বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে পুরাণের প্রভাব (১ম অংশ)
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, পুরাণ রচয়িতা বলে যিনি কথিত, সেই ব্যাসদেবের পুরাণের ভাষা কিন্তু বাংলা নয়। এক সহস্র শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচারিত এবং পরবর্তীতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমসাময়িক (খ্রিস্টীয় ৩য় - ৫ম শতাব্দী) সময়ে সঙ্কলিত হতে থাকা এ পুরাণের ভাষাও বাংলা ছিল না। এমনকি কোন কোন পুরাণের জন্মস্থান বঙ্গদেশ বলে প্রমাণিত হলেও সে রচনার ভাষাও আমাদের এখনকার বাংলা নয়। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেই যায় যে, আমাদের বাংলা শব্দভাণ্ডারে পৌরাণিক শব্দমালা এলো কী করে ? উত্তরটা ঐতিহাসিক।
আমাদের বর্তমান বাংলার আদি রূপ খুঁজতে ধীরে ধীরে পিছুতে লাগলে গৌড় অপভ্রংশ, মাগধি অপভ্রংশ, মাগধি প্রাকৃত ইত্যাদির পথ বেয়ে শেষ পর্যন্ত যে আাদি মাথায় গিয়ে শেষ হয়, তা বৈদিক সংস্কৃত ভাষা। অতএব, পৌরাণিক শব্দের আগমন না থাকাটাই ছিল অস্বাভাবিক। কাজেই সোজা কথায়, আমাদের ভাষায় তৎসম, তদ্ভব, অর্ধতৎসম শব্দের অবস্থানের কারণে এবং ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বলয়ে থাকার কারণে এ পৌরাণিক শব্দগুলো জায়গা করে নিয়েছে আমাদের অজান্তেই (উৎস জানা ছাড়াই) আমাদের উপকথায়, লোককথায়, এমনকি মুখের ভাষায়। এরকম হাজার হাজার শব্দ থেকে মাত্র গুটিকয় উদাহরণ হিসেবে এখানে দেয়া হল।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে / নারদের ঢেঁকিঃ
ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদ ছিল একেবারে প্যাঁচালো মানুষ, থুক্কু, মুনি। তাঁর বাহন ছিল ঢেঁকি। দেবতা, মানুষ কিংবা অসুর সমাজে যখনি কোন প্যাঁচ কষার কিংবা ভাঙ্গানোর প্রয়োজন হত, নারদ সেখানেই ঢেঁকিযোগে হাজির হতেন। তাঁর কথা ভেতরে ও বাহিরে এমনি দ্বৈত-অর্থ বহন করত যে, তিনি যখনই কারো পক্ষে কথা বলেছেন, তখন সে পক্ষও নিশ্চিত নয় আখেরে নারদ কোন পক্ষের। মুলত তিনি ওকালতি করতেন ( এবং সভয়ে বলা যায় সেই পৌরাণিক কাল থেকেই এই পেশাটা জেনেশুনে ভাল ও মন্দ দুদিকের পক্ষেই প্যাঁচ খেলে এসেছে )।
যা হোক, নারদ মুনি যে শুধু দেবতাদের পক্ষ নিয়ে মানুষ বা অসুর সমাজেই প্যাঁচ খেলেছেন এমনটা নয়। যখন নিচে অর্থাৎ মর্ত্যধামে কোন কাজ থাকত না, সময়ে সময়ে তিনি স্বর্গধামে ঢেঁকিযোগে গিয়ে দেবসমাজেও স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, অর্থাৎ প্যাঁচ লাগিয়েছেন।
তাঁর এই 'কলহসংগঠক' স্বভাব থেকেই এসেছে - ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ এবং 'নারদের ঢেঁকি'।
মান্ধাতার আমলঃ
সূর্যবংশ তথা রামায়নের রামচন্দ্রের বংশের এক অতি প্রাচীন পূর্বপুরুষ যুবনাশ্ব এবং কালনিমির সন্তান এই মান্ধাতা। দীর্ঘদিন ধরে সন্তান না হওয়ায় মহারাজা যুবনাশ্ব পেরশানিতে পড়ে গেছেন। যোগীমহাপুরুষেরা পরামর্শ দিল এক 'অনিবার্য ফলদায়ক যজ্ঞ' করতে। সে অনুসারে তিনি আয়োজন করলেন। যোগীমহাপুরুষেরা যজ্ঞ শেষে পাওয়া পবিত্র জল একটা পাত্রে নিয়ে রেখে আসলেন রাণির কক্ষে। সে পানি পরদিন প্রত্যুষে পান করলেই গর্ভে পুত্রসন্তান আসবে।
মহারাজা কোন কারণে মহারাণি কালনিমির কক্ষে প্রবেশ করে জল পান করতে গিয়ে ভুলক্রমে সেই যজ্ঞের জলটাই খেয়ে বসলেন। ব্যস ! যজ্ঞের জল তার অনিবার্য ফল দেখাল দশ মাস পরে। রাজা যুবনাশ্ব এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। আদি পিতা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন নাম থাকলেও আদি গর্ভধারক পিতার তালিকায় যুবনাশ্বের আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বি নাই। সেই পিতৃপ্রসূত পুত্রই মান্ধাতা।
এটা এত প্রাচীন কালের ঘটনা যে, অধিকাংশ মানুষই এ কাহিনি জানে না। তাই বেশি আগের কিছু বুঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘মান্ধাতার আমল’ শব্দটি।
ওঝার ব্যাটা বনগরুঃ (বাতির নিচে অন্ধকার)
ওঝা বলতে এখন আমরা সাপে কাটা রোগির গ্রাম্য চিকিৎসককে বুঝি, কিন্তু এটি আদতে ছিল ব্রাহ্মণ উপাধি। যেমনঃ বাংলা রামায়নের রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝা জাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, সর্পবিশারদ নন।
‘ওঝা’ এসেছে ‘উপাধ্যায়’ বা শিক্ষক শব্দ থেকে। বর্তমান সময়ে ব্রাহ্মণের সন্তান জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হয়। কিন্তু প্রাচীন বর্ণপ্রথায় জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হতে পারত না। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রমাণ করে তবে সে উপাধি পেতে হত। যেমনঃ “ঐতরেয়া ব্রাহ্মণ” এবং “ঐতরেয়াপনিষদ”-এর লেখক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন শুদ্র দাসপুত্র। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণ বিশ্রবা মুনির পুত্র রাবন কিন্তু স্বভাব ও কর্মফলে রাক্ষস রূপে পরিচিত হয়েছিল, জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নয়।
আবার, বনগরু বলতে বুনোষাঁড় বা মহিষকে বুঝানো হয় যার মাথায় গোঁয়ারের মত স্বভাব ছাড়া আর কোন বিদ্যা নেই। তাই, জ্ঞানীর মূর্খ সন্তান বুঝাতে বিশেষ করে রাবণের উদাহরণ থেকেই ‘ওঝার ব্যাটা বনগরু’ প্রবাদ এসেছে।
হরিহর আত্মাঃ
বিষ্ণু(হরি)আর শিবের(হর)মিলিত রূপ। এমনিতে বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি-পুজা-মন্ত্র-উপাসনা এমনকি ধারাও ভিন্ন। অথচ, পুরাণের কোথাও এও বলা হয়েছে যে, সৃষ্টির কল্যাণার্থে শিব বিষ্ণুর হৃদয়, বিষ্ণু শিবের। অর্থাৎ, দুই দেহে এক প্রাণ।
এরকম অন্তরঙ্গতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয় - ‘হরিহর আত্মা’।
ধ্রুব সত্যঃ
চরম সত্যের উদাহরণ বোঝাতে আমরা বলি ধ্রুব সত্য। পৌরাণিক রাজা উত্থানপাদ তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুরুচিকে প্রথম স্ত্রী সুনীতির চেয়ে বেশি ভালবাসতেন। সুরুচির প্ররোচনায় সুনীতিকে তিনি বনবাস দেন। একদিন বনে শিকার করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে রাজা সুনীতির কুটিরে হাজির হন এবং সহবাস করেন। সে সন্তানই ধ্রুব।
শিশুপুত্র ধ্রুব সৎভাইদের সঙ্গে সিংহাসনে বাবার কোলে বসতে চাইলে সৎমা বাধা দেয়। তখন মাতা সুনীতির পরামর্শে ধ্রুব শ্রীহরির ভজনা করে এই অধিকার লাভ করতে কঠিন তপস্যা শুরু করেন। সাধনায় অবিচলিত থেকে ধ্রুব বিষ্ণুকে নামিয়ে আনলেন। বিষ্ণু বর দিতে চাইলে ধ্রুব কামনা করলেন বিষ্ণুর চরণে যেন তিনি আশ্রয় পান, কারণ, বিষ্ণূই ধ্রুব সত্য। বিষ্ণু তাকে সকল তারা ও গ্রহের উপরে ধ্রুবলোকে ঠাঁই দেন। উত্তর আকাশে অবিচল ধ্রুবতারা এই অবিচল সত্যনিষ্ঠারই প্রতীক।
ধ্রুবতারা যেমন প্রতিদিন দেখা দিবেই, তেমনি চিরসত্যের কিছু বুঝাতে ব্যবহার হয় - 'ধ্রুব সত্য'।
ধুন্ধুমার কান্ডঃ
আজকালকার দিনে যেমন ফেসবুকে যারেতারে না দেখেই শুধু ফ্রেন্ড করে ফেললে মাঝেমাঝে সমস্যায় পড়তে হয়, দেবতারাও তেমনি তখনকার দিনে ভক্তের প্রার্থনার অ্যাড রিকুয়েস্ট পেলেই এক্সেপ্ট করে ফেলতেন, আর প্রায়ই বিপদে পড়তেন। এরকম প্রচুর উদাহরণ আছে দেবতাদের ফেসবুকেও।
ধুন্ধু ছিল এক অসুর। ব্রহ্মা তার প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বর দেন যে, কোন অস্ত্রের তেজ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ব্রহ্মার বরেই অসীম শক্তিশালী হয়ে সে ত্রিভুবনে অত্যাচার শুরু করে। তাকে হত্যা করা সহজ ছিল না, কারণ তাকে যে অস্ত্রই মারা হতো, ব্রহ্মার বরে সে সব অস্ত্র হজম করে ফেলত আর সে অস্ত্রের তেজ মুখ দিয়ে বের করত আগুনের হলকা হিসেবে।
ইক্ষ্বাকু বংসের রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে ধুন্ধু কুবলাশ্বের সহস্র পুত্রকে আগুনের হলকায় পুড়িয়ে মারে। তখন ঋষি উতংকের সহায়তায় কুবলাশ্ব ধুন্ধুর দেহকে জলের ধারা দিয়ে ভিজিয়ে দেন, এবং তারপর ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে তাকে ভস্ম করে ফেলেন। ধুন্ধুকে মারার ভয়াবহ এ যুদ্ধ থেকেই এসেছে ‘ধুন্ধুমার কান্ড’।
রক্তবীজের ঝাড়ঃ
চন্ডীপুরাণে আছে, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসীম বলশালী অসুর দেবতাদের স্বর্গছাড়া করেছিল। তখন দেবতাদের কাতরতায় দুর্গা শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের জন্য কৃষ্ণবর্ণ কালিকা রূপের সৃষ্টি করলেন। দুর্গা ও অসুরদের যুদ্ধে প্রথমে মারা পড়ল সেনাপতি ধুম্রলোচন আর চণ্ডমুণ্ড।
এরপর আসে রক্তবীজ নামে এক অসুর। এর আবার এক রহস্য আছে। দেবতাদের বরে তার রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়লেই সে ফোঁটা থেকে আরেক অসুর জন্ম নিবে ! দুর্গা পড়লেন মহাফাপরে - কয়জনরে মারবে ! একজন মরার আগেই পরের জনের ক্লোনিং সম্পূর্ণ ! তখন দুর্গা কালীকে বললেন,” তুমি মুখের হা বড় করো। রক্তবীজের প্রতিটা রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা খেয়ে ফেলো।“
এভাবেই ‘রক্তবীজের ঝাড়’ (যা শেষ হয় না এমন) নিধন হল। আর আমরা পেয়ে গেলাম আরেকটি প্রবাদ।
কালনেমির লঙ্কাভাগঃ
রামের সাথে যুদ্ধ লড়তে রাবণ সহায়তা চাইলেন মামা কালনেমির কাছে। কালনেমি দেখল এই সুযোগ। যুদ্ধ শুরুর আগেই হিসেব করা শুরু করলেন এ যুদ্ধে জিতলে রাবণের কী কী লাভ আর সে লাভে কিভাবে হিসসা নেয়া যায়। হিসাব শেষে ভাবলেন, সীতার ভাগ দরকার নেই, কিন্তু সোনার লঙ্কা ছাড়ি কেন ? তাই যুদ্ধ জয়ের পর লঙ্কার ভাগাভাগিটা আগেই ঠিক করে নিলেন রাবণের সাথে দরকষাকষি করে।
যুদ্ধের ফলাফলতো সবারই জানা। সেখান থেকেই এসেছে ‘কালনেমির লঙ্কাভাগ’। অর্থাৎ, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
রাবণের চিতাঃ
রাবণহত্যার পর রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী রামকে প্রণাম করলে রাম সীতাজয়ের খুশিতে মন্দোদরীর ভোটার আই,ডি কার্ডে স্বামীর নাম না দেখেই বলে বসলেন - ‘চির সৌভাগ্যবতী হও’।
ভগবান রামের কথা মানেই তো দেব-সংবিধান। তাহলে তো রাবণ আবার বেঁচে উঠবেন। তখন মন্দোদরীর স্বামীর পরিচয় জানতে পেরে রাম তাড়াতাড়ি সে সংবিধানে সংশোধনী আনলেন। বললেন, তার স্বামীর চিতা চির-অনির্বাণ থাকবে। অর্থাৎ, চোখের সামনে স্বামীর স্মৃতি চির জাগরুক থাকবে মন্দোদরীর।
তবে এ আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে রাম যে রাবণ বা তার স্ত্রীর জন্য আরাম বয়ে এনেছেন, তা কিন্তু মনে হয় না। কারণ রাবণও সারাক্ষণ চিতায় জ্বলছে আর তার স্ত্রীও ভুগছে সে যন্ত্রণায়। এবং মনে হয় অভিশাপজাতীয় বোধ থেকেই মনের মধ্যে সবসময় জ্বলতে থাকা আগুন বুঝাতে ‘রাবণের চিতা’ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করাঃ
হস্তিনাপুরের মহারাজ বিচিত্রবীর্য নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সত্যবতী ভীষ্মকে বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রী অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে বংশধর সৃষ্টি করতে বলেন। কিন্তু ভীষ্ম স্বীয় প্রতিজ্ঞার কারণে তাতে অসম্মত হন। তখন সত্যবতীর অনুরোধে মহর্ষি বেদব্যাস অম্বিকার গর্ভে সন্তান দিতে রাজী হন।
যদিও বেদের ঋষিরা যজ্ঞ করেই সন্তান উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দিতেন, কিন্তু বেদব্যাস মন্ত্র জানা সত্ত্বেও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কোন রিস্কে যান নাই। তিনি স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলেন।
সহবাসকালে মুখের সামনে বেদব্যাসের ঘোর কালো দেহ, লম্বা জটা-দাড়ি এবং বিস্ফারিত চোখের দীপ্তিতে ভয় পেয়ে অম্বিকা চোখ বুঁজে ফেলেন। সে দোষে অম্বিকার গর্ভের সন্তান ধৃতরাষ্ট্র দৃষ্টিহীন হন। যেহেতু অন্ধ রাজা হতে পারবে না, তাই ব্যাসদেব অম্বালিকাতেও একই উদ্যোগ নিলেন।
এবার অম্বালিকা সচেতন ছিলেন। চোখ বন্ধ করে ফেলেন নাই ঠিক, কিন্তু অন্তহীনভাবে উপগত হতে থাকা ব্যাসের স্ফুরিত রক্ত বর্ণ অধর, দীপ্তময় চোখ আর সাদা জটাজুটধারী কালো দেহের ভয়াবহতায় তিনি ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যান। ফলে তাঁর গর্ভস্থ সন্তানও হয় ফ্যাকাশে পাণ্ডুবর্ণের – রাজা পাণ্ডু। ভয় পেলে ফ্যাকাশে হয়ে যাবার এ কাহিনি থেকেই এসেছে ‘পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করা’ কথাটি ।
পাণ্ডববর্জিত স্থানঃ
মহাভারতের পাণ্ডবদের মত অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াইয়ে আর কাউকে এত ভ্রমণ করতে হয়নি। কখনো রাজসূয় যজ্ঞের জন্য, কখনো রাজ্যজয়ের জন্য, কখনো বনবাসের জন্য, কখনো অজ্ঞাত বাসের জন্য তারা শুধুই এরাজ্য থেকে ও রাজ্যে ঘুরেছেন। তারা হস্তিনাপুরের সীমানা এবং তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত সকল রাজ্য থেকে দূরে থাকার জন্য বহু পথ পাড়ি দিয়েছেন। বিশেষ করে চূড়ান্ত অজ্ঞাতবাসের সময় নাম-পরিচয় গোপন রাখতে তাঁরা সম্ভব-অসম্ভব অনেক স্থানে আশ্রয় নিতে গিয়েছেন। শুধু এড়িয়ে গেছেন সে স্থানগুলো যেগুলো জনপদের সাথে সংযোগহীন আর সভ্যতা বিবর্জিত। এরকম দুর্গম ও অগম্য স্থান বুঝাতেই ব্যবহৃত হয় ‘পাণ্ডববর্জিত দেশ’, অর্থাৎ যা এমনকি পাণ্ডবদেরও বর্জনের উপযুক্ত।
কেষ্টবিষ্টু আর কলির কেষ্টঃ
শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন এক অসাধারণ যুগপুরুষ। অবতার বা ইত্যাদি ধার্মিক সত্ত্বার কথা না তুলেও তাঁকে স্মরণ করতে হবে এক অসাধারণ কূটনীতিক, এক দুর্দান্ত সমরবিশারদ, অত্যন্ত চতুর, প্রয়োজনে কুটিল পরিকল্পনাকারী এবং যুগশ্রেষ্ঠ দূত হিসেবে। আবার একই সাথে তাঁর প্রেমলীলাও অসাধারণ। একইসাথে দুই স্ত্রীকে সামাল দেয়া এবং তার সাথে শতশত গোপিনীকেও যথোপযুক্ত সময় দিয়ে সংসার ঠিক রাখা এক সত্যিকার কর্মীপুরুষের দুর্লভ উদাহরণ !
কৃষ্ণের উপরোক্ত চরিত্রগুণ সমাজের উপরতলায় কেউ যখন আত্নস্থ করে, তখন তার জন্য প্রযোজ্য হয় ‘কেষ্টবিষ্টু’, আর নিচের স্বভাবগুণ (!) যদি সাধনা করে, তবে সে প্রবলপ্রেমিক পুরুষের জন্য প্রযোজ্য ‘কলির কেষ্ট’।
এভাবে দাতা কর্ণ, শকুনি মামা, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, অগস্ত্য যাত্রা, কুরুক্ষেত্র, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, গজকচ্ছপের লড়াই, বালখিল্যতা ইত্যাদি অজস্র প্রবাদ-প্রবচনের সমাহার আছে আমাদের মুখের ভাষায় ও সাহিত্যের পাতায়। আর এগুলোকে জড়িয়ে আছে রামায়ণ, মহাভারত সহ অগণিত পৌরাণিক কাহিনি। মাঝেমাঝে মনে হয় এ শব্দগুলোর ব্যবহার আর এ শব্দগুলোর পেছনের কাহিনি না জানলে আমাদের ভাষাচর্চাটাও যেন অসম্পূর্ণ ঠুঁটো জগন্নাথের মত হয়ে থাকতো। ঐ দেখ, আরেকটা শব্দ বেরিয়ে এল !
ঠিক আছে, ‘ঠুঁটো জগন্নাথের’ কাহিনিটাও তাহলে বলি, এরপরই না হয় যাব অন্য প্রসঙ্গে ... (চলবে)