পুরাণ সারসংক্ষেপ - ভূমিকা পর্ব (১ম অংশ)
প্রতিটি প্রাচীন জাতির পুরাণ আছে। এমন কোন পুরাতন জাতি নেই, যার পুরাণ নেই। তবে সব পুরাণ কালের প্রবাহে টিকে থাকে নাই। যেমন বিশাল গ্রিক বা রোমান পুরাণ এখন শুধুই বইপুস্তকেই সীমাবদ্ধ। একইভাবে কেল্টিক, সুমেরীয়, আসেরীয়, আরব্য, পারস্য কোন পুরাণই এখন আর বই পুস্তক ছাড়া আর কোথাও চর্চিত হয় না। এদিক থেকে ব্যতিক্রম হল ভারতীয় পুরাণ। হিন্দু ধর্মের অবস্থানগত কারণে এখনো এ পুরাণ টিকে আছে। আবার বিভিন্ন সাহিত্যের উপাদান হিসেবেও এটি এসেছে ব্যাপকভাবে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের লেখায় পুরাণ যেভাবে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে, তা বোধ করি বাংলা ভাষাভাষি আর কোন কবি বা লেখকের লেখায় আসে নি। তবে আমাদের এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, একটি সাধারণ সংক্ষিপ্ত পরিচয় বা সূচীপত্র হিসেবেই আমরা এখানে তুলে ধরছি এ ভারতীয় পুরাণগুলো। স্মতর্ব্য যে, পুরাণের সংখ্যা-শ্লোক-ব্যাখ্যা ইত্যাদি কালের বিবর্তনের কারণে এবং মতান্তরে অবিসংবাদিত কোন বিষয় নয়।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মশাস্ত্র বেদ। কিন্তু প্রধান হলে কি হবে, বিধির বিধানে এ বেদে শুধুই বর্ণশ্রেষ্ঠদের নিদান! অর্থাৎ, বেদ ছিল শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের জন্য। তাতে অন্য বর্ণ এবং নারীর প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ফলে বেদ যত না হল ভক্তিশাস্ত্র, তারচে’ বেশি হল ভয়ের অস্ত্র। অনেক পরে যাও বা এলো উপষিনদ, তার ভাব ভাষা এত খটোমটো আর দার্শনিক তত্ত্বগুলো এত উচ্চমার্গের যে, সাধারণ বা স্বল্পবিদ্যার মানুষের কাছে তা বেদের চেয়েও বেশি অধরা হয়ে গেল। এতে ভগবানের কিছু এসে যাক বা না যাক, অনেক কিছুই এসে গেল ব্রাহ্মণদের। কারণ, বাকি ত্রি বর্ণের মানুষ যদি ধর্ম বুঝতেই না পারল তবে ব্রাহ্মণদের কী মর্যাদা তা টের পাবে কী করে ? তখন ধর্মের অনুশাসন, ব্যাখ্যা, সামাজিক রীতিনীতিগুলো মানুষের কাছে সহজ করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আবির্ভূত হল এক মিশ্র সাহিত্য। এতে মিশিয়ে দেয়া হল ইতিহাস, ধর্মীয় বিধান, রূপক ব্যাখ্যা, কাহিনি, উপাখ্যান। সাহিত্যের সাথে সাথে যেন ধর্মের ব্যাখ্যাও হয়, তাই এতে আরো মিশিয়ে দেয়া ধর্মের চরিত্রগুলো। এটাই পুরাণ। ধর্ম না হয়েও যেন এক ছায়া-ধর্ম হয়ে গেল পুরাণ বা পৌরাণিক কাহিনিগুলো।
তাহলে প্রশ্ন হল - শুধুই কি ধর্মের ব্যাখ্যা সহজ করার জন্যই পুরাণের উদ্ভব ? এর জবাবটা একটু পেছন থেকে এগোতে হয়। বৈদিক যুগে ধর্মে দেবমুর্তির প্রয়োজন ছিল না। তখন ধর্ম ছিল যাগযজ্ঞ, হোম আর আহুতি নির্ভর। কিন্তু যজ্ঞের ঘি খাওয়া সে আগুনের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলা আর দুর্বোধ্য সংস্কৃত মন্ত্রে কানে তালা লাগানো ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে আর কোন অনুভূতি তৈরি হত না। ব্রাহ্মণেরা দেবতার দেখা বা ছোঁয়া কতটুকু পেত তা তারাই জানে ; কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে যজ্ঞের কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠে যতক্ষণ পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে না যায়, ততক্ষণ এক ভগবানের চেহারা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা চলত। কথায় বলে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল। তাই মনের আড়ালে ভগবান যাতে চলে না যায় সে জন্য এবং সাধারণ মানুষের মনের ভেতর দেবতাকে ঠাঁই দেয়ার জন্য এ পূজা রীতিকে সাকার মূর্তি আর ব্রতকেন্দ্রিক করে সহজ করে দেবদেবীদের মানবায়ন করা শুরু হয়, শুরু হয় অলৌকিক দেবগণের লৌকিক রূপায়ন। অগ্নি, বরুন, সূর্য প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্থানে আবির্ভূত হন চন্ডী, দূর্গা, গণেশ প্রভৃতি সাকার দেবতা। এদের ভেতরে দেয়া হয় মানবীয় দোষ-গুণ-হিংসা-প্রেম-কাম ; আর কোন কোন মানুষকে ঋষি-মুনির পরিচয়ে তাদের ভেতর আরোপ করা হল দেবত্ব। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এ দেবদেবীরা খুব দ্রুত আপন হয়ে ওঠে। এতে সাধারণ মানুষ দেবতাদের সঙ্গে নিজেদের দূরত্ব ভুলে দেবতার আদর্শ নিজের জীবনে অনুসরণের প্রেরণা লাভ করে।
এত গেল ধর্মীয় দিক। এর পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণও ছিল। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান, প্রসার এবং আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ফলে হিন্দুধর্ম বিপন্ন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আবার মৌর্য সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম প্রায় সরকারি ধর্মের মত হয়ে পড়লে হিন্দু ধর্ম মরণাপন্ন রোগীর পর্যায়ে চলে যায়। তখন কিছু হিন্দু সমাজপতিরা উদ্যোগ নেন হিন্দু ধর্মকে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ করতে, আবার একই সাথে এর বিধিনিষেধ, প্রথাগুলোকে সহজবোধ্য করতে। যেহেতু গল্পকাহিনি মানুষ সহজে পছন্দ, গ্রহণ এবং স্মরণ করতে পারে, তাই গল্পকথার প্রাধান্য দিয়ে তারা রচনা করেন বিশাল পৌরাণিক সাহিত্য। সৃষ্টি হয় পুরাণ।
এ পুরাণ যে উদ্দেশ্যেই ব্যবহার হোক না কেন, এটা পরবর্তীতে মিশে গেছে আমাদের জীবনবোধের সাথে, জীবনপ্রণালীতে, জীবনধারাতে। আমাদের প্রতিদিনের ছোটখাট বিভিন্ন খুঁটিনাটি ঘটনার ব্যাখ্যাও পুরাণে পাওয়া যেতে লাগল গল্পের মাধ্যমে। ফলে তা একসময় ধর্মপুস্তকের চাইতেও বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠে, এবং আজও। পুরাণের বিভিন্ন কাহিনি-আখ্যান-উপাখ্যানগুলো হয়ে গেল আমাদের কথা-লেখা-সাহিত্যের অঙ্গ ; তা সে সরাসরি হোক, বা পরিবর্তিতরূপে। যেমন আমরা শৈশব হতেই শুনে আসছি চাঁদ মামা, সুয্যি মামার কথা। প্রশ্ন হল কোন রিস্তেদারীতে এরা আমাদের মামা হয় ? উত্তর আছে পুরাণে। লক্ষ্মীদেবী হলেন মাতা। আর ক্ষীরোদসাগরসম্ভূত চন্দ্র তাঁর সহোদর ভ্রাতা। সেই সূত্রে চাঁদ আমাদের মামা। এবার আসি সুয্যি মামার ঠিকুজি খুঁজতে। বিষ্ণু পুরাণমতে - প্রলয়কালে যখন এক ব্রহ্ম ছাড়া আর কেউ ছিল না, সে সময়ে ব্রহ্মার ক্ষোভ থেকে আদিত্য ও দেবগণ আবির্ভূত হলেন। আদিত্য হল সূর্য। যে মহার্নবের একটি ক্ষুদ্র অংশ ক্ষীরোদসাগর থেকে চন্দ্রের জন্ম, সে মহার্নব থেকেই সূর্যেরও জন্ম হল। ফলে সূর্য-চন্দ্র দুই ভাই। তাই, চাঁদ যেহেতু মামা, সুয্যিও মামা।
কিংবা, আমাদের অতি বাল্যকালের একটা ছড়ার কথাই বলি-
“আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে / ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলী / ঢুলী গেল কমলাফুলি।
কমলাফুলির টিয়েটা / সূয্যিমামার বিয়েটা।“
মুখে মুখে বিকৃত হয়ে যাওয়া ছড়াটির এবার আসি মূল ছড়ায় -
“আগডোম বাগডোম, ঘোড়াডোম সাজে / লাল মেঘে ঘুঙুর বাজে।
বাজাতে বা্জাতে চলল ঢুলী, / ঢুলী গেল কমলাপুলি।
কমলাপুলির টিয়েটা / সুজ্জিমামার বিয়েটা।“
বর্ষা শেষ হয়েছে। এমনি একদিন সন্ধ্যা কালে এক তেজস্বী ঘোড়ায় চড়ে সূর্য ঠাকুর বিয়ে করতে চলেছেন। বেগবান অশ্বের গতিতে তার গায়ে পরানো স্বর্ণের সূক্ষ্ম জাল হতে এক ঝঙ্কার ধ্বনি আসছে। অশ্বের খুরের আঘাতে চারদিকের মেঘের ধুলায় লালে লাল। লাল আভায় পশ্চিমাকাশ রাঙ্গা। আর রথের চাকার আওয়াজ অর্থাৎ ঘাঘর যেন ঘুঙুরের মত ছন্দময়। অশ্বের সামনে সামনে ডোমেরা যাচ্ছে (সে কালে ডোমেরা সহিস ও সৈন্য হত)। আগ ডোম বা আগে থাকা ডোমেরা সামনের ভক্তজনতাকে সরাচ্ছে, বাগ ডোম অর্থাৎ বাদক ডোমেরা নানান বিয়ের বাদ্য নিয়ে আগাচ্ছে। তার পিছনে ঘোড়া ডোম অর্থাৎ অশ্বারোহী সেনারা সূর্যদেবের আগে আগে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য কমলাপুলি ( কমলাপুরী, কমলালয়, আকাশ-সমুদ্র ) পৌঁছানো , সেখানে অপেক্ষায় আছে ‘টিয়েটা’ অর্থাৎ বিয়ের ‘ঝিয়েটা’ ( মেয়েটা বা পাত্রীটার অপভ্রংশ রূপ)। মার্কন্ডেয় পুরাণে আছে 'ছায়া' নামে (ঋগ্বেদে নাম আছে – সবর্ণা) এক কন্যার সাথে কমলাপুরীতে এক সন্ধ্যাকালে সূর্য দেবের সাথে বিবাহ হয়েছিল।
এভাবেই পুরাণ আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর জীবনের সাথে মিশে আছে, অলক্ষ্যে।
( ভূমিকা পর্ব , ১ম অংশ সমাপ্ত )