বোবা ভূত বা স্লিপ প্যারালাইসিস


কিছুদিন আগে সুমনাদের বাসায় বেড়াতে আসা এক আত্মীয় একবার ভূতের খপ্পরে পড়েছিল। উনি ছিলেন মশারির ভেতর, বেঘোরে ঘুমচ্ছিলেন। সুমনা জানে ভূতের আবাস ঘরের বাইরে, বটগাছ, তেঁতুলগাছ, অথবা অন্ধকার ঘন বন-জঙ্গলে। এইটা তাহলে কেমন ভুত যা ঘরে এসে আক্রমণ করে! তাও আবার যেন-তেন ভূত না, তার আত্মীয় হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখেছে মশারির বাইরে ইয়া লম্বা, ধবধবে সাদা কাপড় পরা বেঢপ আকৃতির ভুত হাটা-চলা করছে। খুব ভয় পেয়েছিল সেদিন ছোট্ট সুমনা ভুতের বর্ণনা শুনে, ওইদিনের পর থেকে ভূতের ভয়ে সুমনার একা ঘুমানো রীতিমত অসম্ভব পর্যায়ে চলে গেছে। ভদ্রলোকের তখন দোয়া-দুরুদ, আয়তুল কুরসি পড়ে ভুত ছাড়াতে হয়। উনি যত বেশি বেশি দোয়া পড়েন, পাজি ভুত উনার বুকের উপর তত জোরে চেপে বসে এবং একসময় ছেড়েও দেয়। কি সাঙ্ঘাতিক এই ভুত তাইনা? আসুন জেনে নেই এই ভুতের আদ্যোপান্ত।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই ভুতকে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন বোবা ভুত নামে, অথবা বলে থাকেন "অমুক কে বোবায় ধরেছে।" বিজ্ঞানের ভাষায় এই বোবা ভুত কে বলে 'স্লিপ প্যারালাইসিস।'

স্লিপ প্যারালাইসিস ক্ষতিকর কিছু নয় তবে এর অনুভূতি ভয়ঙ্কর। কেন অথবা কিভাবে হয় এই স্লিপ প্যারালাইসিস তা জানতে হলে বুঝতে হবে ঘুমের চক্র।

স্লিপ প্যারালাইসিস ক্ষতিকর কিছু নয় তবে এর অনুভূতি ভয়ঙ্কর। কেন অথবা কিভাবে হয় এই স্লিপ প্যারালাইসিস তা জানতে হলে বুঝতে হবে ঘুমের চক্র।
আমাদের ঘুম মূলত ৯০-১১০ মিনিটের একটি চক্রে আবর্তিত হয় এবং একে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১. Non-Rem (Rapid Eye Movement) ঘুম এবং
২. Rem ঘুম।

Non-Rem ঘুম তিনটি স্তরে বিভক্ত। প্রতিটি স্তর পাঁচ থেকে দশ মিনিট স্থায়ী হতে পারে।

  • স্তর ১) এটা ঘুমের প্রাথমিক স্তর। এই স্তরে আমরা থাকি আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে। এই পর্যায়ে আমাদের জাগিয়ে তোলা খুব সহজ। পেশী সংকোচনের কারণে এই স্তরে কখনো কখনো আপনি অকস্মাৎ পড়ে যাওয়ার অনুভূতি পেয়ে জেগে উঠতে পারেন। [এই ঘটনা আমার ক্ষেত্রে প্রায়শই হয়।]
  • স্তর ২) প্রথম স্তরের দশ মিনিট পর আমরা পৌঁছে যাই দ্বিতীয় স্তরে। এ স্তরে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎপিণ্ডের গতি ধীর হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। গভীর ঘুমের জন্য তৈরি হতে থাকে আমাদের দেহ।
  • স্তর ৩) তৃতীয় স্তরে আমরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকি।

Rem ঘুমের ক্ষেত্রেও আমরা তিনটি স্তরের মধ্য দিয়ে যাই। তিনটি স্তর নিয়ে হালকা ধারনা দিচ্ছি,

  • স্তর ১) মস্তিষ্ক সচলায়তন: ঘুমের সময় আমরা সচেতন বা সক্রিয় না থাকলেও মস্তিষ্ক ঠিকই সক্রিয় থাকে। কখনও কখনও তার মাত্রা আমাদের জাগ্রত অবস্থার চেয়েও বেশি। এই সময়েই আমরা মূলত স্বপ্ন দেখি।
  • স্তর ২) অনুভূতি সক্রিয় না থাকা: এটা আমরা সবাই জানি, এই সময় আমাদের ইন্দ্রিয় সমুহ দেখা, শোনা অথবা কোন কিছু অনুভব করা থেকে বিরত থাকে।
  • স্তর ৩) পেশি পক্ষাঘাত: এ সময়ে আমাদের দেহ সাময়িকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে যে স্বপ্নে দেখা পরিস্থিতির প্রতি সাড়া প্রদানে বিরত রাখার নিমিত্তে প্রাকৃতিক ভাবেই এমনটা হয়ে থাকে।

আমরা যখন ঘুম থেকে জাগি, রেম এর প্রতিটা স্তরের কাজ একি সময়ে ডি-একটিভ হয়, কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ কিছু কারণে; উদাহরণ: জেট-লেগ, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তার কারণে হতে পারে ভিন্ন কিছু।  এই ভিন্ন কিছুটা কী?

ঘুম থেকে জাগার পর তিনটি স্তরের মধ্যে দুইটি স্তর ডি-একটিভ হলেও একটি স্তর থাকতে পারে একটিভ। বিপত্তিটা বাধে তখনি। বুঝিয়ে বলছি, ধরুন জেগে উঠার পর প্রথম দুইটি স্তরের সুইচ অফ হলেও তৃতীয় স্তরটি তখনো সচল। তার মানে আপনি জেগে বুঝতে পারলেন আপনার মস্তিষ্ক সচল আছে, অনুভব করতে পারছেন সবকিছু কিন্তু কোনভাবেই শরীরের কোন পেশি নাড়াতে পারছেন না - অসাড় হয়ে পরে আছেন বিছানায়। এই সময় শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, হার্ট বিট কমে যেতে পারে, মনে হতে পারে কেউ আপনার বুকে চেপে ধরে আছে। আর এই সব কিছুর সাথে যোগ হয় "ভীতি"। ভয় পাওয়ার একটা বড় কারণ হল হেলুসিনেশন। রেম এর পেশি পক্ষাঘাত স্তর সচল থাকার কারণে মস্তিস্ক মনে করতে থাকে তার আবার স্বপ্নে ফিরে যাওয়া উচিত। চোখ খোলা অবস্থায় স্বপ্নে ফিরে যাওয়ার এই অবস্থাকে বলা হয় 'সাইকোটিক হেলুসিনেশন’। মানুষ তখন সেটাই হেলুসিনেট করে যা সে রাতে স্বপ্নে দেখেছিল। ধরুন আপনি রাতে স্বপ্নে দেখেছিলেন আপনার মা কে, সুতরাং হেলুসিনেশনের সময়ও দেখবেন আপনার মা আপনার পাশে হাঁটাহাঁটি করছে, বিছানার পাশে দাড়িয়ে হাসছে, এমনকি তখন এটাও মনে হতে পারে কোন ডাইনি "মা" বেশে এসে আপনার বুকের উপর চেপে বসেছে। এই ডাইনি কেই আমরা বলে থাকি বোবা ভুত। এখন বুঝতে পারছেন তো সুমনার আত্মীয়ের দেখা সেই ভুত আসলে হেলুসিনেশনের ফল।

স্লিপ প্যারালাইসিস মূলত কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বহু লোক তাদের জীবদ্দশায় এক দুইবার এই ঘটনার সম্মুখীন হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এমনটা ঘন-ঘন হতে পারে । তবে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে জিনগত কারণে।

স্লিপ প্যারালাইসিস মূলত কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বহু লোক তাদের জীবদ্দশায় এক দুইবার এই ঘটনার সম্মুখীন হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এমনটা ঘন-ঘন হতে পারে । তবে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে জিনগত কারণে। PER2 জিন সার্কাডিয়ান রিদম মেইনটেইন করার জন্য দায়িত্বরত। এই জিন এক্সপ্রেশনের কম বেশি থেকে হতে পারে স্লিপ প্যারালাইসিস। এবং পরিবারের কারো এই সমস্যা থাকলে তা প্রবাহিত হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মে। স্লিপ প্যারালাইসিস মারাত্মক কোনও রোগ নয় এবং এর তেমন কোন প্রতিরোধ নেই। কী কারণে হতে পারে তা আগেই বলেছি, জেট-লেগ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, ঘুমহীনতা, কেউ কেউ আবার বলে থাকেন চিত হয়ে ঘুমালে প্যারালাইজড হতে পারেন আপনি। কারো যদি খুব ঘন ঘন স্লিপ প্যারালাইসিস হয় সেক্ষেত্রে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই ভালো। তবে সমাধান কিন্তু আপনার হাতেই। আপনার প্রতিটা রাত হোক দুশ্চিন্তা-মুক্ত, শান্তিপূর্ণ। তবেই বাঁচতে পারবেন এই বোবা ভূতের কবল থেকে।


প্রাসঙ্গিক লেখা