আজব এক পেটের সমস্যাঃ আইবিএস
কামাল সাহেব শহরের বড় ব্যবসায়ী। বয়স পঞ্চান্ন। ধার্মিক, সামাজিকতা রক্ষা করে চলেন। কেউ দাওয়াত দিলে কামাল সাহেব কখনও না করেন না। ব্যস্ততার মধ্যেও চেষ্টা করেন যাওয়ার। সম্প্রতি বোনের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন। পুরোটা সময় সব স্বাভাবিকই ছিলো । কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে পোলাও-রোস্ট খাওয়ার পর। খাওয়ার পর পরই তিনি দেখলেন তার পেট ফুলে উঠেছে, হালকা ব্যথা করছে, পেটে শব্দ হচ্ছে। এখুনি ওয়াশরুমে যেতে হবে, এরকম অবস্থা।
কামাল সাহেব লক্ষ্য করলেন এই সমস্যা তার আগেও কয়েকবার হয়েছে। শুধু মাত্র যে ভারী খাবার খাওয়ার পরে হয়েছে তা নয়। ব্যবসায় করতে গিয়ে কোন একটি বড় অর্ডার নিয়ে যখন মানসিক চাপে পড়েছেন তখনও তার এরকম হয়েছে। তবে আগে এই ধরনের সমস্যা তার কম হলেও, গত পাঁচ-ছ মাস যাবত তার সমস্যার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে গেছে। এছাড়াও, তার প্রতি মাসেই কিছুদিন পেট খারাপ থাকছে। বাথরুমে না যাওয়া পর্যন্ত অস্বস্তিকর একটা ব্যথা, ভুটভুট শব্দ হতে থাকে। এর আগে মাঝে মধ্যে পেট খারাপ হলে সাধারণত ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খেয়ে নিতেন, পেট ভালো হয়ে যেত। কিন্তু প্রত্যেক মাসেই পেটের অসুখের এই বিচিত্র সমস্যা কামাল সাহেবকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এ আবার কোন আজব পেটের অসুখ?
বিচিত্র পেটের অসুখ: আই বি এস
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (সংক্ষেপে- আইবিএস), পেটের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও জীবনাচারে গুণগত মান কমে যাওয়া এবং প্রায়ই কর্মস্থলে অনুপস্থিত হওয়ার অন্যতম কারণও এটি। দেশের জনগনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ জীবনের কোন সময়ে এই ধরনের সমস্যায় ভুগেন। পুরুষদের চেয়ে মহিলারা দুই থেকে তিনগুণ বেশী আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রুগীদের পেটের সমস্যার সাথে সাধারণত বদহজম, শরীর ব্যথা, মাসিকের সময় ব্যথা (মহিলাদের ক্ষেত্রে) ও দীর্ঘ মেয়াদী ক্লান্তি জাতীয় সমস্যা থাকে।
কিন্তু, আমাদের গল্পের কামাল সাহেবের কি এ রোগ হয়েছে?
কেন হয়? কী হয়?
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের ইনফেকশন। হেপাটাইটিস হলো লিভারের ইনফেকশন। দু'টোর ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে যথাক্রমে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে দায়ী হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু আইবিএস এমন এক আজব রোগ যার সুনির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় নি। তবুও বিজ্ঞানীরা খেটেখুটে এর পেছনে অনেকগুলো কারণের সমষ্টিকে চিন্তা করেছেন। তাদের মতে আইবিএস-এর পিছনে আছে ব্যক্তির মন-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশগত ব্যাপার স্যাপার এবং শারীরবৃত্তীয় কিছু কারণ।
আইবিএস-এর কারণে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে আসা ব্যক্তিদের পঞ্চাশ শতাংশের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে হতাশা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা। এছাড়াও রুগীদের কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা গেছে ছোটখাটো বিষয় নিয়েও পুন:পুন: ডাক্তারের পরামর্শ নেয়ার প্রবণতা। অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে সেরোটোনিন নামক এক পদার্থের সাথে এর সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ওলটপালট হলেও এই সমস্যা হয়। আইবিএস রুগীদের অনেকেই দুধ ও দুধের তৈরি খাবার, ফল এবং তেলযুক্ত খাবার হজম করতে পারেন না।
আইবিএস আক্রান্ত রুগীদের মূল অভিযোগ হোলো ঘন ঘন পেটের অস্বস্থি (Discomfort), যা মোচড়ানোর মত সাধারণত তলপেটে অনুভব হয় এবং যা ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলতে থাকে। পেটে ভুটভুট শব্দ হয়, যা সারাদিনে বাড়তে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে এই ভুটভুট শব্দের কারণ গ্যাস নয়, অন্যকিছু। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়ই কনস্টিপেশন ও পেট খারাপের সমস্যা দেখা যায়। অর্থাৎ কিছুদিন কনস্টিপেশন হয়, কিছু দিন পেট খারাপ আর কিছু দিন স্বাভাবিক থাকে। কারও কারও ক্ষেত্রে কষা হওয়ার ঘটনা বেশী ঘটে, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে পাতলা হওয়ার ঘটনা বেশী। এর উপর ভিত্তি করে ডাক্তাররা আইবিএসকে কনস্টিপেশন প্রিডমিনেন্ট ও ডায়রিয়া প্রিডমিনেন্ট এ দু’ভাগে ভাগ করেন। রুগীদের পায়খানা খারাপ হলেও সাথে রক্ত যায় না এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হলেও ওজন সে মাত্রায় কমে না।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কামাল সাহেবের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তাকে বললেন যে তার আইবিএস হয়েছে বলে তিনি সন্দেহ করছেন। তিনি তাকে কোলোনোস্পকি করতে দিলেন। বললেন পরীক্ষা করে রিপোর্টসহ দেখা করতে।
আইবিএস না অন্যকিছু?
আইবিএস রোগটা সাধারণত রুগীর লক্ষণগুলো থেকেই নির্ণয় করা হয়। যাদের উপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলো ছয়মাসের বেশী সময় ধরে হচ্ছে এবং যে কোন প্রকার মানসিক চাপ সমস্যাগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা আইবিএস সন্দেহ করেন। আইবিএস নিশ্চিত করার জন্য ‘রোম থ্রি ক্রাইটেরিয়া’ নামক একটি নিয়মের ব্যবহার করেন। সহজ কথায় যাদের গত তিন মাস ধরে ঘন ঘন (মাসে অন্তত তিনদিন) পেটে অস্বস্থি বা ব্যথা আছে এবং সাথে ‘পায়খানার মধ্য দিয়ে পেট ভাল হয়ে যাওয়া’, ‘পেট খারাপের শুরু টয়লেটে যাওয়া বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে’ ও ‘পেট খারাপের শুরু পায়খানার ধরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে’-এর যে কোন দুটি বৈশিষ্ট্য থাকে, তার আইবিএস হয়েছে ধরা হয়। সাধারণত কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন না পড়লেও যাদের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে তাদের কোলনোস্কপি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে খাদ্যনালীর নিচের অংশ দেখে নেয়া হয়, যে দীর্ঘমেয়াদী পেটের অসুখের অন্য কোন কারণ (যেমন: ক্রনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস, কোলন ক্যান্সার, মাইক্রোস্কপিক কোলাইটিস ইত্যাদি) আছে কি না?
মিস্টার কামাল কোলনস্কোপি করিয়েছেন। রিপোর্ট নরমাল এসেছে। ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করলেন যে তার বড় কোন রোগ হয়নি। এরপর তাকে চিকিৎসা দিলেন।
আইবিএস-এর চিকিৎসা
আইবিএস-এর চিকিৎসা নির্ভর করে কোন ধরনের আইবিএস তার উপর। যদি পায়খানা কষার সমস্যা বেশী হয় তাহলে ডাক্তাররা শাকসবজি বেশী খেতে বলেন। তাতে কাজ না হলে ইসবগুলের ভুসি, ল্যাকটুলোজ ইত্যাদি প্রেসক্রাইব করেন। পায়খানা পাতলা হলে, ডায়রিয়া বন্ধের ঔষধ যেমন: লোপেরামাইড ইত্যাদি দেন। যে সকল রুগীর বিভিন্ন খাবারে বদহজম হয় তাদের খাবারের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বলেন। যেমন: কাউকে দুধ খেতে নিষেধ করেন, কাউকে নিষেধ করেন আটার রুটি, কাউকে ফল কম খেতে বলেন ইত্যাদি। ভুটভুট শব্দ ও অস্বস্তি কমানোর জন্য মেবেভেরিন জাতীয় ঔষধ দেয়া হয়।
এসব উপদেশ ঠিক মত অনুসরণে কাজ না হলে বিভিন্ন প্রবায়োটিক, রিফাক্সিমিন ও অ্যামিট্রিপটাইলিন ইত্যাদি দেয়া হয়। শেষের ঔষধটি আইবিএস-এর সাথে থাকা উদ্বিগ্নতা ও হতাশা জাতীয় সমস্যাতেও কাজ করে। কিছু কিছু রোগীর এগুলো খেয়েও যখন পেটের অসুখ নিয়ন্ত্রণে আসে না তখন অল্টারনেটিভ থেরাপি চেষ্টা করে দেখতে বলা হয়। এর মধ্যে আছে হিপনোসিস, হারবাল ঔষধ, বায়োফিডব্যাক, হোমিওপ্যাথী ইত্যাদি।
কামাল সাহেব ডাক্তারের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।ডাক্তার তাকে বলেছেন এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, পুরোপুরি ভালো হতে চায় না। তিনি কিছু ঔষধ দেয়ার পাশাপাশি তেলযুক্ত খাবার ও চা-কফি ত্যাগ করতে বলেছেন। সাথে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যদি পায়খানার সাথে রক্ত আসা, ওজন কমে যাওয়া জাতীয় সমস্যা দেখা দেয় তাহলে যেন দেরী না করে দেখা করেন।
রিস্ক ফ্যাক্টর
- ৫০ বছরের নিচের বয়সীদের এই সমস্যা বেশী হয়ে থাকে।
- মহিলাদের এধরনের সমস্যা বেশী হয়ে থাকে। Estrogen therapy এ সমস্যা বাড়িয়ে থাকে।
- পরিবারের ইতিহাসে কারো এই সমস্যা থাকলে তার পরবর্তী প্রজন্মের হতে পারে।
- মানসিক সমস্যা থেকে এটি হতে পারে। দুঃশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন এবং বিবিধ মানসিক সমস্যা এর সাথে সম্পর্কিত। অতীতে শারিরিক ও মানসিক অ্যাবিউসের ঘটনা থেকে থাকলে তা থেকেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে।