ব্লকচেইনঃ যে প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে সব হিসেব


ডন এন্ড এলেক্স ট্যাপস্কট তাদের "ব্লক চেইন রেভুলুশ্যন" (Don & Alex Tapscott, authors of Blockchain Revolution, 2016) বইতে প্রথমবারের মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিভাবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল কারেন্সির অন্তরালে ফিয়াট কারেন্সি, বিজনেস এবং পুরো বিশ্বকে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি প্রযুক্তি বিশ্বের সাথে কোন না কোন ভাবে কানেক্টেড থাকেন, অবশ্যই শুনে থাকবেন 'ব্লক চেইন' শব্দটি। আধুনিক বিশ্বে এখন এটি শুধু একটি বাজওয়ার্ড ই নয়, এটাকে বলা হচ্ছে অনস্বীকার্য ভাবে একটি প্রতিভাধর উদ্ভাবন যেটা কিনা বিশ্ব অর্থনীতিতে রেভুলুশ্যন ঘটিয়ে দিচ্ছে। সাতোশি নাকামোতো নামের ছদ্মনামের এক বা একাধিক লোকের একটি গ্রুপের ব্রেইনচাইল্ড হলো এই ব্লকচেইন টেকনোলজি যেটা ২০০৯ সালে প্রযুক্তি বিশ্বে শুরু হয়।

ব্লক চেইন কী?

ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে থার্ড পার্টির সাহায্য ছাড়া গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে, গ্রাহক টু গ্রাহক লেনদেনের একটি মাধ্যমই এই ব্লক চেইন। ক্রিপ্টো কারেন্সি হিসেবে সর্বপ্রথম বিটকয়েনের ব্যবহার শুরু হয়। আরো সহজ ভাবে বলতে গেলে, ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার  করে দ্বিতীয় কোন পক্ষের সাথে তৃতীয় কোন মাধ্যম (থার্ড পার্টি)  ছাড়া সরাসরি বিনিময়  মাধ্যম এই ব্লক চেইন প্রযুক্তি। এখানে তৃতীয় পক্ষ বলতে বিদ্যমান লেনদেনে সাহায্যকারী ও অনুমতি প্রদানকারী মাধ্যম গুলোকে বলা হচ্ছে। যেমন, আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এ কোন বন্ধুর কাছে টাকা পাঠালে সেখানে ব্যাংক এর সাহায্য নেন যা মূলত থার্ড পার্টি অথবা দেশ থেকে বাইরে বৈধ ভাবে টাকা পাঠাতে সরকারের অনুমতি নিতে হয় যা ব্যতিরেক আপনি কারেন্সি আনা নেওয়া করতে পারেন না। আর এখানেই ব্লক চেইন প্রযুক্তি আপনাকে থার্ড পার্টির সাহায্য ব্যতিরেকে সহজেই লেনদেন করতে সাহায্য করবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে এখানে ডিজিটাল মানি কাজ  করে যার কোন ফিজিক্যাল উপস্থিত নেই। 

ব্লক চেইন  কেন এসেছে?

যেকোন অর্থনীতিতে লেনদেনের বিশ্বস্ত একটি মাধ্যম হলো থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ, যারা লেনদেনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি বিশ্বের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিপ্লব হিসেবে গন্য ইন্টারনেট প্রযুক্তি এই লেনদেন ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে। বিদ্যমান যোগাযোগ প্রযুক্তি গুলো লেনদেনকে অনেক সহজসাধ্য  করে দিয়েছে, তা সত্ত্বেও বেশ কিছু সমস্যা আধুনিক বিশ্ব এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, অধীনতা তেমন তিনটি সমস্যা। বিশ্বাস কে প্রযুক্তি বিশ্বে দুর্লভ ভাবা হয়। এইসব সমস্যার একটি গ্রহনযোগ্য সমাধান হিসেবে ব্লক চেইন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে এবং এটার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।

ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবহার করে থার্ড পার্টির সাহায্য ছাড়া গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে, গ্রাহক টু গ্রাহক লেনদের একটি মাধ্যম ই এই ব্লক চেইন।ক্রিপ্টো কারেন্সি হিসেবে সর্বপ্রথম বিটকয়েনের ব্যবহার শুরু হয়।

ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবহার করে থার্ড পার্টির সাহায্য ছাড়া গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে, গ্রাহক টু গ্রাহক লেনদের একটি মাধ্যম ই এই ব্লক চেইন। ক্রিপ্টো কারেন্সি হিসেবে সর্বপ্রথম বিটকয়েনের ব্যবহার শুরু হয়।

ব্লকচেইন  কেন আসলো তা বুঝার জন্য আমাদের একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। নব্বইয়ের দশকে মিডিয়া কে বলা হতো গুটি কিছু মানুষের নিয়ন্ত্রিত ব্রডকাস্ট মাধ্যম যেখানে বাকিরা ছিল দর্শক (ভিউয়ার)। পরবর্তীতে ইন্টারনেটের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার মিডিয়া কে ডিসেন্ট্রালাইজড করে দেয়। কিন্ত তা সত্ত্বেও সম্পদের সমঅধিকার ছিল না। আধুনিক যুগের সুযোগ-সুবিধাও অসম ছিল। যেমন, আমাদের বিশাল তথ্য ভান্ডার আছে কিন্তু তার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রন নেই। গুটি কিছু প্রতিষ্ঠান ও সরকার সেই তথ্য গুলোর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে। যদি এমন হয় যেখানে সত্যিকার অর্থে গ্রাহক টু গ্রাহক মূল্য বিনিময় করা যাবে অন্য তৃতীয় কোন সাহায্য ছাড়া যেটা আমরা এখনো পারি নাই, তা সত্যিকার অর্থে  হবে একটি চমকপ্রদ উদ্ভাবন। যেমন কেউ যদি অন্য কাওকে টাকা পাঠাতে চায় তাকে কোন থার্ড পার্টির সাহায্য নিতে হয় অথবা দেশের বাইরে হলে সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। যদি এমন হয় যেখানে সহজেই ইন্টারনেটের সাহ্যয্যে একজন অন্যজনের সাথে থার্ড পার্টির কোন রকম সাহায্য ছাড়া যাবতীয় ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারছে, সেটা একই থাকে নিরাপদ ও বিশ্বস্ত, এটা একটা বিস্ময়কর বিপ্লব হিসেবে ধরা হবে। আর সেটাই ঘটাতে যাচ্ছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি।

এটা সম্ভবত খুব কম মানুষ ই জানে যে- 'ক্রিপ্টোকারেন্সি' ব্লকচেইন উদ্ভাবনেরই একটা সাইড প্রোডাক্ট। ২০০৮ সালের একটি বিবৃতিতে সাতাশি নাকামো বলেন- "তার লক্ষ্য ছিল একটা গ্রাহক টু গ্রাহক ইলেক্ট্রনিক্স ক্যাশ সিস্টেম ডেভেলভ করা"। এরই ফলশ্রুতিতে ডিজিটাল কারেন্সি হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্ম হয়। এটার অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য হলো বিকেন্দ্রীকরণ (ডিসেনট্রালাইজেশন) যেখানে কোন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রন নেই । কেন্দ্রীয় অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারেন্সি সাপ্লাই ডিমান্ড নিয়ন্ত্রন করে, যেটা এখানে নেই। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডিজিটাল মানি হিসেবে এটার ব্যবহারে ক্রিপ্টোগ্রাফির ব্যবহার করা হয় যা এটার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং একই সাথে তা যোগাযোগ, তথ্য ও লেনদেন এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম  ডিসেন্ট্রালাইজড ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে বিটকয়েন সৃষ্টি করা হয়। ডিজিটাল সম্পদ হিসেবে পরিচিত এই ক্রিপ্টোকারেন্সির সংখ্যা ২০১৭ এর নভেম্বর পর্যন্ত ১৩২৪ এর উপরে দাড়িয়েছে এবং এটার সংখ্যা  ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো বিটকয়েন, লাইটকয়েন, বিটকয়েন ক্যাশ, রিপল, ইথিরাম ও ড্যাশ।

ইন্টারনেটের প্রথম যুগ কে বলা হতো ইন্টারনেট অব ইনফরমেশন। আমরা এখন যেই যুগে প্রবেশ করছি তাকে বলা হচ্ছে ইন্টারনেট অব ভ্যালু, যেটার ভিত্তি এই ব্লক চেইন। এটি মূলত এক ডিস্ট্রিবিউটেড শেয়ারড লেজার (যেখানে প্রতিনিয়ত হওয়া লেনদেন গুলোর তথ্য নেটওয়ার্কে যুক্ত সবার কাছে পৌছে যায়),  যেটা মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রাহক টু গ্রাহক কম্পিউটারের সাথে যুক্ত। কোন কেন্দ্রীয় কম্পিউটার এখানে ব্যবহার করা হয় না এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রন ও নেই। এটায় যেকোন ধরনের অনলাইন লেনদেন রেকর্ড রাখা হয় এবং লেনদেনের জন্য ব্লক ব্যবহার করা হয়। এভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন লেনদেনের ব্লক মিলেই ব্লক চেইন, যেখানে নেটওয়ার্কে যুক্ত সবার কাছে সংগঠিত লেনদেনের আপডেটেড কপি থাকে। স্টক, বন্ড, ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি থেকে শুরু করে  যেকোন ধরনের ডিজিটালাইজড ভ্যালু ট্রান্সফার করা যায় এই মাধ্যমে। বলা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি বর্তমান পৃথিবীতে আগামী দিনের সেকেন্ড রেভুলুশ্যন হয়ে দাঁড়াবে।

পরের পর্বে আমরা জানবো,  ব্লক চেইন কিভাবে কাজ করে।


প্রাসঙ্গিক লেখা