অবদমন কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে?
মানুষের জীবনে চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব চিরকালের। যেমন কবির ভাষায়,
"যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।“
চাওয়া, কামনা, ইচ্ছে বা স্বপ্ন- যে নামেই জন্মাক না কেন, তা পাবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে গোটা জীবন জুড়েই। আর এ প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই মানুষের অবিরাম ছুটে চলা।
কিন্তু মনে জন্মানো সব চাওয়াই কি পূরণ হয়? কিংবা সব স্মৃতিই কি সুখস্মৃতি হয়? যদি না হয় তবে তারা কোথায় যায়? কি হয় সেসব ইচ্ছেগুলোর? না পাওয়াকে কিভাবে মেনে নেই আমরা? বা আদৌ কি মেনে নিতে পারি সব ক্ষেত্রে? আমাদের জীবনের না পাওয়া গুলো কি কোনো ভাবে প্রভাবিত করে আমাদের জীবনযাত্রাকে?
তারই খানিকটা জানবো আজ।
মানুষ বিভিন্ন সময়ই তার চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গলাভের চাহিদা, ভালোবাসা পাবার চাহিদা, স্বীকৃতির চাহিদা পূরণে, বা কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে মানুষের মনোজগতে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব ও হতাশার সৃষ্টি হয়। সাধারণত এ দ্বন্দ্ব ও হতাশা থেকে ব্যক্তি নিজেকে রক্ষা করে তার মানসিক ক্ষমতা ও কিছু অভ্যন্তরীণ কৌশলে। এসব কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বাস্তব জীবনের পরাজয়, হতাশা, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মানসিক কষ্ট থেকে নিজেকে বাঁচায় এবং বাস্তবের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে চেষ্টা চালায়।
নিজেকে রক্ষা করার এই ক্ষমতা অনেকটা শারীরিক সে সমস্ত প্রক্রিয়ার মত, যার ফলে ছোটখাটো অসুখ, যেমন সর্দিকাশি ইত্যাদি হলে ঔষধ না খেলেও কিছুদিন পর স্বাভাবিক নিয়মে তা ভাল হয়ে যায়।
এই Adjustment Mechanism বা মানিয়ে নেওয়ার কৌশলগুলোর একটি হচ্ছে অবদমন বা Repression। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রথম এই কৌশলটি সম্পর্কে ধারণা দেন। ফ্রয়েডের মতে, সাধারণত অগ্রহণযোগ্য, অবাঞ্ছিত কামনা, স্মৃতি ও ইচ্ছেগুলোকেই ব্যক্তি অবদমন করে থাকে। কেননা সেগুলো হয়তবা সমাজ স্বীকৃত নয় অথবা ব্যক্তির জন্য অসম্মানজনক কিংবা ক্ষতিকর। তাই ব্যক্তি তার Unconscious mind বা অবচেতন মনে অগ্রহণযোগ্য স্মৃতি, ইচ্ছা ও চিন্তাগুলোকে বন্দী করে রাখে।
এমন অনেক স্মৃতি রয়েছে যা মানুষ ভুলে যেতে চায় কিন্তু ব্যর্থ হয়। বা আপাত দৃষ্টিতে কোনো একটি বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে বলে ব্যক্তি মনে করলেও তা ব্যক্তির অজ্ঞাতেই ব্যক্তির কথা ও কাজে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
আর হ্যা, এই অবাঞ্ছিত ইচ্ছেগুলো কি করে জন্মায় তাও এক ফাঁকে বলে নেই। ফ্রয়েড মানুষের মনের ভেতরকার যে শক্তি, তাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। ইদম, অহম এবং অতি অহম বা অধিসত্তা। ইদম(Id) আমাদের অভ্যন্তরীণ একটি সত্তা, যা কিনা একটি ছোট্ট শিশুর মত। এই শিশুটি ভালমন্দ বা কোনো কিছুর যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবেনা। যা ইচ্ছে তাই সে চেয়ে বসে আর ইগো, সুপার ইগোকে নাকাল করে ছাড়ে! অনেক ক্ষেত্রে ইদম এমন অনেক কিছু করতে বা পেতে চায় যা ব্যক্তির সম্মানের জন্য হানিকর বা যা সমাজ স্বীকৃত নয়। তাই ইদমের কোন চাওয়াটি পূরণ হবে আর কোন বিষয়টিকে অবদমন করা হবে তা নির্ধারণ করে আমাদের অধিসত্তা বা Super Ego। আর এই অবদমন করার কাজটি করে মূলত অহম, যাকে আমরা ইগো (Ego) বলে জানি।
কি হয় যখন একজন ব্যক্তি তার কোনো চাওয়াকে অবদমন করে? সাধারণত ব্যক্তি সে সমস্ত আকাঙ্ক্ষা গুলোকেই অবদমন করে যা পূরণ হবার তেমন কোনো সম্ভাবনাই নেই বা কোনো স্মৃতি, যা তার জন্য কোনো না কোনো ভাবে খুবই ক্ষতিকর বলে মনে করে। যেমন একজন ব্যক্তি যে শৈশবে যৌন নিপীড়নের স্বীকার হয়েছে, পরবর্তী জীবনে তার সম্পর্ক তৈরিতে ভীতি বা জটিলতা তৈরি হতে পারে বা তার আচরণকে ক্রমাগত প্রভাবিত করতে পারে যদিও সেই স্মৃতিটি সে স্বাভাবিক অবস্থায় মনে করতে সক্ষম নাও হতে পারে।
আবার, শৈশবে মায়ের দ্বারা মানসিক নিপীড়নের স্বীকার হওয়া একজন তার শৈশবের নির্দিষ্ট কিছু স্মৃতি মনে করতে ব্যর্থ হয়।
এ অবদমনের ফলে ব্যক্তির মানসিক চাপগুলোর আপাতঃ অবসান ঘটে। কিন্তু স্মৃতি গুলো কিংবা কামনাগুলো মনের নির্জ্ঞান স্তরে থেকেই যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবদমনের এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যক্তি সচেতন থাকেন না। অর্থাৎ ব্যক্তি কোনো একটি বিষয়কে গ্রহন করতে না পেরে এমন পর্যায়ের দিকে ঠেলে দেয় যখন সে আর উক্ত বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন থাকেনা এবং বিষয়টি ততক্ষণ পর্যন্ত মনের চেতন স্তরে আসার অনুমতি পায়না যতক্ষণ না ব্যক্তি বিষয়টিকে গ্রহণ করতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয় বা তাকে মোকাবিলা করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী হয়।
কিন্তু এতেই শেষ নয়, Unconscious mind বা অবচেতন মনে পাঠিয়ে দেওয়া অসামাজিক ও অবাঞ্ছিত চিন্তাভাবনা গুলো মানুষের মনের এই গহীন স্তরটিতে গিয়ে সক্রিয় হয়ে আরো অন্যান্য অবদমিত চিন্তা ও ইচ্ছেগুলোর সাথে মিলিত হয় এবং কোনো না কোনো ভাবে মনের সচেতন অংশটিতে ফিরে এসে চাহিদাটি পূরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে এবং ব্যক্তির আচরণকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। যার ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এই দ্বন্দ্বের ফলে তৈরি হতে পারে নানারকম মানসিক বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, মনোযোগ কমে যাওয়া, কিছু মনে রাখতে না পারা, কিছু ভাল না লাগা, ঘুম না হওয়া, অরুচি সহ আরো নানা অসুবিধা।
মাত্রাতিরিক্ত অবদমন যারা করে থাকেন বা সহজে যারা নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন বা কোনো কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ করেন না, তারা প্রায়শই মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিনপাত করেন এবং এর ফলে দৈনন্দিন কাজেও অসুবিধার সম্মুখীন হন।
চরম পর্যায়ে, অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে অনেক বেশি অবদমনের ফলে মানুষ Amnesia, Schizophrenia, Manic-Depressive এর মত জটিল মানসিক রোগেও আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
অবদমনে মূলত চেতনস্তর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত কিছু আশা, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা, স্মৃতি বা অনুভূতি মনের নির্জ্ঞান স্তরে জমা হয়। যেখানে সাধারণত কোনো মানুষ কিংবা ব্যক্তি নিজেও সাধারণত প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে এ স্তরে বিচরণ করতে থাকা কোনো জটিলতা তাৎক্ষণিক ভাবে সমাধান করা কঠিন। তাই অবদমন মুলত পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার একটি নিকৃষ্ট কৌশল যার ফলে ব্যক্তির অভ্যন্তরে অস্বাভাবিক চাপের সৃষ্টি হয়।
এইজন্য মনে তৈরি হওয়া যেকোনো আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছেকে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রত্যাখ্যান না করে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকটি বিবেচনা করে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিলে তা যেমন অধিক ফলপ্রসূ হয়, তেমনি অযাচিত মানসিক পীড়ন থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়।
সূত্রঃ অস্বাভাবিক ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান -ড. কাজী সাইফুদ্দীন, মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান -লুৎফুন্নেছা বেগম ও ইন্টারনেট
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট