মোগলনামা - ৩


হিন্দুস্তান। অর্থাৎ হিন্দুর দেশ। কিন্তু শাসন ক্ষমতায় হিন্দু ছিল কতদিন? এক সময়ে এ ভূখণ্ডে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের জয়জয়কার। আর, বাবর যার কাছ থেকে হিন্দুস্তান ছিনিয়ে নেন, সেই ইবরাহীম লোদিও ছিলেন মুসলমান। তবু মোগল কিংবা সুলতানি আমলের ইতিহাস পড়তে গেলে এই ভূখণ্ডের নাম হিন্দুস্তান হিসেবেই চোখে পড়ে। তবে, আমি 'ভারতবর্ষ' লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ভ্যাঁপসা গরমের এই ভূমি অধিকার করে বাবর দেখলেন এখানকার লোকেরা নিরাকার প্রভুর উপাসনা করে না। বরং তাদের উপাসনালয়ে প্রচুর অদ্ভুত মূর্তি দেখা যায়। এদের কারও দশ হাত, কেউ নগ্নিকা। এক পুরুষের হাতে ত্রিশুল, গলায় সাপ। কালো পাথরের এক মূর্তিকে তারা লিঙ্গ বলে এবং লিঙ্গের পূজা করে।

হিন্দুদের প্রধান উপাসককে পুরোহিত বলা হয়। এরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পড়ে আর ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধু একটা সুতো কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত আড়াআড়ি জড়ানো। গরুকে তারা ‘মা’ হিসেবে ভক্তি করে। এসব দেখতে দেখতে বাবর অবাক হয়ে যান। ভারতের হিন্দুদের উপাসনালয়ের নাম মন্দির। অবাক মোগলরা লক্ষ্য করে, মন্দিরের দেওয়ালে প্রচুর চিত্র অঙ্কিত। সেখানে যুদ্ধ, রমণ কোন কিছুর বাছবিচার নেই। অদ্ভুত মানুষদের অদ্ভুত উপাসনালয়। মসজিদ তো দূরে থাক, ইসলাম ধর্মেই চিত্রাঙ্কন, মূর্তি তৈরিতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। অথচ, ভারতবর্ষ জুড়ে এমন অনেক মন্দির, স্থাপনা। বাবর অবশ্য ভারতবর্ষের খুব বেশি কিছু দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন নি। অকালে চলে গিয়েছিলেন। অনেকটাই দেখেছিলেন হুমায়ূন, বাবুরের প্রথম পুত্র। হুমায়ূন, অর্থাৎ সৌভাগ্যবান। বাবর যখন সাম্রাজ্য হারিয়ে যাযাবর জীবনযাপন করছিলেন, সেই সময়ে, ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ হুমায়ূনের জন্ম। বাবর তার পুত্রকে সৌভাগ্যের সূচনা হিসেবে দেখেছিলেন। তাই পুত্রের নাম রেখেছিলেন সৌভাগ্যবান। বাবর নিজেকে নিয়তির হাতে চালিত বলে ভাবতেন। এক মহান নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে চলেছে কোন এক লক্ষ্যে। তার এ চিন্তা নতুন কিছু নয়। রাজরক্ত যাদের শরীরে, তাদের চিন্তা অনেকটা এরকমই হয়। তাছাড়া, বাবুরের মাঝে একজন কবি বাস করতেন, তার জন্য এমন ভাবনাই স্বাভাবিক। কিন্তু হুমায়ূন শুধু কবি ছিলেন না, তিনি একজন স্বাপ্নিক।

হুমায়ূন ছিলেন যুগপৎ খেয়ালী এবং কৌতূহলী। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি তাঁকে আরও কৌতূহলী করে তোলে। সেই সঙ্গে দরবারের অমাত্যরা তাঁর কৌতূহলের সুযোগ নিয়ে তাঁকে আরও প্রভাবিত করেন।

তৎকালীন 'হিন্দুস্তান', অর্থাৎ ভারতবর্ষ ছিল নানা সংস্কারে ভরা। সেটা ‘কু’ হোক, কিংবা ‘সু’। জ্যোতিষবিদ্যা, তন্ত্রমন্ত্র সাধনা, অলৌকিক কারবারের অন্ত ছিল না এখানে। অতি কৌতূহলী হুমায়ূন এমনিতেই জ্যোতিষ বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি উলুঘ বেগকে (তৈমুরের নাতি, যিনি তার পুত্রের হাতে নিহত হন) গুরু মানতেন। উলুঘ বেগের তৈরি করা নক্ষত্রের গতিবিধির নকশা তিনি অধ্যয়ন করতেন।। তিনি বিশ্বাস করতেন যে আকাশের তারার মাঝে সব প্রশ্নের উত্তর আছে। আছে ভবিতব্য। হুমায়ূন ছিলেন যুগপৎ খেয়ালী এবং কৌতূহলী। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি তাঁকে আরও কৌতূহলী করে তোলে। সেই সঙ্গে দরবারের অমাত্যরা তাঁর কৌতূহলের সুযোগ নিয়ে তাঁকে আরও প্রভাবিত করেন। যদিও বাবুরের মৃত্যুর আগেই হুমায়ূন দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তার আগ্রহ ছিল জ্ঞান অর্জনে। পিতার রোজনামচা পড়তে খুব ভালবাসতেন। ভাবতে পছন্দ করতেন। কিন্তু একজন সম্রাট ভাবালুতায় ডুবে যেতে পারেন না। এতে শাসন কাজ থমকে যায়। বেড়ে যায় ষড়যন্ত্র। ভাবালু সম্রাটকে সহজেই ভুল পথে চালিত করা যায়। হুমায়ূনের শাসনকালেও তা-ই হয়েছিল। এবং সেই সঙ্গে ছিল সৎ ভাইদের সিংহাসনে বসানোর জন্য সৎ মায়েরদের ষড়যন্ত্র। প্রথম জীবনে হুমায়ূনের দরবারে দুই একজন ছাড়া খুব বিশ্বস্ত কেউ ছিল না। তবে কিশোর বাবরকে যেমন তাঁর নানী পথ দেখিয়েছিলেন, হুমায়ূনকে পরামর্শ দিতেন তাঁর ফুফু খানজাদা বেগম।

ইতিহাসের একটা স্রোত হুমায়ূনকে খেয়ালী হিসেবে দেখায়, অন্য একটি স্রোত বলে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর। ভাইদের প্রতি তিনি কঠোর হয়েছিলেন। কিন্তু এর পেছনেও হয়ত কোন কারন আছে। তার আগে দেখা যাক, খেয়ালী হুমায়ূন খেয়ালী বলে কেন পরিচিত। জ্যোতিষ বিদ্যায় আগ্রহী হুমায়ূন একসময় ভাবতে শুরু করেন যে একমাত্র তারারাই তাঁকে সাহায্য করতে পারে। তাই তিনি দরবারে এক নতুন নিয়ম চালু করলেন। গ্রহ নক্ষত্র আঁকা কার্পেট স্থাপন করলেন দরবারে। নিয়ম হল যে দিন যে গ্রহের সাথে সম্পর্কিত সেইদিন সে অনুসারে কাজ পরিচালিত হবে। যেমন- রবিবারকে পরিচালনা করে সূর্য, যা সার্বভৌম ক্ষমতার নিয়ন্তা। তাই প্রতি রবিবার হুমায়ূন উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের পোষাকে সজ্জিত হয়ে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম করবেন। সোমবারের নিয়ন্তা চন্দ্র, সেদিন অবসর সময় কাটানো হবে এবং পোশাকের রঙ হবে সবুজ। মঙ্গলবার, সৈন্য ও যুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তকতকে লাল রঙের পোশাক সেদিনের জন্য নির্ধারিত। এদিন ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত এবং বিচারের মাধ্যমে দশিকে কঠোর সাজা দেওয়া হবে। শনিবার শনি গ্রহের সঙ্গে এবং বৃহস্পতিবার বৃহস্পতি গ্রহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদিন ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা হবে। বুধবার হবে আনন্দচ্ছল এবং এদিন উজ্জ্বল বেগুনী বর্ণের পোষাকে সজ্জিত হতে হবে। হুমায়ূন দরবারে এই নিয়ম বলবৎ করেন। তিনি সহ সমস্ত সভাসদদের এই নিয়ম মানতে হবে। এবং কোন সভাসদ যদি কোন কথা বলতে চায় তবে তাঁকে ওই দিনের জন্য নির্দিষ্ট গ্রহের উপরে দাঁড়িয়ে (গ্রহ অঙ্কিত কার্পেট দরবারে বিছানো হয়েছিল) তা উপস্থাপন করতে হবে।

হুমায়ূন ক্রমেই শাসন ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যের প্রধান হিসেবে তাঁর করনীয় কাজ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেন। বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা এখন উদ্ভট সব নিয়মে তাঁর দরবার ভরপুর হয়ে ওঠে। এবং এ থেকে লাভবান হয় কিছু মানুষ। মূলত তিনি সে সময়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। একটা সময়ে বাবরও প্রচুর সুরা পান করতেন। পরবর্তীতে তিনি নেশা থেকে সরে এসে শক্ত হাতে তলোয়ার ধরেছিলেন। মাদকের প্রভাব মোগলদের উপর সব সময়েই ছিল। পরবর্তী মোগল সম্রাট শাহজাদা, প্রায় কেউই পান-দোষ মুক্ত ছিলেন না। হুমায়ূনকে এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রান দিতে এগিয়ে আসেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত তার ফুফু খানজাদা বেগম। তিনি কর্তৃত্বের সাথে হুমায়ূনকে শাসন করেন এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে হুমায়ূন ভুল করছে। অনেক চেষ্টার পর হুমায়ূন নিজের ভুল বুঝতে পারে। ততক্ষণে শের শাহ নামক এক সুবেদার প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সাধারণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি করে এক সময় বাংলা-বিহার অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন এবং মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে দাঁড়ান।  শের শাহ্‌কে দমন করতে বিশাল বাহিনী নিয়ে হুমায়ূন যাত্রা করেন। নদী তীরে শিবির স্থাপন করে যখন মোগল বাহিনী নিদ্রিত, তখন বৃষ্টির সুবিধা নিয়ে শের শাহ্‌র সেনারা মুঘল শিবির আক্রমণ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল হুমায়ূনের জেনানা তাবু। চতুর শের শাহ্‌ভেবেছিল এই তাবু আক্রমণ করে যুদ্ধ শুরুর আগেই সে হুমায়ূনকে পরাস্ত করবে। কিন্তু মোগল বিক্রমে সে যাত্রা রক্ষা পায় জেনানাবৃন্দ। এবং তাদের একটি দ্রুতগামী নৌকায় আগ্রা পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

জুন ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দ। মোগলরা হিন্দুস্তানের আবহাওয়ার যে জিনিসটি সবচেয়ে অপছন্দ করত, তা বৃষ্টি। আর এই বৃষ্টিই হুমায়ূনের কাল হয়। হিসেবের আগেই এসে হাজির হওয়া বৃষ্টির কারনে শের শাহ্‌সুযোগ নিয়ে চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূনকে পরাস্ত করেন। আহত হুমায়ূনকে লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে এক কিশোর। সে হুমায়ূনের শিবিরে ভিস্তিওয়ালার কাজ করত। ছাগলের চামড়ার মশক ফুলিয়ে আহত হুমায়ূনকে নদী পার করে তাঁর অমাত্যদের কাছে পৌঁছে দেয় সে। এই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে হুমায়ূন তাঁকে এক দিনের সম্রাট করার ঘোষণা দেন। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে শের শাহ্‌র কাছে আবার পরাজিত হন হুমায়ূন। কনৌজের এ যুদ্ধ তাঁকে হিন্দুস্তান ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু যে শের শাহ্‌র জন্য হুমায়ূনের এই দশা, সে আসলে কে? ছোটবেলায় পড়েছি, “শের শাহ্‌উপমহাদেশে ঘোড়ার ডাক প্রচলন করেন”। মানে এর আগে কি উপমহাদেশে ঘোড়া ডাকতে জানত না (!)। আবার এই ভদ্রলোকের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের নাম শূর সাম্রাজ্য। তার মানে হাতী জিনিসটা তাঁর প্রিয় ছিল। তাই নিজের সাম্রাজ্যের নাম রাখেন ‘শুঁড় সাম্রাজ্য’?

শের শাহ্‌আদতে একজন পশতুন (সাধারণত পশতু ভাষাভাষী আফগান ও পাকিস্তানীদের পশতুন বলা হয়)। ১৪৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বিহারের সাসারামে তাঁর জন্ম। তিনি একজন সাধারণ সেনা হিসেবে বাবুরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং নিজ গুণে বিহারের শাসক পদ অধিকার করেন। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ্‌বাংলা আক্রমণ করেন এবং গিয়াসুদ্দিন শাহ্‌কে পরাজিত করে বাংলায় নিজের আধিপত্য কায়েম করেন। অতঃপর ১৫৩৯ এ চৌসার যুদ্ধ এবং ১৫৪০ এ কনৌজের যুদ্ধের পর তিনি হুমায়ূনকে খেঁদিয়ে দিল্লীতে রাজধানী স্থাপন করেন। শের শাহ্‌র এই বিজয়ের পেছনে অনেক কারন ছিল। প্রথমত তিনি ছিলেন কুশলী এবং দক্ষ যোদ্ধা। বাবর যেমন বারবার পরাজিত হয়েছিলেন শায়বানির কাছে, হুমায়ূনকে তেমনি ঘোল খাইয়েছেন শের শাহ্‌। দিল্লী অধিকার করে শের শাহ্‌নিজেকে 'পাদিশাহ্‌' ঘোষণা করেন। তিনি রুপিয়া নামে ১৭৮ গ্রেইনের রৌপ্যমুদ্রা (এই রুপিয়া থেকেই বর্তমান রুপির আগমন) এবং মোহর নামে ১৬৯ গ্রেইনের স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন।  তিনি গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড নামে যে রাস্তা তৈরি করেন তা সবারই জানা। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা এ রাস্তার সংস্কার করে। শের শাহ্‌হুমায়ূনের ‘দিনা-পানাহ’ শহরের উন্নতি করে এর নাম ‘শেরগড়’ রাখেন। শুধু তাই-ই নয়, তিনি পাটনা অর্থাৎ পাটলিপুত্রেরও সংস্কার করেন তাঁর নির্দেশে সড়কের নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সরাইখানা নির্মাণ করা হয়। এই সরাইখানা সমূহে পথিকদের বিশ্রামের ব্যবস্থার সাথে সাথে আস্তাবলের ব্যবস্থা রাখা হয়। বার্তাবাহকেরা এসব সরাইখানায় এসে পরিশ্রান্ত ঘোড়া বদলে নতুন ঘোড়া নিয়ে বার্তাসহ এগিয়ে যেতেন। এর ফলে তুলনামূলক কম বার্তা প্রেরণ সম্ভব হয়েছিল। এটিই শের শাহ্‌র প্রচলিত ‘ঘোড়ার ডাক’। শের শাহ-র শাসনে দিল্লী তথা ভারতের সমাজ জীবন, অর্থনীতি, রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। তাঁর শাসনকে সু-শাসন বলতে কোন ঐতিহাসিক দ্বিধা করেন নি। শুধু তা-ই নয়, শের শাহ্‌র গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে বলবৎ থাকে।

তো, শের শাহ্‌যখন তাঁর ঘোড়াকে ডাক শেখাতে ব্যস্ত, তখন হুমায়ূনের কি দশা...? আর কেনই বা শের শাহ্‌র কাছে তাঁর এমন পরাজয়...? জানতে হলে চোখ রাখুন আগামী পর্বে...

 


প্রাসঙ্গিক লেখা