যখন আগুন ভালবাসে পানি
'তুমহি মেরি মন্দির, তুমহি মেরি পূজা তুমহি দেবতা হো....', পুরান ক্লাসিক খুব দরদভরা এই হিন্দি ছবির গানটি লতা মুঙ্গেশকরের কণ্ঠের, সংগীতভক্ত সবাই শুনে থাকেন মনে হয়, ইউটিউবে ত ওয়াচ করতে পারেনই। ('খানদান' ছবি ১৯৬৫ তে রিলিজ প্রাপ্ত, সুনীল দত্ত ও নতুন অভিনীত)
গানটিতে মন্দির পূজা দেবতা থেকেও যে নাই, সেটা দেখা যেতে পারে একটু। ভাষা ত দুয়ার খোলা রাখছেই দেখবার। শিল্প ত বহু নজরে দেখবার সুযোগ দিতেই পারে। মন্দির পূজা দেবতা, এই তিনটি শব্দের ধর্মীয় তাৎপর্য যা আছে তা থাকা সত্বেও এখানে এসেছে অন্য অর্থে। এসেছে সিগনিফায়ার হয়ে, ডেসক্রিপ্টর হয়ে ভালবাসা বোঝাতে। মানে, ভালবাসা মেলে ধরতে, বলা যায় ভালবাসা-যে একটা বিষয়নিরপেক্ষ জিনিষ সেটি বুঝিয়ে দিতে, ভালবাসার মজা কেমন হয় তা দেখাতে এসেছে— এইভাবে ত একটা বুঝ পাওয়ার সুযোগ আছে।
বিশ্বাসে ধর্মে উপাসনাতে উপাসনালয়ে যায় মানুষ ভালবাসার খোঁজে — শান্তি স্বস্থির খোঁজে। তা না হলে যা হয় তা অন্য কিছু, অন্য এজেণ্ডা ভাবা যায়।
গানটিতে একটা বুঝ ত এমন যে, জামাই বউয়ের ভালবাসার নিবেদন এতে আছে, ছবির দৃশ্যেও দেখাচ্ছে। গানটির সুর কথা ও দৃশ্য ইনফেকশাস, মানে suffuse করে, মানে মন স্পর্শ করে। কী এসে স্পর্শ করে? এক ধরনের সুইটনেস সেটা? হয়ত। একটা submerge in love হয় শ্রোতা দর্শকের, এমন লাগে, এটা শুনতে দেখতে থাকা অবস্থায়। অন্য রকম বিবেচনা ত থাকতেই পারে।
কেউ বলেন নারী এখানে বেশি নিবেদিতা, নারী-মানুষটির ব্যক্তিত্বের শান নাই এর মাঝে — মধ্যযুগীয় সমর্পণ ইত্যাদি। এই বিবেচনা কতটুকু ঠিক আর কতটুকু বেঠিক, সেই বিচারে না গিয়ে এই সংগীতশিল্পটির ভাবের ভিতরদেশ একটু ঘুরে আসা যাক এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে যে, ভালবাসা কেমনে-কেমনে ফোটে? আর বিন্দুতে সিন্ধু দেখা যাওয়া-যে আছে সেটাও দেখা গেল।
গানটিতে ভালবাসার নিমজ্জন আছে। ভালবাসাতে নিমজ্জন ব্যাপারটা কী দাবী করে? পরস্পরের নিমজ্জন? মানে, আমি ইন্টারেস্টেড হলে দেখা যাবে আমার চৌদিকের জগত ইন্টারেস্টিং। নিমজ্জন ছাড়া, নিমগ্ন হওয়া ছাড়া তারে মিলে না? আমি না ডুবলে তারে আর পাই কই? যতক্ষণ ডুব ততক্ষণ খুব মিলে যে এটা টের পাওয়া ত যায়ই। ডুব মানে বিসর্জন, বিসর্জন মানে আত্মোৎসর্গ, ব্যক্তির ইগো নাশ করা — এনিহিলেট করা। অতএব, ব্যাপারটা ত এমন হচ্ছে যে, ভালবাসাতে ডুবে থাকা অবস্থায় তাদের ইগো থাকছে না। গানটির মাঝখানের একটা অংশ—
তুমহি মেরি মাথে কি বিন্দিয়া কি ঝিলমিল
তুমহি মেরি হাতো কে গাজরো কি মানজিল
ম্যায় হুঁ এক ছোটি সি মাটি কি গুড়িয়া
তুমহি প্রাণ মেরে তুমহি আত্মা হো
ডুব দিলে ভিতরে বাইরে কেবল 'তুমি' দেখা যায়। তাইলে আমি কই গেল? ইনডিভিডুয়েল আমি এর শরীর হাজির হয়েও তার আমি সাবমার্জড। বলছে আমি মাটির পুতুল, তুমি প্রাণ তুমি আত্মা। যেদিকেই নজর রাখে, কেবল তুমি দেখে।
এমন সাবমার্জড অবস্থাতেই ঘটছে আসল কাণ্ড— যে-তুমির জন্যে আমি ডুবে গেল সেই 'তুমি'ও সাবমার্জড হল, মানে নিমজ্জিত হল। ফলে এখন আর দুই দিকেরই শানদার ইগোঅলা আমির আমিত্ব থাকলো না।
দুইদিক থেকে ভাবের স্পন্দন— আমি পুতুল তুমি প্রাণ। এই দুই আমি আমিত্বহীন হয়ে, সরল হয়ে, ভালবাসা ফোটাতে এসেছে। কালা শাহ তাঁর গানে বলেন— 'সরল দেশে গেলে রে মন গরলের ভাব থাকবে না'। যখন থাকবে না গরল, থাকবে না ইগো, তখনই ফোটে ভালবাসা। সেই ফোটা রূপটা কেমন তা দেখালো অভিনয় করে সুনীল দত্ত ও নুতন। ফোটা ভালবাসার ম্যাগনেটিজম এমন যে, সেটা দেখলে শুনলেও আক্রান্ত হতে হয়।
ত ফুটল যে, সেটা কেয়ামত পর্যন্ত ফুটে থাকবার জন্যে ফোটে নাই— এমন দেখা যেতেই পারে, হতে পারে। ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায়, ঝরে — এমন বাস্তবতা ত আছেই। স্বামী স্ত্রীরা — প্রেমিক প্রেমিকারা এই ফুল বারবার ফোটাতে পারতে হয়। না পারলে থিংস ফল্ এ্যাপার্ট। যখন যেটুক সময়ের জন্যে ফুটেছিল, সেই সময়ে ফোটা ত ছিলই। কখনো এমন অনির্বচনীয় ফোটা সামান্য সময়ের জন্যেও হতে পারে। পরে ঝরে পড়ার কারণে বিচ্ছেদ আসতে পারে। বিচ্ছেদটাও ভালবাসার ভিতরের অন্য রূপ।
বৃটিশ কথাশিল্পী কাজুও ইশিগুরো সেটা তার গল্প 'সংগীতশিল্পী'তে সুন্দর করে দেখিয়েছেন। ভালবাসে বলেই স্বামী স্ত্রী দুজনে যার যার পথে আলাদা হয়ে যেতে রাজি হয়। প্রেমিক প্রেমিকা পরস্পরের কাছে বান্ধা থাকে না। যার সাথে মিলে, যেখানে সাবমার্জড হওয়াতে কদম্ব ফুটেছিল, সেই সুখ-স্মৃতি ত মেমরিতে সযতনে থাকতেই পারে সে চলে গেলেও।
আমরা ত দেখি, ভালবাসা সুখ ও দুখ দুইই ফোটায়, ফোটাতে হয় বলে। দুই রূপের দরদে হৃদয় দোলে। এ এমন এক দরকারি ভুলভুলাইয়া, ভ্রান্তিবিলাস, এইই জীবনকে অর্থবহ করে। এ ফোটে ঝরে, ঝিলমিল করে, কাঁদায় হাসায়, এর মাঝে রাত দিন সকাল দুপুর সন্ধ্যাকেও পাওয়া যায়।
কিন্তু শিল্প-যে সমগ্রকে ধরে, একটা all-encompassing ব্যাপার আছে, নানা অর্থে অর্থবহ হয়, বিন্দু হয়ে সিন্ধুকে দেখায়, সেটা একটু দেখা যেতে পারে। কেননা, দেখা ত যায়ই, ভালবাসা বহুভাবে জীবনের ভাইব্রেটর — স্পন্দক। রৌদ্র হয়, ছায়া হয়; আগুন হয় পানি হয়; আলো হয় অন্ধকার হয়। অন্ধকার না থাকলে আলোর মহিমা ফোটে না।
আপনি বিয়ে করেন নি, বা বিয়ে ছাড়াও সঙ্গম করেন নি, কিংবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শরীরে চাওয়া মিটাবেন না, প্রজননের কাজে লাগবেন না। তার মানে এই নয় আপনি ভালবাসার বাইরে। যে কাজেই নিয়োজিত থাকবেন, সেই কাজকে ঘিরে আপনার প্রেম রচিত হবে। আপনার জব সেটিসফেকশনে আপনার ভালবাসা গ্রণ্থিত। আপনার পছন্দের কাজটিতে সাবমার্জড হয়ে যাওয়াতে আপনার সুইটনেস অব ইমোশন ফুটলো, আপনি ভালবাসাতেই থাকলেন। আপনার চোখে সারাক্ষণ কাজটি ঘিরে ধ্যান গবেষণা, এতে আপনি আনন্দিত। ফলে ঐ যে গানটির 'যিধার দেখতি হুঁ, উধার তুমহি তুম হো' — এই অনুভব এসে গেল আপনার ধ্যানে জ্ঞানে। মা বাবা ভাই বোন স্বজন বন্ধু সহকর্মী সহপাঠির ভালবাসাবোধের মাঝেও অনিন্দ্য সুন্দর নিমজ্জন আছে। ‘কে যাছ রে ভাটি গাঙ বাইয়া আমার ভাই ধন রে কইও …’ গানটিতেও অতুলনীয় মগ্নতার ম্যাগনেটিজম আছে।
হ্যাঁ, নারী পুরুষের সেক্স ডিজায়ারে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ভালবাসা mingled থাকতে পারে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ডিজায়ার ভালবাসা নয়, ডিজায়ার কেবল ডিজায়ার। শরীরের ঐ কাজটা ত এই যে পুরুষ exploit করছে নারীর শরীর, আর নারী exploit করছে পুরুষের শরীর। যার যার অনুভূতি তার তার সাথে। কাজটা সযতনে সেরে নেবার জন্যে ভালবাসা হাজির থাকবে। ভালবাসা — যতন — স্নেহ — মায়া দরকার সকল জীবনে। শামস তাবরিজি বলেন—
‘কেউ অতটুকুই জানেন যতটুকু তিনি ভালোবাসতে সমর্থ। ভালোবাসা ছাড়া আত্মজ্ঞানের নাগাল মিলে না।’
আচ্ছা, জামাই বউয়েরা কি চব্বিশ ঘন্টা পরস্পরের মাথার ভিতরে বসে পাশা খেলে? নাহ, সম্ভব নহে। তারা একসাথে সংসার করবার জন্যে সামাজিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। প্রজননের কাজ সারছেন, বংশবিস্তার করছেন, সুখ দুখ শেয়ার করছেন। খুব ফোকাস দিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সব দুখ সুখ তারা শেয়ার করছেন না তাদের সম্পর্ক তাজা রাখবার কারণেই। শেয়ার করলেই দাম্পত্য সৌন্দর্য মোচড় খাবে, দুজন দুই পথে যেতে চাইবেন। বিয়ের বাইরের প্রেমিক প্রেমিকারাও যার যার জিন্দেগির ষোলআনা শেয়ার করতে পারে না। করে না হিসাবে প্যাঁচ লাগবে বলে। মানে শেয়ার কেয়ারেরও বাউণ্ডারী আছে। দেখার বিষয় এই যে, যতটুকু শেয়ার কেয়ার হয়, তাতে ভালবাসা কতটুকু শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারছে। ভালবাসা চর্চা — দরদ চর্চা করতে পারা সহজ না, কঠিন চ্যালেঞ্জ। শান্তি পেতে হলে শান্তি দিতে হয়, নিজেকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পারতে হয়।
সব কাজে, সব সম্পর্কে ভালবাসা হাজির থাকলে, সুইটনেস অব ইমোশন থাকলে খুব কম সময়ের জন্যে হলেও অনির্বচনীয় নিমজ্জনের ঘটনা ঘটে। এই নিমজ্জন মানুষকে জটিলতা মুক্ত করে রিফ্রেশ করে। মন হয় ধোয়া-মোছা পরিচ্ছন্ন।
শামস তাবরিজি বলেন—
'ভালবাসা ছাড়া জীবন মূল্যহীন। প্রশ্ন করবেন না কি ধরনের ভালবাসা আপনি খুঁজবেন - আধ্যাত্মিক, বস্তুগত, খোদায়ী, সাংসারিক, পূবের বা পশ্চিমের, কোনো ব্যাপার না। বিভাজন শুধু আগে বাড়ায় আরো বিভাজন। ভালবাসার কোনো নাম-আখ্যা নাই, সংগা নাই। ভালবাসা শুধু ভালোবাসা, বিশুদ্ধ এবং সহজ। ভালবাসা জীবনের পানি। আর আশেক হয়ে ওঠেন অগ্নিআত্মা। মহাবিশ্ব অন্যরকম হয় যখন আগুন ভালবাসে পানি।'