গল্প: আধুনিক পৃথিবী


বাসার কাজের মেয়েটা হঠাৎ করে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। জানি, এই কথাটা শোনার পর থেকে আপনারাও আমাকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করছেন। করেন, তাতে আমার আপত্তি নাই। ষোল বছর ধরে বিয়ে বসছি যে মেয়ের সঙ্গে সেই যখন সন্দেহের চোখে দেখছে তখন আপনাদের আর কী দোষ। আপনারা তো সবে দুই মিনিট ধরে আমার গল্প পড়ছেন। পড়তে থাকেন, সন্দেহও করতে থাকেন।

এই মুহূর্তে আমার প্রত্যেকটা সেকেন্ড কাটছে মারাত্মক টেনশনে। আমার অবস্থা-না পারছি কইতে না পারছি সইতে। আমি বললেই যে মানুষ শুনবে তারও নিশ্চয়তা নেই। পরশু দিন ছিল শনিবার। নীতার অফিস বন্ধ। কিন্তু আপনারা তো জানেন আমার অফিস খোলা। তাই আমি অফিসে আসছিলাম। এসে একটা ফুল কাপ কফি নিয়ে ডেস্কে বসে জাস্ট ফেসবুকটা খুলছিলাম। অমনি নীতার ফোন।

একটা বিরাট সমস্যা হইছে। এখনি বাসায় আসো।

কেন কী হইছে, বলার আগেই দেখি ফোন কাট। কলব্যাক করলাম। ফোন বিজি। মারাত্মক ব্যাপার। মনে মনে চিন্তা করলাম, তাহলে কি চাচা শ্বশুর সাহেব মারাই গেলেন। পরশুদিন হার্টের সমস্যা নিয়ে স্কয়ারে ভর্তি হয়েছিলেন। ইন্নালিল্লাহ বলেও বললাম না। মৃত্যুসংবাদ কনফার্ম না হয়ে ইন্নানিল্লাহ বলা ঠিক না।

বসের রুমে উঁকি দিয়ে বললাম, বাসা থেকে জরুরি কল আসছে। এখনি যেতে হবে ইমরান ভাই। শুনে ইমরান ভাই দেখি আমার চেয়ে টেনশনে পড়ে গেল। কেন কী কাহিনী। ভাবী অসুস্থ? কোনো দুঃসংবাদ?

আমি বললাম, ভাই আপনার ভাবী তো কিছু বলল না। খালি বলে তাড়াতাড়ি এসে পড়।

ভেরি আনলাইকলি। আপনি তাড়াতাড়ি যান। আর আমাকে কিন্তু জানাবেন কী হল।

অফিসের নিচে নেমে ২০০ টাকার সিএনজি ৩০০ টাকায় নিয়ে রওয়ানা দিলাম। পথে নানা টেনশন হচ্ছিল। রায়নার কিছু হল না তো?

নীতাকে আবার কল দিলাম। এবার ধরছে।

তুমি এখনও রওয়ানা দেও নাই? আওয়াজ গরম। তাড়াতাড়ি আসো।

এবার নীতার কণ্ঠ শুনে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। যতদূর মনে হচ্ছে ঘটনাটা আমাকে নিয়ে। আমি কী করছি। ড্রয়ারে ময়মুনার চিঠিগুলো লুকিয়ে রাখছিলাম। ছুটির দিন পেয়ে নীতা নিশ্চিত সানবিন করছে। ময়মুনার চিঠি পেলে সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা নাই সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। স্বামীর পুরনো প্রেম মেয়েরা সহজে সহ্য করতে চায় না। ময়মুনার জন্য খারাপই লাগতে শুরু করল। মেয়েটাকে বিয়ে তো করতেই পারলাম না। ষোল বছর ধরে ওর চিঠিগুলা লুকায়ে রাখছি। সেটাও মনে হয় আজ ধরা পড়ল। বাল, ভালো লাগে না। আপন মনেই বলে উঠলাম।

ঘরের দরজায় কলিংবেল চাপাও লাগল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীতা ফলো করছিল আমি কখন কিভাবে কিসে আসি। আমি দরজার সামনে দাঁড়াতেই চিচিংফাঁক। নীতা আমাকে নিয়ে সোজা বেডরুমে ঢুকে পড়ল। দেখলাম রায়না বসে আছে সোফায়। আর সুমী মেঝেতে বসে কাঁদতেছে। বেডরুমে ঢুকতে ঢুকতে আমি চিন্তা করলাম, জিনিশটা তাহলে রায়নাকে নিয়ে নয়। তাহলে হয়তো সুমী নীতার গয়না চুরি করেছে। ব্যাপার গুরুতর। তাই এই জরুরি তলব। সুমী মেয়েটা তো চোর ছিল না। হঠাৎ কী মনে করে চুরি করা শুরু করল। ভাবতে ভাবতেই দেখি নীতা কথা বলা শুরু করে দিছে।

সুমী তো সকাল থেকে বমি করতেছে।

কেন? কী হইছে?

কেন বমি করতেছে তুমি জানো না?

আমি কেমনে জানবো কেন বমি করতেছে? বদহজম হইছে নিশ্চয়ই।

আজব। তুমি কি বলতেছো? তুমি এমন ভাব করতেছো যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানো না। তুমি জানো না সুমী কেন বমি করতেছে? সুলায়মান, তুমি কিন্তু শাহরুখ খানের মতো অভিনয় শুরু করছো।

আমি নীতার দিকে তাকায়ে বললাম,

আমি তো সত্যি বুঝতেছি না সুমী কেন বমি করতেছে। আমি তো ওরে কখনও কিছু খাইতেও দেই না। তুমি মনে হয় কিছু খাইতে দিছো। কিন্তু বমি করতেছে যখন অ্যাভোমিন খাইতে দেও। বেশি বমি করলে তো স্যালাইন দিতে হবে। আর সমস্যা বেশি হলে ডাক্তার দেখাইতে হবে। সমস্যা কী? আমি তো ভাবছিলাম, সিরিয়াস কিছু।

সুলায়মান, তুমি কিন্তু বিরাট ফাইজলামি শুরু করছো। তুমি সত্যিই জানো না সুমী কেন বমি করতেছে?

না। আমি সত্যিই জানি না। আজব তুমি এরকম করতেছো কেন।

তুমি সত্যিই জানো না সুমী প্রেগন্যান্ট?

বল কী, সুমী প্রেগন্যান্ট? বল কী?

আমি চুপ হয়ে গেলাম। তারমানে তো ব্যাপার গুরুতর। সুমী যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে তাহলে তো সেজন্য অবশ্যই আমি দায়ী।

নীতা বলল, ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে তুমি। ছয়মাস ওরে আমি ছুটি দেই না। ঈদেও যাইতে দেই নাই। কারো সঙ্গে মেশার সুযোগ পাওয়ার তো প্রশ্নই নাই। তুমি যদি না করো তাহলে নিশ্চয় বাতাস থেকে সে প্রেগন্যান্ট হয় নাই। ছিঃ, সুলায়মান। যেমন তোমার নাম। তেমন তোমার কাজ। ছিঃ।

আমি চুপ হয়ে গেলাম। এ সময় ইমরান ভাইয়ের ফোন। সমস্যা কী জানতে ফোন দিছে। প্রথমবার ধরলাম না। নীতা দেখে বলল,

বসের ফোন ধরতেছো না কেন?

জি ইমরান ভাই। সমস্যা একটু হইছে। আপনাকে বলব। জি বেশি সময় লাগবে না। আমি আসতেছি।

গুড। অফিসে গিয়ে ইমরান ভাইকে বলবা, কাজের মেয়েকে কেমনে প্রেগন্যান্ট করছো। সবাইকে বলবা কেমনে কাজের মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করছো। তোমার কালচারাল লেভেল কত লো একবার ভেবে দেখছো। কাজের মেয়ের সঙ্গে তুমি এইটা করতে পারলা? আমার সঙ্গে সারাদিন প্রেমের অভিনয় কর। কিন্তু, আমাকে তোমার ভালো লাগে না। আমাকে ভালো লাগে না বুঝলাম, তো তুমি একটা পরকীয়া কর। অফিসে মেয়ে নাই? বান্ধবী নাই? শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ের সঙ্গে। তুমি জান না, রায়নার জন্য আমি সুমীর ওপর কতটা ডিপেন্ডেন্ট। তুমি কেমনে সুমীর সঙ্গে। আন্ডারএজ একটা মেয়ে, কত বয়স হবে বল। ১৭য় পড়ছে। তোমাকে ভাইজান বলে ডাকে। তুমি কেমনে এই কাজটা করতে পারলা।

নীতা শোন।

তোমার কথা কী শুনব বল। তুমি কি জান আমি কেমনে দুই বছরের চেষ্টায় দিনাজপুর থেকে দুলাভাইকে দিয়ে সুমীকে আনাইছিলাম। রায়নাকে দেখবে কে বল। কেমনে তুমি এমন একটা কাজ করলা?

আমি কিছু করি নাই।

ফালতু কথা বলবা না। তুমি কর নাই, কে করছে। আমাদের বাসায় কেউ আসে? কারও সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ আছে? তুমি জান না আমি প্রতিদিন ঘরে তালা দিয়ে রায়নাকে নিয়ে স্কুলে যাই। ওকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাই। অফিস থেকে ফিরে তালা খুলি। এই কাজটা তুমি ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব? কেউ বিশ্বাস করবে? তোমার কচি মেয়ে পছন্দ? তুমি একটা পারভার্ট। ওহ সুলায়মান। তুমি এত পারভার্ট কেন। কতটা পারভার্ট হলে একটা ফর্টি আপ লোক আন্ডারএজ কাজের মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করতে পারে। ওফ। আমি ভাবতে পারছি না।

এখন কী করবা?

আমি নীতার এই মেজাজের মধ্যেও জিজ্ঞেস করলাম আসল কথাটা।

বড় আপাকে বলতে হবে। বড় আপা যদি অ্যাবরশন করায় তাহলে তো বাঁচা গেল। ওহ সুলায়মান। তুমি আমাকে কিসের মধ্যে ফেলছো, বুঝছো?

মিতা আপা ডাক্তার ঠিক আছে। গাইনি স্পেশালিস্টও। কিন্তু নীতার বড় বোন। উনি শুনলে পরিস্থিতি কী হবে। শ্বশুর বাড়ির সবাই জানবে। আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারব না। এমতাবস্থায় আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।

আমি বললাম, একটা দিন ওয়েট কর। লেট মি থিঙ্ক। কাউকে বল না।

তুমি আর কী ভাববা বল। যে কাজটা করছো সেটা করার আগে তোমার ভাবা দরকার ছিল।

আমি ঘর থেকে বের হলাম। বাসায় ওয়েট করার মতো কোনো পরস্থিতি নেই। সোজা বের হয়ে গেলাম।

রায়নার দিকে তাকানোর মতো সাহস করতে পারলাম না। এটা ঠিক যে, আমার জানা মতে আমি সুমীর সঙ্গে কিছু করি নাই। আমি আসলে ওই ধরনের লোকই না। কিন্তু এমন কি হতে পারে যে নিজের অজান্তে আমি কিছু করেছি? ঘুমের ঘোরে? সুমী ঘুমায় ড্রয়িং রুমে। আমি কোনো কাজে রাতের দিকে ড্রয়িংরুমে আসি না। সুমী আমাকে খুব মানে। এত ভালো মেয়ে। আমাকে ভাইজান বলে। নীতাকে আপা। সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবার রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা সব কাজ নিজের মতো করে। ফিটফাট পরিচ্ছন্ন থাকে। দিনাজপুরে মিতা আপার শ্বশুর বাড়ির এলাকা থেকে ওকে দুই বছর আগে আনিয়েছিল নীতা। গত ছয়মাস বাড়ি যায়নি। এই ঘটনা জানাজানি হলে কী হবে, ভাবতেই আমি বিষণœ হয়ে যাচ্ছি। আত্মহত্যা করার প্রচণ্ড ইচ্ছা জাগতেছে। কিন্তু সমস্যার একটা সমাধান তো করতে হবে। প্রথম কাজ হল, এবরশন করানো।

যে কোনো ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে এবরশন করানোই যায়। কিন্তু তাতে রিস্ক আছে। আন্ডারএজ মেয়ে। কেউ সহজে এবরশন করাতে চাইবে না। এমতাবস্থায় মিতা আপা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু মিতা আপা কেমনে? বউয়ের নিজের বড় বোন। মাথা পুরো আউলা লেগে যাইতেছে।

আজকে অফিসের দিকে হাঁটা দিছি। কিছু ভালো লাগতেছে না। বাল। মনে হইতেছে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।

আজকে যদি বমি করে থাকে তাহলে কি গতমাসে প্রেগন্যান্ট হইছে। নীতাকে এত ডিটেইল কিছু জিজ্ঞেস করি নাই। এত কিছু কেমনে জিজ্ঞেস করি।

এরই মধ্যে নীতার ফোন।

বিশ্বস্ত কেউ না হলে শেয়ার কইরো না। ধর্ষণের কেসে ফেঁসে যাবা। জামিন অযোগ্য মামলা।

আচ্ছা একটা কথা বলবা। কতদিন হল?

কতদিন হল তুমি জান না। সত্যি করে বল তো কবে থেকে এসব চলতেছে। তিন মাস আগে পিরিয়ড বন্ধ হইছে। যদি এসব করবাই তো পিরিয়ডের খবর নিবা না। তুমি সেফ পরিয়ড জানো না? তুমি তো একটা খবিস। খবিস, তুমি তো ড্রয়ার খুললে কনডমও পাইতা। আমি তো কনডম গুনে রাখি না। অত ভয় থাকলে নতুন কনডম কিনতা। ওফ তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছো। যাই করছ, আবজাব লোকের সঙ্গে শেয়ার করে আরও বড় বিপদ ডাইক না।

এই ঝামেলার মধ্যে একটা পজেটিভ সাইন হল, নীতা আমাকে বাঁচাবে বলেই মনে হচ্ছে। হয়তো শেষ পর্যন্ত আমাকে ভিক্টিমাইজ করবে না। বাপের বাড়ির লোকদের জানাবে। না হলে মিতা আপাকে দিয়ে এবরশন করনো মুশকিল হবে। কিন্তু আমাকে বোধহয় বলি দেবে না। সম্পর্কটা ডাউন হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। কিন্তু, উপায় তো নাই। একটা দিন সময় চেয়ে নিছি। ভাবতে হবে। দ্রুত ভাবতে হবে।

কিন্তু কী ভাবব বুঝতে পারতেছি না। ইমরান ভাইকে বলা যাবে না। খুব ব্যাড ইমপ্রশেন হবে। অফিসে টেকা যাবে না।

কিন্তু তিনমাস আগে সুমীর সঙ্গে আমার কিছু হওয়া কতটা সম্ভব, ভাবতে বসলাম আমি। নাহ কোনোভাবেই কোনো সিচুয়েশন মনে পড়ছে না। যে সিচুয়েশনে আমি আর সুমী বাসায় একা। সকালে আমার অফিস রাতে ফেরা। সপ্তাহে একদিন ডে অফ শুক্রবার। সেদিন নীতারও ডে অফ। রায়নারও ডে অফ। শুক্রবার সাধারণত আমরা ঘুরতে যাই। অল্পদূরে কোথাও। বাকি ছয়দিন আমার রুটিন সকাল থেকে রাত বাইরে। রাতে আটটা নয়টায় ফিরে খাওয়া টিভি দেখা ঘুম। নীতা আর রায়না আগে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তারও আগে ঘুমায় সুমী। সকালে উঠে যেহেতু রুটি আর আলুভাজি করে সেহেতু তার রাত জেগে টিভি দেখার কোনো স্কোপ নাই। এমতাবস্থায় আমি ড্রয়িংরুমে যাই না। টিভি দেখি না। মোবাইলে ফেসবুক চালিয়ে সাড়ে বারোটায় ঘুমাই। আমার জানামতে সুমীর সঙ্গে তিন মাস আগে কেন কখনোই কিছু হয় নাই।

কিন্তু বাঁচার উপায় কী?

সুমী আমাকে বিপদে ফেলতে পারে। হয়তো কারও সঙ্গে কখনও কিছু করে ফেলেছে। কিন্তু কার সঙ্গে করবে। কীভাবেই বা করবে। বাসায় দিনের বেলা কারও পক্ষে ঢোকা সম্ভব না। তালা দেয়া থাকে। কারও সঙ্গে যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই বাঁচাতে চাইবে। নাকি মেয়েটা কোনো খারাপ জিনের খপ্পরে পড়েছে।

খারাপ জিন ছাড়া আর কোনো যুক্তিই মানুষ বিশ্বাস করবে না। আল কোরআনে জিনের কথা আছে। আর সবাই জানে জিন জাতির মধ্যে অনেক খারাপ জিন আছে। এমন জিনদের মধ্যে কেউ দুপুর বেলা সুমীকে ফুসলিয়ে কিছু করতেই পারে। কিন্তু তাই বলে আমাদের বাসাতেই কেন। আন্ডারএজ একটা মেয়ে। বাসায় কোরআন শরিফ আছে। তথাপি খারাপ জিন ঢুকল। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। খারাপ জিনের ব্যাপারটা কি নীতা বিশ্বাস করবে? করতে পারে। আল কোরআনে যেহেতু জিনের কথা আছে। কিন্তু স্বামী থাকতে একটা অপকর্ম জিন জাতির কোনো সদস্য করে গেছে সেটা কোনো স্ত্রী বিশ্বাস করবে না।

এখন সমস্যা হল, আমি কী করব। সমস্যাটা জলজ্যান্ত। কার সঙ্গে শেয়ার করলে আমাকে বিশ্বাস করবে এবং আমাকে হেলপ করতে প্রস্তুত থাকবে? একটা লোক দরকার যে আমাকে বিশ্বাস করবে আর ঠাণ্ডা মাথায় একটা বুদ্ধি দেবে। রশিদ আক্কাস মজনু মোকাদ্দিস। নাহ। কারও কথাই মনে পড়ছে না। মিলি কেমন হয়? আমার ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট মিলি। খুব করিৎকর্মা। হতে পারে? মিলি মেয়েদের অধিকার বিষয়ে সোচ্চার। ওকে ইনভলব করলে ও প্রথমে আমার নাম না নিয়ে ফেসবুকে একটা স্টেটাস দেবে। কেউ হয়তো লেখালেখি শুরু করবে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে। ও পরে আমার নাম ফাঁস করে দেবে সহযোদ্ধাদের চাপে। সন্ধ্যার মধ্যে সুমী যাবে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে। আমি জেলে। একটা উপায় আছে, ডিএনএ টেস্ট। ডিএনএ টেস্ট করলেই জানা যাবে সুমীর প্রেগন্যান্সির জন্য কে দায়ী। কিন্তু ঢাকায় ডিএনএ টেস্ট কে করে কোথায় করে। ইয়েস, ডিএনএ টেস্ট করলেই জানা যাবে- এর জন্য আমি না কোনো দুষ্ট জিন দায়ী। আর এর মাধ্যমে নীতার সন্দেহ দূর হবে। এমনকি মিতা আপা জানলেও তখন সমস্যা নেই। ঢাকায় ডিএনএ টেস্ট নিয়ে গুগলে সার্স দিয়ে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। তখন হঠাৎ মনে পড়ল মমিনের কথা। আমার বন্ধু ময়লা মমিন। দুনিয়ার দুই নম্বরী কাজকর্মের ওস্তাদ। গায়ের রং ময়লা বলে ছোটবেলা থেকে ওকে আমরা ময়লা মমিন বলে ডাকি।

মূলত কন্ট্রাক্টর। রোড অ্যান্ড হাইওয়ের এনলিস্টেড ঠিকাদার। গুণ্ডাপাণ্ডা, ঘুষ, মন্ত্রী, সচিব নিয়ে থাকে। মাগীবাজি, মদ-ভাং সবকিছুর ওস্তাদ।

এমন দিনে মমিনরে মনে পড়ল।

এমন বিপদের দিনে।

ফোন দিয়ে দেখি বিজি। মহা বিজি লোক। মতিঝিলে অফিস। হয়তো এখন অফিসে। বা কেনো ছোট অফিসারকে স্যার স্যার করতেছে কাজ পাওয়ার জন্য।

১৫ মিনিট পর কলব্যাক করল মমিন। ছোটবেলার বন্ধু তো।

দোস্ত সুলেমান।

দোস্ত তুমি বলতে পার, ডিএনএ টেস্ট কই করায়?

কস কি শালা, তুই কি বউরে সন্দেহ করিস? ডিএনএ টেস্ট কেন? আজব।

আর বলিস না দোস্ত একটা বিপদে পড়ছি।

কী বিপদ।

কাজের মেয়েটা...

মমিন বলে, বুঝছি। দোস্ত, এসব ফোনে আলাপ করা যাবে না। তুমি আইসা পড়ো। তাড়াতাড়ি।

রাস্তায় একটা পাওরুটি আর চা খেয়ে একটা সিএনজি নিয়ে মমিনের অফিসে গেলাম। মমিন অফিসে ছিল। দেখলাম, বেশ কয়েকটা সুন্দরী মেয়েকে নিয়োগ দিছে। হাড়ে হারামজাদা।

আমি যেতেই দরজাটা লাগায়ে দিল।

কী দোস্ত, কাজের মেয়ের পেট বানাইছো? তোমার মতো ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ে। মন খারাপ কইর না। দোস্ত, ঠিক আছে। মজা তো পাইছ। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখ। আমি ব্যবস্থা করতেছি।

আমার কাছে পুরাটা শুনে একটু অবাক হইল, মমিন।

মনে তো হইতেছে তুমি বিরাট সিকিউরিটি থ্রেটে আছ।

যদি তুমি কিছু না করে থাক তাহলে দুপুর বেলা মেয়ের কাছে কেউ আসে। কে বা কাহারা দরজা খুলে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে।

সেটা তো অসম্ভব দোস্ত। আমরা তালা দেই।

অসম্ভবের কিছু নাই। তুমি এক কাজ কর। বাসায় গিয়া ভাবীরে বুঝাও। দেখ, উনি কিছু বোঝে কি না।

কালকে তুমি আর ভাবী বাসায় থাকবা। সকাল সকাল আমি চলে আসব।

পরদিন রায়নাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় চলে আসল নীতা। আমি ইমরান ভাইকে ফোনে জানালাম, কালকের সমস্যাটাই চলছে। একটু দেরি হবে মনে হয়। আপনাকে এসে জানাব।

ইমরান ভাই খালি সমস্যাটা জানতে চায়।

কোনো রকমে কাটিয়ে আমি মমিনের জন্য ওয়েট করা শুরু করলাম। নীতা সবরকমভাবেই জেরা করেছে সুমীকে। কিন্তু মেয়ে কারও কথা স্বীকার করে নাই। এখন পর্যন্ত। আমার কথা বিশেষ ভাবে জিজ্ঞেস করার পর সাড়া মেলে নাই। নীতা জিনিশটা নিয়ে কনফিউজড। সিকিউরিটি থ্রেটটা খাইছে মনে হয়। খারাপ জিনের কথা আর বলতে হয় নাই।

সাড়ে এগারোটার দিকে দেখি মমিন ওর এলিয়ন গাড়ি থেকে নামতেছে। বারান্দা থেকে দেখলাম। আমাদের বাসার পার্কিয়ে বাড়িঅলার গাড়ি। তাই মমিনের গাড়ি রাস্তাতেই রাখা লাগবে। আরেকটা গাড়ি ঢুকলেই সমস্যা।

মমিনের চোখ খারাপ। মেয়ে দেখলে এত বিশ্রিভাবে তাকায়। সুমীকে নিরীক্ষণ করে আমার কানে কানে বলল, কচি হিসেবে মালটা খারাপ না। ভালোই করছ দোস্ত। ঠিকই আছে। আমি হলেও ছাড়তাম না।

নীতা আসতেই চুপ হয়ে গেল।

নীতা চা নিয়ে আসল।

মমিন বলল, ওকে ডাকেন।

সুমী একটা টুল নিয়ে বসল।

মমিন পকেট থেকে পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল। বলল, গুলি বেশি নাই। তিনটা আছে। পরশু তিনটারে মারছি।

পিস্তল দেখে নীতা সুমী দুইজনেই ভীত।

ভাবী, সমস্যা তো একটা হইছেই। এখন কথা হল, সুলেমান আমার ছোট বেলার বন্ধু। ওকে তো আমার বাঁচাইতে হবে। দরকার হলে গুলি চালাব।

এখন কথা হইল, সুলেমানকে বাঁচাইতে হইলে সুমীকে বাঁচানো যাবে না। কারণ যেই শুনবে সেই বিশ্বাস করবে এই জন্য সুলেমান দায়ী। এইজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিছি আমি সুমীরে গুলি করে মারব। মাইরা ওরে কাইটা বস্তায় ভরব। বস্তায় ভাইরা আমার গাড়িতে কইরা গিয়া বুড়িগঙ্গায় ফেলব।

কিন্তু ভাই, ওরে তো দুলাভাই দিছে। আমি দুলাভাইরে কি জবাব দেব। ভয়ে ভয়ে বলে নীতা।

বলবেন, মেয়ে দরজা খোলা পাইয়া পালাইছে। বলতে পারবেন না?

মমিন পিস্তলটা হাতে নিতেই সুমী ডুকরে কেঁদে উঠল।

মেয়ে কান্দে কেন ভাবী? পিস্তল দিয়া গুলি করলে লাগে না। খালি একটু জ্বলবে। পরে দেখবা মইরা গেছ আরামে। এত শান্তি লাগবে। কপালের মাঝ বরাবর গুলি করব। একদম কিছু বুঝবা না। টুপ করে মইরা যাবা।

হঠাৎ নীতার মনে হল সুমীর কান্না কেউ শুনতে পারে। তাই বলল, ভাই বেডরুমে চলেন। ওইখানে আলাপ করি।

মমিন বলে সেইটাই ভালো। গুলির শব্দ কেউ পাবে না। বেডরুমেই চলেন।

সুমী এবার কানতে কানতে মমিনের পায়ে পড়ল।

বলে, ভাইজান কিছু করে নাই, গো ভাইজান। আমারে মাইরেন না। আমারে মাইরেন না।

কিন্তু তুমি বাঁচলে দোষ তো সুলেমানের হবে।

ভাইজানের দোষ হবে না। সব করছে তো ওই আক্কাসভাই।

আক্কাস ভাই কে?

নীতা বলল, বাড়িওয়ালার ড্রাইভার।

গুড।

আধা ঘণ্টা পর বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালা ড্রাইভার মমিন আমি বসে আছি। বাড়িওয়ালা আর ড্রাইভারকে যাতা বলতেছে মমিন।

বাসার মেইন দরজার লকের তিনটা চাবি। একটা চাবি আমার কাছে। একটা নীতার কাছে। আরেকটা বাড়িঅলার কাছে। তার ড্রাইভার ফোনে ফোনে সুমীর সঙ্গে বেশ মেলাদিন থেকে আলাপ করতেছে। প্রেম গভীর হলে সে বাড়িওয়ালার চাবি চুরি করে।

বাড়িওয়ালা বলে, তাহলে এখন এদের দুজনকে বিয়ে দেই।

সুমী বলে, না খালু। উনি তো বিয়াতা। উনি বিয়ে করবে না। আমিও চাই না। আমাদের শুধু প্রেমের রিলেশন। সংসার করতে চাই না।

মমিন বলে, লে হালুয়া।

পৃথিবীটা কত আধুনিক হয়েছে ভেবে আমার চোখে পানি চলে আসে।


প্রাসঙ্গিক লেখা