মোগলনামা (প্রথম পর্ব)


'পানিপথের প্রথম যুদ্ধে' ইবরাহিম লোদীকে পরাজিত করার মাধ্যমে ভারতবর্ষে মোগল শাসন শুরু হয়, তা আমরা সবাই জানি। যেটা জানি না সেটা হল, জায়গাটার না ‘পানিপথ’ না, বরং ‘পানিপাত’। মোগলদের কথা শোনার আগে চলুন, মহাভারত ঘুরে আসি। পাণ্ডবরা কুরুদের কাছে তাদের উত্তরাধিকারের অংশ দাবি করেছিল। যার মধ্যে ছিল পাঁচটি গ্রাম। তাদের নামঃ-
১. পাণ্ডবপ্রস্থ, পরবর্তীতে পানিপাত, 
২. সোনাপ্রস্থ, পরবর্তীতে সোনিপাত, 
৩. ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাত, পরবর্তীতে দিল্লী, 
৪. ব্যঘ্রপ্রস্থ, পরবর্তীতে বাগপাত ও 
৫. তিলপ্রস্থ, পরবর্তীতে তিলপাত নামে পরিচিত হয়।

কুরুরা দাবি মানতে অস্বীকার করলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়। কুরুক্ষেত্র থেকে তিলপাতের দূরত্ব সত্তর মাইল। আর দিল্লী থেকে নব্বই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পানিপাতে (বর্তমানে হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত) বাবরের সাথে ইবরাহীম লোদীর যুদ্ধ হয়।
ভারতবর্ষে মোগল শাসনের কথা বললেই শক্তি, ক্ষমতা এবং জৌলুশের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু মোগলদের ভারতে আসার পেছনে  ছিল কিছু ব্যর্থতার ইতিহাস। প্রথম মোগল সম্রাট জহির-উদ-দীন মুহাম্মদ বাবর, ভারতে আসেন এক রকম বাধ্য হয়ে। উত্তরের শীতপ্রধান দেশ থেকে ভ্যাঁপসা গরমের ভারতভূমিতে আসার আগে তিনি নিজ জন্মভূমি এবং এর চারপাশে নিজের আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছিলেন। বিশেষত সমরকন্দ। কিন্তু সম্ভব হয়নি। যুদ্ধবাজ জাতির মাঝে ছিল বাবরের বসবাস। বাদখশান, উজবেক প্রভৃতি উশৃঙ্খল জাতির সাথে লড়তে হয়েছে। বহুবার সফল হয়েছেন, আবার এসেছে ব্যর্থতা।

বাবরের পিতা উমর শেখ মির্জা ছিলেন ভারতভূমি থেকে উত্তরে পাহাড়ি উপত্যকার ফারগানা নামক রাজ্যের শাসক। রাজ্য ছোট হলেও উমর শেখ ছিলেন তৈমুরি রক্তের অধিকারী। তিনি তৈমুরের চতুর্থ অধস্তন পুরুষ। সেই উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন বাবর। কবুতরের চবুতরা ভেঙে গিরিখাতে পড়ে বাবরের বাবা উমর শেখ যখন মারা যান, বাবর তখন নিতান্তই বালক। রাজ্য হিসেবে ফারগানা ছোট হলেও সিংহাসনের দ্বন্দ্ব সেখানেও কম নয়। মাত্র এগারো বছর বয়সে উত্তরাধিকার বাবরকে সিংহাসনের কাছে নিয়ে আসে। ষড়যন্ত্র চলছিল ফারগানার অমাত্যদের মধ্যে। উমর শেখ মির্জার সময়ের সভাসদদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রভাবশালী। তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কিন্তু বাবরের মা কুতলুগ নিগার খানুম এবং নানি আইসান দৌলত বেগম ছিলেন দৃঢ় মানসিকতার অধিকারী। তাই বালক হলেও মা আর নানীর পরামর্শ এবং এবং বিশ্বাসভাজন সভাসদগণের কল্যাণে বাবর দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ফারগানার সিংহাসন তাঁর কাছেই সুরক্ষিত হয়। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি ফারগানার সিংহাসনে বসেন।

ফারগানার আশেপাশের রাজ্যগুলো আসলে ছিল বাবুরে আত্মীয়দের অধীন। কিন্তু যেখানে সিংহাসন, সেখানে আত্মীয়তা ভয়ের কারণ। তৈমুরি বংশে একটি কথা প্রচলিত ছিল, 'হয় সিংহাসন, নয় মৃত্যু'। বাবর সেকথা খুব ছোটবেলায় বুঝতে পেরেছিলেন। পার্শ্ববর্তী দুই রাজ্যের শাসক বাবরের চাচা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেন, সঙ্গে দরবারী আমীরবৃন্দ তো ছিলেনই। তাদের ইচ্ছে ছিল বাবরের ভাই জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনে বসানো। কিন্তু, সে সব বানচাল করে বাবর সমরখন্দের দিকে নজর দেন। সেখানকার তৎকালীন শাসক ছিলেন তারই চাচাত ভাই। সেই সময়ে, বাবরের পার্শ্ববর্তী প্রায় সকল রাজ্যই ছিল তৈমুরি কিংবা চেঙ্গিসের উত্তরপুরুষ, এবং সব সময়েই অন্তর্দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। সেই সুযোগ নিয়ে ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে সাত মাস ধরে অবরোধের পর বাবর সমখন্দ দখল করেন।
এই সমরকন্দ নিয়েই বাবরের প্রচুর পরিকল্পনা ছিল। পূর্বপুরুষ তৈমুরকে নিয়ে বাবরের গর্বের সীমা ছিল না। বাবরের উত্তরাধিকারীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। পিতার দিক থেকে বাবর ছিলেন তৈমুরের উত্তরপুরুষ এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খাঁ-র। কিন্তু বাবর এবং তাঁর উত্তরাধিকারী সকল পুরুষই চেঙ্গিসের চেয়ে তৈমুরের পরিচয় দিয়েছেন গর্বের সঙ্গে। সমরখন্দ ছিল তৈমুরের প্রিয় শহর। তৈমুর একসময় সাজিয়েছিলেন সমরকন্দকে। বাবর চাইতেন সমরকন্দকে কেন্দ্র করে বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন। তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। বারবার সমরখন্দ তার হাতছাড়া হয়েছে। প্রথমবার সমরকন্দ দখল করার মাত্র একশ দিন পর তিনি ফারগানার পতনের কথা জানতে পারেন। নিজ রাজ্য হারিয়ে সমরখন্দের শাসক ফারগানা আক্রমণ করে। সমরকন্দ ছেড়ে দিয়ে মা-বোন-এবং নানীর সাহায্যে এগিয়ে গিয়ে তিনি বাবর সমরখন্দও হারিয়ে ফেলে সাম্রাজ্যবিহীন এক সুলতানে পরিণত হন।

১৫০১ খ্রিস্টাব্দে বাবর আবার সমরখন্দ অবরোধ করেন। কিন্তু গত চার বছরে বদলে গেছে অনেক কিছু। বদলে গেছে সমরখন্দের শাসক। সে সময়ে সমরখন্দ দখলে রেখেছিলেন বিখ্যাত যুদ্ধবাজ শায়বানী খাঁ। বাবরের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল এই উজবেক। অবরোধ করেও শায়বানীকে তিনি একচুলও টলাতে পারলেন না। বরং যুদ্ধে হেরে গিয়ে বোন খানজাদা বেগমকে শায়বানীর হাতে তুলে দিতে হয়। ফিরে গিয়ে ফারগানাকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে সেখানেও ব্যর্থ হয়ে সামান্য কিছু অনুচর নিয়ে তিনি তাসখন্দে চলে যান। সেখানে তিনি তাঁর এক মামার কাছে আশ্রয় নেন। 'ভাগ্যাহত সুলতান' বাবর একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে তিনি বাদখশানি সেনাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে, তিনি বুঝতে পারেন, ফারগানার আশা তাঁকে ছাড়তে হবে। পিতৃভূমির আশা ত্যাগ করে বাবর অন্য কোথাও তাঁর ভাগ্য পরীক্ষায় নামেন।
বাবরের সমগ্র জীবন ছিল যুদ্ধে ভরা এক মহাকাব্য। তার সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল, উজবেগ নেতা শায়বানি খাঁ। এই শায়বানি তাঁর হাত থেকে সমরকন্দ দখল করে নেন। সাম্রাজ্য হারিয়ে বাবর প্রায় সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন। কবিতা তার নেশা ছিল, অনেক আগে থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি। রাজ্য হারিয়ে এবার বৈরাগ্য পেয়ে বসল। সেই বৈরাগ্য থেকে তিনি কি করে বেড়িয়ে এসেছিলেন তা বোঝাতে বিভিন্ন ফিকশন লেখক বিভিন্ন কথা বলেছেন। রাদারফোর্ড ‘বাবুরী’ নামে এক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। ভবঘুরে এই মানুষটি বাবরের সৈন্যদলে যোগ দিয়ে একসময় প্রভূত উন্নতি সাধন করে। সেই সঙ্গে বাবর পায় একজন বন্ধু। লেখক বাবুরীর মাধ্যমে বৈরাগী বাবরকে অনেক সময় অনেক সু-পরামর্শ দিয়েছেন। এই চরিত্রের সাথে পিরিমকুল কাদিরভের ‘বাবর’-এর তাহির বেগের হুবহু মিল রয়েছে।*১

বাবরের ব্যক্তিগত বা দাম্পত্য জীবনের কথা যদি বলতে হয়, প্রথমা স্ত্রী আয়েশার সঙ্গে বাবরের মনের মিল হয় নি। সৈন্যবল বাড়ানোর জন্য নানীর পরামর্শে মঙ্গোলীয় এক গোত্রপতির কন্যাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন বাবর। কোন কারনে মেয়েটি তার প্রতি বিমুখ ছিল। পরবর্তীতে বাবর আরও তিনজন স্ত্রী গ্রহণ করেন। মাহাম; হুমায়ূনের জননী। গুলরুখ; কামরান ও আসকারির মা। দিলবার; হিন্দালের মা। বিবি মুবারাক; ইউসুফজাই গোত্রপ্রধানের কন্যা। তাঁর আরও কয়েকজন স্ত্রী ছিলেন।

বাবর কবিতা লিখতেন, সেই সঙ্গে লিখতেন দিনলিপি। চাগতাই তুর্কিতে লেখা তাঁর সেই দিনলিপি, উচ্চস্তরের সাহিত্য হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু তিনি যতটা ছিলেন কবি, ততটাই ছিলেন একজন যোদ্ধা।

বাবর কবিতা লিখতেন, সেই সঙ্গে লিখতেন দিনলিপি। চাগতাই তুর্কিতে লেখা তাঁর সেই দিনলিপি, উচ্চস্তরের সাহিত্য হিসেবে সমাদৃত। কিন্তু তিনি যতটা ছিলেন কবি, ততটাই ছিলেন একজন যোদ্ধা। তিনি ফারগানা হারিয়ে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুলে আসেন। কাবুল, উলুঘ বেগের রাজ্য ছিল যিনি এক শিশু উত্তরাধিকারীকে রেখে মারা যান। বাবর কাবুল দখল করে নেন এবং কাবুলের প্রাক্তন শাসকের সমর্থকদের কান্দাহার পিছু হটতে বাধ্য করেন।১৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কাবুলের শাসক ছিলেন।
১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব কম আদায় হওয়ায় বাবর ভারতবর্ষ তথা হিন্দুস্তানের দিকে মনোযোগ দেন। এদিকে একই বছর হিরাতের শাসক মির্জা হুসেইন বাইকারার সাথে মৈত্রী করে শায়বানী খাঁ-র বিরুদ্ধে অভিযানের কথা ভাবেন। কিন্তু ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে বাইকারার মৃত্যুতে সে অভিযান আর করা হয়নি। হিসেবে বাবর একাই ছিলেন তৈমুরের উত্তরাধিকারী। তাই তিনি 'পাদশাহ্‌' উপাধি ধারন করেন। শায়বানিকে তিনি একবারও পরাজিত করতে পারেন নি। শায়বানি নিহত হয় পারস্যের শাহ ইসমাইলের বাহিনীর হাতে। শোনা যায়, শাহ ইসমাইলের সেনাপতি বাবরের হাতে তুলে দেন শায়বানির খুলি দিয়ে তৈরি সুরাপাত্র। 

শাহ্‌ ইসমাইলের সহায়তায় ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে বাবর আবার সমরখন্দ দখল করেন। শুধু তা-ই নয়, শায়বানীকে পরাজিত করে শাহ্‌ ইসমাইল উদ্ধার করেছিলেন বাবরের মন খানজাদা বেগমকে। বোনকে ফিরে পাওয়া এবং সমরখন্দ পাওয়ার খুশিতে বাবর, পারসিকদের একটু বেশিই সুযোগ দিয়ে ফেলেন। আর সে জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয় তাঁকে। সমরখন্দে তাঁর আচরণ ছিল অনেকটাই সাফাভিদের অধিনস্ত এক সামন্ত রাজের মত। পারস্যের সৈন্যরা করেছিল লুঠতরাজ। শুধু তা-ই নয়, এরপরে ছিল ধর্মের প্রশ্ন। সাভাভিদরা ছিলেন শিয়া মতের অনুসারী। সমরখন্দে যখন শিয়াদের লাল তাজের আধিক্য বাড়তে থাকে, তখন মানুষের মাঝে বাড়তে থাকে অসন্তোষ। বাবর বুঝতে পারেন, এভাবে চলবে না খুব বেশীদিন। তাই, সমরখন্দ আবার হাতছাড়া হয় তাঁর।  

সমরকন্দ দখলের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন বাবর। কাবুলে বসে চোখ রেখেছিলেন ভারতবর্ষের দিকে। সেনা-বলের সঙ্গে বাবরের ছিল আধুনিক অস্ত্র। ম্যাচলক ধরনের গাদাবন্দুক ছিল বাবরের নতুন সংযোজন। হিন্দুস্তানে এই অস্ত্র ব্যবহার হয়নি তখন পর্যন্ত। কোথা থেকে তিনি এ জিনিস পেলেন? সম্ভবত অটোমান সুলতানের সেনাবাহিনীতে কাজ করা কোন দক্ষ সৈন্য কিংবা সেনাপতি ঘুরতে ঘুরতে বাবরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সে-ই বাবরের অস্ত্রাগারে গড়ে তোলে এই নতুন অস্ত্র এবং শিখিয়ে দেয় সেনাদের। তারপর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর চড়াও হন হিন্দুস্তানে।
বাবর যখন হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন, দিল্লীতে তখন সিংহাসনে আসীন ইব্রাহীম লোদী। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে বাহলুল খান লোদী, সাইয়িদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে লোদী সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাহলুলের মৃত্যু হলে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নিজাম খান, সিকান্দার শাহ্‌ ওরফে সিকান্দার লোদী নাম ধারন করে সিংহাসনে বসেন। তিনি ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা শহরের পত্তন করেন। সিকান্দারের মৃত্যুর পর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহীম লোদী দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। 

বাহলুল এবং সিকান্দার, উভয়েই সুশাসক ছিলেন। ইব্রাহীম লোদী একজন তুখোড় যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু তাঁর এক নায়কত্ত্ব এবং দমন নীতি লোদী সাম্রাজ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তাঁর সেনাবাহিনীতে তখন চলছে দ্বন্দ্ব। বাবর যখন হিন্দুস্তানের দিকে এগিয়ে আসছিলেন, বাহলুল লোদীর প্রতিষ্ঠিত লোদী সাম্রাজ্য তখন দুর্বল। ইবরাহিম লোদীর কোষাগারে সম্পদের অন্ত নেই। কিন্তু সে খরচে বিমুখ। অসন্তোষ দানা বেঁধে আছে। ইব্রাহীম লোদী, লোকবলে ছিলেন বাবরের চেয়ে অনেক এগিয়ে, তাই তিনি বাবরকে পাত্তা দেননি। কিন্তু বাবর তখন পোড় খাওয়া কৌশলী যোদ্ধা।
তবে শুধু বাবরের কৌশলেই এই যুদ্ধ জয় সম্ভব হতো না। লোদী সাম্রাজ্যে চলমান টানাপোরেন এবং অন্যান্য কারণে লাহোরের প্রশাসক দৌলত খান লোদী নিজে থেকেই বাবরকে দিল্লী আক্রমণের অনুরোধ করেন। বাবর তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন, এবার দৌলতের সহায়তা পেয়ে তাঁর জন্য দিল্লী আক্রমণ অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু, তবুও খুব সহজ ছিল না। কাবুলের মত ছোট্ট একটা পাহাড়ি রাজ্যের শাসক বাবর, অন্যদিকে দিল্লীর সুলতানের শক্তি তাঁর চেয়ে বেশি। তবু সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য মরিয়া বাবর, পানিপাতে ইব্রাহীম লোদীর মোকাবিলা করলেন।
বাবরের জন্য পানিপাতের এই যুদ্ধ ছিল কৌশলে জয়ের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের জন্যই ছিল চমক। ইব্রাহীম লোদীর বিশাল বাহিনী সম্পর্কে বাবর ওয়াকিফ ছিলেন কিন্তু ময়দানে এসে তিনি লক্ষ্য করেন হাতী নামের পাহাড়-সম এক জানোয়ার। হিন্দুস্তানে যুদ্ধে হাতীর ব্যবহার নিয়ে আছে অনেক কৌশল, অনেক কিংবদন্তী। পরবর্তীতে মোগল সম্রাটদের যুদ্ধে, আমোদে হাতী ছিল অপরিহার্য। বাবরের জন্য যেমন বিস্ময় ছিল হাতী, ইব্রাহীমের জন্য বিস্ময় ছিল বাবরের কামান এবং গাদা বন্দুক। তথাপি, বাবরের যুদ্ধকৌশল ছিল অসাধারণ।
বাবর তাঁর সৈন্যদলের ডান দিক পানিপাতের দিকে রাখেন, বাম দিককে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি ট্রেঞ্চের মাধ্যমে সুরক্ষিত করেন। মধ্যভাগে দড়ির সাহায্যে বাঁধা হয় রসদ সরবরাহের ৭০০ গাড়ি, যার আড়াল ব্যবহার করে বাবরের বন্দুকচীরা গুলি করতে পারবে। এবং গাড়িগুলোর মাঝে এমন দূরত্ব রাখা হয় যেন সে জায়গা ব্যবহার করে পদাতিক সৈন্যরা বিপক্ষের উপর আক্রমণে যেতে পারে। এহেন আক্রমণে ইব্রাহীমের বাহিনী হতভম্ব হয়ে পড়ে। ইব্রাহীমের অনেক সৈন্য লড়াই শুরু করার আগেই মারা পড়ে। বাকিদের নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ইব্রাহীম মৃত্যুবরণ করেন। এবং ইব্রাহীমের মৃত্যু বাবরের জয় নিশ্চিত করে। ইব্রাহীমের মৃত্যুর সাথে সাথে দিল্লীতে লোদী সাম্রাজ্যের সমাপ্তি হয় এবং বাবর সিংহাসনে আসীন হওয়ার মাধ্যমে দিল্লীতে মোগল সালতনাতের সূচনা হয়।*২

*১ঃ বাবর নিজেও তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন অল্প বয়সে তিনি একটি ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বাবরের বয়স তখন ১৫-১৬। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আব্রাহাম আর্লি-র মতে সে সময়ে এশিয়ায় 'সমকামীতা', 'উভকামীতা' খুবই সাধারণ আচার ছিল। কিন্তু বাবরের বর্ণনা থেকে এই সম্পর্ককে 'সমকামীতা' বলে সিদ্ধান্তে আসা যায় না। 
*২ঃ বাবর ছিলেন তৈমুরের অধস্তন, চাগতাই তুর্কি। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশের নাম মোগল এবং সাম্রাজ্যের নাম মোগল সাম্রাজ্য। সম্ভবত, মঙ্গোল থেকে অপভ্রংশ হয়ে নামটি মোগল হয়েছে। আলেক্স রাদারফোর্ডের 'এম্পায়ার অফ দ্য মোগল'-এ বলা হয়েছে একটা চিঠিতে পারস্যের সাফাভিদ শাহ্‌ ইসমাইল বাবরকে বর্বর হিসেবে 'মঙ্গোল' বলে বিদ্রুপ করলে বাবর তাঁর বংশের নাম 'মোগল' রাখেন।


প্রাসঙ্গিক লেখা