ইংরেজিঃ একটি বৈশ্বিক লিংগুয়া ফ্রাংকা (Lingua Franca)


বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকজন সবসময় পরস্পরের যোগাযোগের সুবিধার্থে তৃতীয় কোন ভাষার সাহায্য নিয়েছে যা কিনা ব্রিজ ল্যাংগুয়েজ হিসেবে কাজ করতো। এবং অধিকাংশ সময়ই সেটা যোগাযোগাকারীর ব্যক্তিদের মাতৃভাষা থেকে ভিন্ন কোন ভাষা হতো যা  আজ লিংগুয়া ফ্রাংকা (Lingua Franca) হিসেবে পরিচিত। মানব সভ্যতার ইতিহাসের মত লিংগুয়া ফ্র্যাংকার ইতিহাসও পুরানো। সর্বপ্রথম পার্সিয়ান সাম্রাজ্যে লিংগুয়া ফ্রাংকার উদ্ভব হয় যার নাম ছিল আরামাইক (Aramaic) ভাষা। যোগাযোগের ইতিহাসে লিংগুয়া ফ্রাংকা সাম্রাজ্যের উপজাত হিসেবে উদ্ভব হয়। অতঃপর মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পার্সিয়ান সাম্রাজ্য অধিকার করে নিলে, গ্রিক ভাষা ধীরে ধীরে আরমাইক এর জায়গা দখল নিতে শুরু করে। রোমান সম্রাটদের রাজত্বকালে ইউরোপের একটা বড় অংশ জুড়ে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহৃত হয়েছিল।

বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়নের অধিক মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করে এবং ৪৩০ মিলিয়নের অধিক যোগাযোগের দ্বিতীয় মাধ্যমিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।

পরবর্তী সময়ে, আধুনিক যুগে পশ্চিমা বিশ্বের লিংগুয়া ফ্রাংকা ছিল ফ্রেঞ্চ ভাষা কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দিকে ধীরে ধীরে ইংরেজি ফ্রেঞ্চ এর জায়গা দখল করে নিতে থাকে। যেখানে পিছু শক্তি হিসেবে কাজ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর  অধিকৃত  উপনিবেশ  রাষ্ট্রগুলো ও বানিজ্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যের অগ্রগতি। পাশাপাশি পৃথিবী বিশ্বায়নের পথে অগ্রসর হতে থাকে। আর এই আধুনিক পৃথিবীর বিশ্বায়নে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব ভুমিকা ছিল যেটা কিনা পুরো বিশ্বকে একটি ছাঁচের মধ্যে নিয়ে এসে  পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। আর সেখানে সম্পর্ক স্থাপনের  ভিত্তি হিসেবে যোগাযোগের জন্য একটি ভাষার প্রয়োজন হয়। আর এখানেই ইংরেজি ভাষা বৈশ্বিক সম্পর্কের মাধ্যম  হয়ে কাজ করে তা কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ভাষাভাষীর মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধ না থেকে একটি সার্বজনীন ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও দীর্ঘ সময় ব্যাপী পৃথিবীজুড়ে ইংরেজদের রাজত্ব ও আমেরিকানদের বানিজ্যে অগ্রগতি ও বিস্তার ইংরেজিকে বৈশ্বিক লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ভুমিকা পালন করে।

 বর্তমানে যেকোন ভাষা থেকে আর্ন্তজাতিক  অঙ্গনে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যবসা বানিজ্য, ভ্রমন, শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে  ইংরেজি ভাষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

কাই চান (Kai Chan) নামের দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক ছিলেন যিনি ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি ভাষায় কথা বলতে জানতেন। এই স্কলার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ভাষা কোনটি তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার গবেষণা অনুযায়ী লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে পরিচিত ইংরেজি ভাষা শীর্ষস্থানে আছে।

বর্তমানে সবচেয়ে কমন লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে বিবেচনা করা হয় যেখানে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারকারীর  ৮০% এর ও অধিক ভাষাভাষীর মাতৃভাষা ইংরেজি না। ইংরেজি ভাষার এই বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে যা ভাষা হিসেবে ইংরেজির ভূমিকা ও কার্যাবলিকে খুব দ্রুততার সাথে বদলে দিচ্ছে। তার একটি সুস্পষ্ট উদাহরন হিসেবে বলা যেতে পারে মৌখিক যোগাযোগে এর ব্যবহার। যোগাযোগের সাধারন মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে ব্যবহার করে দুই ভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যেকার ভাবের আদান প্রদান আমাদেরকে ভাষা হিসেবে ঐতিহ্যগত, প্রথাগত ইংরেজি ভাষার উপযুক্ততা ও  প্রাসঙ্গিকতাকে নিয়ে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করছে।

লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি ভাষা আসলে কতটা নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ভাষার ব্যবহারে স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কি প্রভাবিত করছে নাকি এটা সম্পূর্ণভাবে তার আদি বৈশিষ্ট্য নিয়ে এগিয়ে চলছে; তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের একটি নতুন ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত আলোচনায় উঠে এসেছে যে, ইংরেজি ভিন্ন অন্য ভাষাভাষীদের ইংরেজি ব্যবহারে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষাতত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। এইদিক থেকে বলা হয়, লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি ভাষা কোন ভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক প্রভাব মুক্ত ভাষা নয় বরং এটি একটি বহু সাংস্কৃতিক ভাষা। যদিও এটার ব্যবহার ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে সর্বাধিক কিন্তু তার মানে এই নয় যে ইংরেজি মাতৃভাষাভাষীর লোকজন লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি কে ব্যবহার করেন না। বরং যদি ইংরেজি মাতৃভাষার লোকজন অন্য কোন ভিন্ন ভাষার লোকের সাথে ভাবের আদান প্রদানে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজির উপযুক্ত ব্যবহার না জানেন, সেটা তার জন্য প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করতে পারে। কারন ইংরেজি ভাষা এখানে অন্য ভাষাভাষীর কাছে একটা যোগাযোগের কৌশল মাত্র যেখানে তাকে ভাষার আদি রীতি নীতি মেনে চলতে হচ্ছে না। এই কারনেই লিংগুয়া ফ্রাংকা ব্যবহারকারীদের ইংরেজি ভাষার ব্যবহারকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, শিক্ষার্থী হিসেবে নয়।

লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি ভাষা স্টাডির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও বিট্রিশ ভাষাবিদ, জেনিফার জেনকিন্সকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজিকে কিভাবে দেখেন? উত্তরে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে তিনি ইংরেজিকে কন্টাক্ট ল্যাংগুয়েজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং যারা ভিন্ন ভাষার কোন ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের মাতৃভাষা অথবা অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করে না, তারা কন্টাক্ট ল্যাংগুয়েজ হিসেবে এটার ব্যবহার করে। মাতৃভাষা ইংরেজি ভিন্ন অন্যকোন ভাষাভাষীর লোকেরা এটি সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। সম্প্রতি তিনি ইংরেজীর বহুভাষিক সত্ত্বাকে সামনে রেখে এটাকে পুনরায় নজরে এনেছেন যেখানে তিনি একে মাল্টিলিংগুয়াল ফ্রাংকা বলেছেন এবং ইংরেজিকে বহুভাষিক যোগাযোগ মাধ্যম বলেছেন যেখানে এটা প্রয়োজনীয়তার স্বার্থে বাছাই করা হয়নি বরং অধিক লোকের পছন্দের যোগাযোগের উপায় হিসেবে ইংরেজি ভাষাটাই গ্রহনসাধ্য ছিল। মাল্টিলিংগুয়ালিজম বলতে একের অধিক ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা কে বোঝানো হয়। যেখানে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজির ব্যবহারকারীর বড় অংশ নিজ মাতৃভাষা অথবা ইংরেজি ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় দক্ষতা রাখছে।


গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজ হিসেবে বর্তমানে প্রায় ৩৫০ মিলিয়নের অধিক মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করে এবং ৪৩০ মিলিয়নের অধিক যোগাযোগের দ্বিতীয় মাধ্যমিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে।

পাস্পারিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এই ইংরেজির ব্যবহার যতটা না গঠন বিধির উপর নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এটা কতটুকু কার্যকরী। অন্যভাবে বলতে গেলে, নির্ভুলতা থেকে যোগাযোগ দক্ষতা এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। যদিও বৈশ্বিক যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বাহন বলা হয় এটাকে, তবুও অনেক সমালোচনাও ঘিরে আছে ইংরেজী নিয়ে। তদ্মধ্যে বির্তকিত একটি সমালোচনা হলো- ইংরেজি ভাষাভাষীর রাস্ট্রগুলো ভাষার বহিরাবনে এটাকে চলমান কতৃর্ত্ব ও নেতৃত্ব বজায়ের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে দিয়ে। তথাপি, পৃথিবী যতই বিশ্বায়নের দিকে আগাচ্ছে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে যোগাযোগের স্বার্থে কমন ল্যংগুয়েজের ব্যবহার ততই বাড়ছে আর এখনেই ব্যবহারকারীর দিক থেকে লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ইংরেজি চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।


প্রাসঙ্গিক লেখা

ভাষার বংশগতিবিদ্যা - লাইল জেনকিন্স (১)

চমস্কির নিয়মাদি ও মেন্ডেলের সূত্রাদি, উভয়ের ক্ষেত্রে রীতিসিদ্ধ বংশগতিবিদ্যক নীতিমালাকে স্বীকৃতসত্য হিসেবে ধরা যেতে পারে যা সেখানে কার্যকর ভৌত কার্যপদ্ধতির বিমূর্তায়ন করে এবং উভয় ক্ষেত্রে প্রাপ্ত আপাত-বিরুদ্ধ উদাহরণ অন্তর্নিহিত আরো জটিল বংশগতিবিদ্যক সংগঠনকে প্রতিবিম্বিত করে।

পৃথিবীর সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত ভাষাগুলো

বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোকজন সবসময় পরস্পরের যোগাযোগের সুবিধার্থে তৃতীয় কোন ভাষার সাহায্য নিয়েছে যা কিনা ব্রিজ ল্যাংগুয়েজ হিসেবে কাজ করতো। এবং অধিকাংশ সময়ই সেটা যোগাযোগাকারীর ব্যক্তিদের মাতৃভাষা থেকে ভিন্ন কোন ভাষা হতো যা আজ লিংগুয়া ফ্রাংকা (Lingua Franca) হিসেবে পরিচিত।