচ প্রবাদের ব্যবহার উল্টো, এমনও আছে। যেমন- ‘রূপে কার্তিক’।

অনেকেই রূপবান পুরুষ বুঝাতে বলে ‘কার্তিকের মত রূপ’। অথচ কোন পুরাণেই কার্তিকের চেহারা সুন্দর ছিল এমনটা পাওয়া যায় না। বরং কার্তিকের মুখ ছয়টি ছিল বলে জানা যায়। আবার আরেকটি কথা - এতই যদি রূপ থাকত, তবে তার বিয়ের জন্য পাত্রী পাওয়া যায়নি কেন? ( সেনার পতি হওয়া নিয়ে মতান্তর আছে )

শিবের মত পিতা ( যদিও শ্মশানে থাকা শ্বশুরের যৌতুক হিসেবে ছাই আর গাঁজা ছাড়া আর কীইবা দেয়ার মুরোদ থাকে ? ), পার্বতীর মত মাতা ( অবশ্য যে শাশুড়ি ক্ষেপলে চন্ডী-চামুন্ডা, তার সাথে এক সংসারে হাঁড়ি ঠ্যালার ইচ্ছা কোন পুত্রবধূরই বা থাকে ? ), গণেশের মত সিদ্ধিদাতা ভাই ( হতে পারে এত বড় শুঁড়ের ফাঁকে কুতকুতে চোখে কীইবা দেখা যায় ? ) - বায়োডাটায় ফ্যামিলি স্ট্যাটাসের ঘরে এমন হাই রেফারেন্স সত্ত্বেও কার্তিকের মেয়ে জুটল না!

সবচে’ হতাশ ব্যাপার - কার্তিকের নিজের বাহন ময়ূরের হাজার হাজার চোখ। অথচ এ ‘ঘটক পাখি ভাই’ এত চোখ নিয়েও দুনিয়া জুড়ে একটা পাত্রী খুঁজে পেল না! অথচ আমাদের প্রবাদে রূপবান পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি ‘রূপে কার্তিক’ কথাটি।

এরকম হাজার হাজার উদাহরণে যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, পুরাণ শুধু আমাদের দিয়েই গেছে তা কিন্তু নয়, অনেক প্রবাদ আমাদের লোককথা এবং পরিপার্শ্ব থেকেও পৌরাণিক চেহারা নিয়েছে। যেমনঃ ‘সাক্ষি গোপাল’, কিংবা ‘হরি ঘোষের গোয়াল’ ইত্যাদি।

সাক্ষি গোপালঃ 

পুরীতে তীর্থ করতে এসে এক প্রৌঢ় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এক তরুণ সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলে। খুশি হয়ে প্রৌঢ় নিজের মেয়ের সাথে তরুণটির বিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে প্রৌঢ়টি সে প্রতিজ্ঞা ভুলে যান। তরুণটি তাকে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন ঐ প্রতিজ্ঞার কোন সাক্ষি আনতে পারলে তিনি এ বিয়ে দিবেন। তরুণটি জগন্নাথ দেবকে অনুরোধ করল সাক্ষি হয়ে গ্রামে যেতে। জগন্নাথ দেব রাজি হলেন এই শর্তে যে, তিনি তরুণটির পিছন পিছন যাবেন নূপুর পায়ে এবং তরুণটি পেছনে তাকাতে পারবে না। যাত্রা শুরু হল। কিছুদূর যাবার পরেই কৃষ্ণের মাথায় দুষ্টামি বুদ্ধি চাপল। তিনি নূপুর চেপে ধরে হাঁটতে লাগলেন। নূপুরের শব্দ থেমে যাওয়ায় তরুণটি ভাবল পেছনে কেউ আসছে না। সে ফিরে তাকাল। শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় কৃষ্ণ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। সেই থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে কিংবা চোখের সামনে অঘটন ঘটতে দেখেও নিশ্চেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে বলে ‘সাক্ষি গোপাল’। পুরীর সন্নিকটে সমুদ্রতীরে সাক্ষীগোপাল কৃষ্ণের মূর্তি ও মন্দির আজো সে লোককথার সাক্ষ্য বহন করছে।

হরি ঘোষের গোয়ালঃ 

অলস ও নিষ্কর্মা লোকজনের কোলাহলপূর্ণ আড্ডাকে লোকে বলে হরি ঘোষের গোয়াল। নদীয়ার গোপ হরি ঘোষের গোশালায় ছিল পণ্ডিত রঘুনাথ শিরোমণির চতুষ্পাঠী। গরুর ডাক, ঘন্টার ধ্বনি, ছাত্রছাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেচি সব মিলিয়ে এক মহা হুলুস্থূল সেখানে। এই কোলাহল থেকে এই বাগধারার উৎপত্তি। মতান্তরে, কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলের হরি ঘোষের অতিথিশালায় বিনা খরচে থাকা-খাওয়ার সুযোগে আশ্রিত বহু নিষ্কর্মা ব্যক্তির কোলাহল থেকে বাগধারাটি এসেছে।

শুধু এটুকুই নয়, লোকসাহিত্য থেকে পৌরাণিকীতে রূপ নিয়েছে এমন বিশাল কাহিনিও আছে আমাদের। যেমনঃ পদ্মা পুরাণ বা মনসা মঙ্গল। যেহেতু ‘পদ্মা পুরাণ’ মূল পুরাণের মধ্যে পড়ে নি, স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় নয়।

কিন্তু যে পুরাণে সাপ আর মানুষের আজন্ম বিবাদ শুরু, যে পুরাণ থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম হতে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন রহস্যের মায়াজাল ছড়িয়ে সাপের আনাগোনা, যে বিশাল ‘পদ্মা পুরাণে’ সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে শ্রীহরি-শিব-পার্বতী-মনসা হয়ে আমাদের নিজেদের ঘরের বেহুলা-লখিন্দর, চাঁদ সওদাগর সব একাকার হয়ে গেছে - তাকে পাশ কাটিয়ে যাই বা কিভাবে ?

বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে পুরাণের প্রভাব পর্ব সমাপ্ত। পরের পর্বে পদ্মাপুরাণ বা মনসামঙ্গল নিয়ে কথা হবে।

রেফারেন্সঃ
বাগধারা সংগ্রহ - শৈলেন চক্রবর্তী, প্রবাদের গল্প - বন্দনা গুপ্ত ও পৃথ্বিশ গুপ্ত, প্রবাদের আড়ালে - বন্দনা গুপ্ত, বাংলা শব্দের পৌরাণিক অভিধান - ডঃ মোহাম্মদ আমীন, বাংলা শব্দের উৎস অভিধান - ফরহাদ খান


প্রাসঙ্গিক লেখা