পিত্তথলিতে পাথর


নুসাইবার মন খারাপ। মন খারাপের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল তার অভিমান হচ্ছে আশে পাশের মানুষদের উপর। নুসাইবার মা দুইদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। সবাই বলাবলি করছে তার মায়ের পেটে পাথর হয়েছিল। এমন অদ্ভুত কথা সে তো আগে শুনেনি! ছোট্ট নুসাইবার মনে প্রশ্ন জেগেছিল কেন হয় মানুষের পেটে পাথর। কেউ বুঝিয়ে বলছে না তাকে, শুধু এড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ জানতে চাওয়া কি দোষের কিছু! নুসাইবার সত্যি অনেক মন খারাপ।

অন্যদিকে মতিন সাহেব পেটে পাথর জমেছে জেনেও অপারেশন না করে দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছিলেন। ক্রান্তি-লগ্নে এসে সেই পাথর রূপ নিলো ক্যান্সারে।

পিত্ত-থলিতে পাথর অনেক পরিচিত সমস্যা হলেও নুসাইবার মত আমরা অনেকেই জানিনা কেন এবং কিভাবে হয় এই পাথর অথবা জানলেও মতিন সাহেবের মতো গুরুত্ব দেইনা। যারা এখনও গুরুত্ব দিচ্ছেন না আসেন কিছু তথ্য জেনে নেই।

  • পিত্ত-থলির (gallbladder) প্রদাহ (inflammation) কে বলে কোলেসিস্টাইসিস(cholecystitis)। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রদাহ হয় পিত্ত-থলির পাথরের কারণে, বাকি ক্ষেত্রে অন্য কোন কারণে হতে পারে।
  • দুই তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে সচরাচর কোন লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় এবং চিকিৎসা না করায় বাড়তে থাকে পাথর, অনেক ক্ষেত্রে তা রূপ নেয় ক্যান্সারে।
  • পুরুষদের তুলনায় নারীদের পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গর্ভকালীন সময় এই সম্ভাবনা বেড়ে যায় তিন গুন।
  • নারীরা সাধারণত যে সমস্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তার মধ্যে পিত্ত-থলি ক্যান্সারের অবস্থান তৃতীয়।
  • পুরুষদের মধ্যে যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, স্থূলকায় শরীর তারাও অহরহ এর শিকার হন। কারও কারও ক্ষেত্রে হতে পারে বংশগত কারণে।

পিত্ত-থলির পাথর কেন হয়:

পিত্ত-থলির (gall bladder) অবস্থান আমাদের পেটের ডান দিকে যকৃতের (liver) নিচে। যকৃতে পিত্তরস (bile)  তৈরি হয় এবং সূক্ষ্ণ নালির মাধ্যমে পিত্ত-থলিতে পৌঁছে। আমরা যখন খাবার খাই,  পরিপাকতন্ত্র চর্বিজাতীয় খাবারের অংশ চিহ্নিত করার পর এক ধরনের হরমোন (CCK)  নিঃসরণ করে। এতে পিত্ত-থলির মাংসপেশি সংকুচিত হয় এবং সংকোচনের ফলে পিত্ত-থলিতে থাকা ঘন পিত্তরস খাদ্যনালীতে প্রবেশ করে। নালির মধ্য দিয়ে পিত্তরস ক্ষুদ্রান্ত্রে (Small intestine) পৌঁছায় এবং সেখানে  প্যানকৃয়েটিকলাইপেজ নামক এনজাইমের সহায়তায় চর্বি অংশকে ভেঙ্গে হজমে সাহায্য করে। যদি কোন কারণে সাধারণ মাত্রার থেকে বেশি চর্বি থাকে তাহলে তা নির্দিষ্ট মাত্রার এনজাইম দিয়ে সম্পূর্ণ  দ্রবীভূত হয়না। ফলে এই অ-দ্রবীভূত মিশ্রণগুলো ধীরে ধীরে পাথর তৈরি করে। এগুলোকে বলা হয় কোলেস্টেরল পাথর।

পনের শতাংশ ক্ষেত্রে পাথরগুলো কোলেস্টেরলের কারণে হয়না, হয়ে থাকে ভিন্ন কারণে। সেগুলো কে বলে রঞ্জিত-পাথর (pigment stone)। রক্তের লোহিত কণিকা (Red blood cell) ১২০ দিন পর ভেঙে লিভারে বিলিরুবিন সৃষ্টি করে, যা পিত্তরসের মাধ্যমে দেহ থেকে নিঃসৃত হয়। শরীরে বেশি  মাত্রায় বিলিরুবিন সৃষ্টিকারী কিছু অবস্থা যেমন-লিভারসিরোসিস, এছাড়া এনিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদি কারণে এই পাথর সৃষ্টি হয়। এই পাথরগুলি ছোট এবং সংখ্যায় অনেক হয়ে থাকে।

কোলেসিস্টাইটিস বা প্রদাহ হলে পেটের ডানদিকে তীব্র ব্যথা হয়, বিশেষ করে রাতের বেলায় চর্বিজাতীয় খাবার বেশি খেলে এ ব্যথা অনুভূত হতে পারে সেই সঙ্গে বমি ভাব, হালকা জ্বর ইত্যাদি লক্ষ্মণ দেখা দিতে পারে। অনেক সময় পাথর পিত্ত-থলি থেকে বোরোতে গিয়ে পিত্তনালীতে আটকে যায় এবং তখন বিলিরুবিনের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জন্ডিসও হতে পারে।

পুরুষদের তুলনায় নারীদের পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কেন বেশি? কারণ ইস্ট্রোজেন হরমোন পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি থাকে, আর অধিক মাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের উপস্থিতি পিত্তরসে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

পুরুষদের তুলনায় নারীদের পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কেন বেশি? কারণ ইস্ট্রোজেন হরমোন পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি থাকে, আর অধিক মাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের উপস্থিতি পিত্তরসে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া জন্মবিরতিকরণ পিল খাওয়ার অভ্যাস, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

অপরদিকে, ওজন দ্রুত হারে কমতে থাকলেও কিন্তু পাথরের সৃষ্টি হতে পারে। কারণ লোক্যালোরিডায়েট পিত্তরস তৈরিতে বাধা দেয় এবং কোলেস্টেরলকে খুব তাড়াতাড়ি ক্রিস্টালাইজ করতে সাহায্য করে।

এই হল পাথরের সাতকাহন। যেহেতু পিত্ত-থলি তে পাথর হলে সচরাচর এর লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় না এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফি ছাড়া পাথরের উপস্থিতি বুঝার উপায় নেই তাই আমি বলবো সতর্ক থাকার জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে নেয়া ভালো। আর সব সমস্যার মূল কিন্তু অধিক কোলেস্টেরল কিংবা চর্বি জাতীয় খাবার। তাই খাবার নির্বাচনে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী।


প্রাসঙ্গিক লেখা