মোগলনামা - ২


একটা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ এবং তা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন যোগ্য উত্তরাধিকারী। তাই প্রায় সব সাম্রাজ্যের মত মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরও একটি যোগ্য পুত্র কামনা করতেন। বাবরের প্রথম সন্তান হুমায়ূন। পানিপাতে তরুণ হুমায়ূন ছিলেন কুশলী সেনাপতি। পিতার পাশে থেকে তিনি দিল্লী বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধু যোদ্ধা হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার। গোয়ালিয়রের এক রাজ পরিবারের সম্মান রক্ষার স্বরূপ হিসেবে সেই রাজ পরিবার তাঁকে একটি হীরা উপহার দেয়। যার নাম কোহ-ই-নূর, বা আলোর পর্বত। এই হীরাটিই ইতিহাসের সেই বিখ্যাত 'কোহিনূর'। পিতা-ভক্ত হুমায়ূন হীরাটি তাঁর পিতা বাবরকে উপহার দেন।

দিল্লী জয় করেই আসলে হিন্দুস্তান অধিকার হয়ে যায়নি। সত্যি বলতে হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষকে মোগল শাসনে আনতে পেরিয়ে গেছে তিন পুরুষ। বাবরের দ্বিতীয় অধস্তন, আকবরের সময়েই প্রকৃতপক্ষে সমগ্র ভারতবর্ষে মোগল শাসন কায়েম হয়। বাবর ছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ। ভারতের এই গরম, ভ্যাঁপসা আবহাওয়া, তাঁর ভালো লাগেনি। ভারতকে আপন করে নিতে পারেননি তিনি। এমনকি তাঁর সেনাপতি, অমাত্যরাও এই ভূমিতে থাকতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তৈমুরের মত রাজ্য লুঠ করা বাবরের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি একটি সাম্রাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লী জয় করলেও সে সাম্রাজ্য স্থাপন সহজ ছিল না।

রাজ্য লুঠ করে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য না থাকলেও তিনি ছিলেন 'বিদেশী'। আর সেই বিদেশী শক্তিকে উৎখাত করার জন্য সমর সজ্জা করে রাজপুত সংগ্রাম সিংহ, যিনি রানা সাঙা নামেও পরিচিত। রানা সংগ্রাম সিংহের ইচ্ছে ছিল বাবরকে পরাজিত করে দিল্লী এবং আগ্রাকে রাজপুত পতাকার অধীনে নিয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করা। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে বাবরের বাহিনীর সাথে রানা সাঙার যুদ্ধ হয়। রানা সাঙা ভেবেছিলেন বাবরকে হারানো সহজ হবে কিন্তু বাবরের কামান এবং উন্নত রণকৌশলের কাছে তিনি পরাজিত হন। কে ভি কৃষ্ণ রাও লিখেছেন, "উন্নত রণকৌশল এবং দক্ষ সৈন্যাপত্য বাবরের জয়ের কারণ"। রাও আরও লেখেন যে ৬০০০ সৈন্য সহ রাজা শিলাদিত্যর বাবরের বাহিনীতে যোগদানও রানা সাঙার পরাজয়ের কারণ।

জীবনে ছোট বড় অনেক যুদ্ধ করেছিলেন বাবর। শেষ দুই যুদ্ধে তিনি পেয়েছিলেন বড় জয়। ধীরে ধীরে তিনি একটি সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। 'পাদশাহ' বাবর কবি ছিলেন। কাজের ফাঁকে বসে পড়তেন তাঁর রোজনামচা লেখার কাজে। সিংহাসন হারিয়ে তিনি এক সময় প্রচুর সূরা পান করতেন। হিন্দুস্তান আক্রমের পূর্বে তিনি সূরা পানের পরিমাণ কমিয়ে আনেন। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়ছিলো। নতুন সাম্রাজ্যের আবহাওয়া, রীতিনীতি, মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। শত্রু ছিল তাঁর আশেপাশে। ইবরাহীম লোদির প্রতিশোধপরায়ণ মা, কৌশলে বাবরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। অথচ ইব্রাহীম লোদীর মা এবং পরিবারকে বাবর সম্মানজনক স্থানই দিয়েছিলেন। হত্যা চেষ্টার পর তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মানুষ হিসেবে বাবর ক্ষমাশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন। তৈমুরী নৃশংসতা থাকা সত্ত্বেও বাবর ছিলেন কবি। আর তাঁর ভেতরে ছিল ভালোবাসার প্রস্রবণ। পুত্রদের তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হুমায়ূনের প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভরসা এবং স্নেহ। কিন্তু ধীরে ধীরে পুত্রের সাথে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়। হিন্দুস্তান বিজয়ের পর হুমায়ুন একা হয়ে পড়তে শুরু করেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে হুমায়ূনের ছিল ভীষণ আগ্রহ। তিনি সেসব নিয়ে পড়াশোনা করতেন এবং তাঁর প্রিয় জ্যোতিষীর সঙ্গে বেশি সময় কাটানো শুরু করেন। সম্ভবত তিনি সে সময়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। বাবরের সঙ্গে হুমায়ূনের সম্পর্ক খুব ভালো থাকলেও তাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। ঠিক এমন সময় হুমায়ূন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। হুমায়ূনের চিকিৎসা চলতে চলতে তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু কথা জানা যাক।

মোগলদের কথা জানতে গেলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের কথা জানতে হবে। জানতে হবে সেখানকার অন্যান্য রাজপরিবারের কথা। ইব্রাহীম লোদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং খানুয়ার প্রান্তরে বাবরের পাশে পাশেই ছিলেন পুত্র হুমায়ূন। ১৫২৭ এ খানুয়ায় রানা সাঙার মৃত্যু হলে মেবারের সিংহাসন, তাঁর পুত্র বিক্রমাদিত্যের অধিকারে আসে। কিন্তু বিক্রমাদিত্য ছিলেন দুর্বল এবং অল্প বয়স্ক। তাই মেবারের রানী কর্ণবতী তাঁর অভিভাবকত্ব করেন। গুজরাটের বাহাদুর শাহ্‌ কর্তৃক মেবার আক্রান্ত হলেও মেবারের অমত্যরা দোলাচালে ছিলেন। রানী কর্ণবতী তখন তাদেরকে বিক্রমাদিত্যদের জন্য না হলেও মেবার এবং সিসোদিয়া বংশের খাতিরে লড়াই করতে বলেন। যদিও তাঁর স্বামী বাবরের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দেন, তবু রানী কর্ণবতী 'রাখী বন্ধন' উপলক্ষে হুমায়ূনকে রাখী পাঠিয়ে তাঁকে ভাই হিসেবে সম্বোধন করেন। রানী কর্ণবতীর এই রাজনৈতিক মৈত্রীর চেষ্টা থেকে একটা জিনিস বোঝা যায়, তিনি হুমায়ূনের সামর্থ্যের উপর ভরসা করতেন।*১  

ইব্রাহীম লোদীর পরিবার কর্তৃক বাবরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হলেও বাবর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার প্রায় সাথে সাথেই হুমায়ূন জ্বরে আক্রান্ত হয়। মুমূর্ষু হুমায়ূনের রোগ নির্ণয় করতে হাকিমরা ব্যর্থ হন। তখন দরবারের একজন আমীর, কিংবা এক দরবেশ বাবরকে জানান যে বাবর যদি তাঁর সবচেয়ে দামী সম্পদটি উৎসর্গ করেন, তাহলেই হুমায়ূন সুস্থ হয়ে উঠবে। এ কথা শুনে বাবর তাঁর পুত্রের প্রাণ রক্ষায় নিজের প্রাণ উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নেন।*২

কিন্তু বাবরকে আসলে বলতে চাওয়া হয়েছিল তিনি যেন কোহিনূর দান করেন। পরিবারের কারও অসুখে সম্পদ উৎসর্গের রীতি সমস্ত পৃথিবীতেই অনেক আগে থেকে চলে আসছে। এবং উৎসর্গকৃত এসব সম্পদ সাধারণত পুরোহিত, ধর্মীয় গুরু বা প্রভাবশালী আমলাদের হাতে আসে। সেই লোভ থেকেই বাবরকে এই তথ্য জানানো হয়। কিন্তু তা হলো না। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর মাত্র ৪৭ বছর বয়সে বাবর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁকে যেন ফারগানার কাছাকাছি সমাধিস্থ করা হয়। তাই কাবুলে এক সাদামাটা কবরে তাঁর সমাধি রচিত হয়। মৃত্যুর আগে তিনি হুমায়ূনকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেন এবং বলে যান যে হুমায়ূন যেন তাদের ভাইদের প্রতি কখনও কঠোর না হয়। পিতার কথা শিরোধার্য করে ২৯ ডিসেম্বর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে নাসির-উদ-দীন মুহাম্মদ হুমায়ূন আগ্রার সিংহাসনে বসেন। 

*১ঃ রানী কর্ণবতী ছিলেন ভারতের ইতিহাসের রাজপরিবারের কৌশলী এবং সচেতন নারীদের মধ্যে একজন। মোগলদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার রাজনৈতিক মৈত্রী তাঁর প্রজ্ঞার পরিচায়ক। রানী কর্ণবতী, রানা উদয় সিং-এর মা এবং কিংবদন্তী প্রতিম রানা প্রতাপের পিতামহী।
*২ঃ বাবরের এই প্রাণ উৎসর্গ নিয়ে নানা কাহিনী আছে যার সারবত্তা এখানে জানানো হয়েছে। শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে ভাবলে বলা যায় হুমায়ূন হয়ত ভারতবর্ষের 'বিখ্যাত' ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেই সঙ্গে ছিল মাদকের প্রভাব। আর বাবরের শরীর থেকে বিষক্রিয়া কখনও বিদায় নেয় নি। হুমায়ূন স্বাভাবিক নিয়মেই সেরে ওঠেন, এবং বাবর মারা যান বিষক্রিয়ায়। কিন্তু, সে সব যুক্তির চেয়ে পুত্রের জন্য পিতার প্রাণ উৎসর্গের গল্পই ভালো। তবে একথা সত্য যে বাবর সত্যিই পুত্রের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কথা বলেছিলেন। এখানেই বাবর মহান।

 


প্রাসঙ্গিক লেখা