নয়া ঘূর্ণির কবি


প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগার বলেছেন, কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা জলঘূর্ণির মতো আমাদের টেনে নিয়ে যায় এবং তা ধীরে ধীরে নয়, হুট করে, মুহূর্তেই। তালাশ তালুকদার বিরচিত ‘সকল প্রকৃতি জঙ্গলে বসে থাকে’ কবিতার বইটি এরকম হুট করে আমাদের তার ভানা ও চিন্তার ঘুর্ণাবর্তে নিয়ে যাবে। তালাশ তালুকদার সময়ের কবি, তার কবিতায় সমসময় আছে। তারা কবিতা লেখার খাতাও তাই সময়। সেখানে নিজের চিন্তার দাগ টেনেছেন। তাই তিনি নিছক কবিদের খাতায় নাম লেখানোর দলের লোক নন। রাজনৈতিকভাবে যেমন, ব্যক্তিক বা সামাজিকভাবেও চলতি হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন ইস্যুকে তিনি সঙ্গি করেছেন তার বইয়ে। সেই চিন্তা ও ভাবনাগুলো তার পথযাত্রী। তবে আদর্শবান নন এই কবি। তিনি আদর্শকে ভেঙে ‘মুক্ত’ এক জামানা তৈরি করতে চান যেন। আবার তার নিজেকে জানান দেয়ারও তাগাদা টের করা যায়। সবমিলিয়ে সকল প্রকৃতি জঙ্গলে বসে থাকে বইটি সময়ের উত্তেজনাকে ধারণ করে, তা রাজনৈতিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং অতিঅবশ্যই শারিরীক।

তার ‘রক্তজব্ধ’ কবিতায় আছে, ‘তোমাকে পোড়ায়ে/ছাইও জুটলো না কপালে/তোমাকে বানাতে বানাতে/ময়লা বানিয়েছি!/তোমাকে ডেকে আনার সূরা-/আবার কোন মুখ নিয়ে/উল্টো করে পড়বো!’। এই প্রবণতা ব্যক্তি অথবা সামাজিক পর্যায়ে একইরকম। আমরা যাকে পাই তাকে কচলে তিতা করে ফেলি সাধারণত। প্রেম আমাদের হাতে ধরা দিলেও আমরা তা ময়লা করে ফেলি। এর সত্যতা বুঝানোর জন্য উদাহরণের প্রয়োজন নেই। তালাশের পাঠকদের খুব কসরত করতে হবে না। আশপাশে, প্রতিদিনের সংবাদে, ফেসবুকের পাতায় মানুষেল কলুষিত মনের গন্ধ সহসাই পাওয়া যায়।

‘আমাদের সংসার’ কবিতায় আছে, ‘নীলচাষের মতো আমাদেরও সংসার/বিভিন্ন এনজিও সমিতির লোকেদের/চা জ্বাল করে খাওয়ানোর জন্য/আমাদের হাড়হাড্ডিগুলোই চারকোল হয়ে গেছে।’ আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার ব্যবস্থাকে একেবারে হালকা করে দিয়েছেন কবি তালাশ তালুকদার। অন্যদের জন্য আমার নিজেদের জোগালি হিসাবে খাটাচ্ছি, নিজের সব জ¦ালিয়ে অন্যদের পুষ্ট করছি বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে। এই রাজনীতি তার পুরো বইজুড়েই আছে। সময়ের সংকটকে এত সহজে কবিতায় উে ফুটিয়ে তুলছেন বলে ইদানিংকালে দেখা যায় না।

কবি হিসাবে তিনি তার সময়ে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করারও একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিষয়টা ব্যক্তিগত থাকেনি। এটা একটা সময়েরই ধড়ফড়ানির শব্দ। তার সময়ের কাজল শাহনেওয়াজ কিম্বা অন্যদেরকে তার মুখোমুখি দাঁড় করানো- এগুলো বাংলা সাহিত্য অথবা বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে ঘটছে। তালাশ তালুকদার ব্যাপারটাকে তুলে এনেছেন কেবল। নিজেকে জাহির করার জন্য তার কবিতাকে ব্যবহার করেননি। তিনি উদ্ধত হলেও সংযত, তার মধ্যে সাহস থাকলে বিনয়ও আছে। 
কারণ তালাশ যে যা না তা হতে চাওয়ার সমালোচনা করেছেন। তার ‘হারামি পুরুষেরা’ কবিতায় আছে, ‘আমি কি বলি নাই/মাথাই নাই যাদের/তারাও মাথা দিতে চাইবে সব কাজে/নাক না থাকলেও/নাক গলাতে আসবে/হারামি পুরুষেরা র’বে সব পুরুষের ভেতরে-’। এই বাক্যগুলো বুঝিয়ে বলার বিশেষ কিছু আসলে নাই। আমাদের নিজেদের জাহির করার অবিবেচক মানসিকতা সমাজে অস্থিরতার জন্য যে দায়ী, এই তত্ত¡ করার জন্য কোনও বিখ্যাত দার্শনিককে ভাড়া করে আনার দরকার নাই। তালাশ ফলে সহজ ও সরল। তার মনে কোনও প্যাঁচ নাই।

তবে তার একটি অদ্ভূত ভালো কবিতা হচ্ছে ‘ডি-কনস্ট্রাকশন’। আমাদের সময়ে জঙ্গিবাদ নাম দিয়ে যে কুপিয়ে হত্যার টনাগুলো ঘটেছে তাকে নিয়ে এমন নির্মম পরিহাস দ্বিতীয়টি নেই। একই সঙ্গে এসব হত্যার যে মনস্তত্ত¡ তাকেও তালাশ ঠুনকো আর হাস্যস্পদ করে ফেলছেন। কবিতার শেষ কয়েকটি বাক্য এমন- ‘ঘাড়ের ভিত ভেঙ্গে দিছে শুধু/মাথার ভেতরেই অসুখটা আছে/তার জন্য মাথাই আলাদা করে দিছে/আঙ্গুলগুলি মেঝেতে মুড়ির মতো ছিটাইছে/মেকার ভাই কই?/-নিলয়রে কুড়ায়া কুড়ায়া আনছি/-এরে ঠিক করি দেন!’ এই কবিতার ভাষাও খেয়াল করার মতো। যা উইটকে আরও উস্কে দিচেছ।

কিন্তু তালাশ তালুকদারের ধর্মতাত্তি¡কভাবেও সমাজকে নিয়ে তার বোঝাপড়া আছে। তিনি মানুষের বস্তুবাদিতাকে ক্রিটিক করছেন। ইগো হিসাবে মানুষ যে নিজেকে ক্ষমতাধর করে তুলছে তাকেও দারুণ এক প্রশ্নের মুখে ফেলছেন তিনি। তার ‘ সাপ ও লাঠির মাথাব্যথা’ কবিতায় আছে, ‘এ জগতের সবগুলো লাঠিই মিথ্যা/এ জগতের সবগুলো সাপই সত্য/কেননা খোদা পাঠাইছে সাপগুলারে
আর মানুষ বানাইছে লাঠিগুলারে/তাই লাঠিগুলো দেখে/যুগে যুগে সাপ চলে আড়ালে আড়ালে!’। অর্থাৎ প্রকৃতিকে বাগে আনার জন্য মানুষ যেসব যন্ত্র বানিয়েছে তার ভয়ে প্রকৃতি তার ¯^ভাব হারাচ্ছে। এবিষয়টিও বিষদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন খুব একটা নাই। 
তালাশ আমাদের নতুন সময়ের কবি। ভাবালুতা মাখা কাব্যিকতা তার নাই। তিনি নিজ¯^ ভাষা ও ভঙ্গিতে তার কবিতাকে তৈরি করেন। এই ভাষা ও ভঙ্গি ঢাকার তরুণ সমাজের স্টাইল। কবিতার ভাষাকে সফেদ ও পবিত্র করে তোলার যে রেওয়াজ ছিল তা ভেঙে দেওয়ার সময়ের কবি তিনি। কাব্যিকতা না পেয়ে অনেকের কবিতা যখন অনেকের হাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নতুন ভাব নিয়ে কবিতা লিখতে এসে তালাশ ভালো করার সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। তিনি নতুন সময়ের বলে জড়তা কম হয়ত। তার কবিতায় শরীর ব্যঞ্জনাও ফুটে উঠেছে যে কারণে দারণ আকুলতায়। আগ্রহী পাঠক এই কবিতার বই হেলায় মিস করবেন না আশা করি।  




প্রথম প্রকাশঃ

প্রাপ্তিস্থানঃ