মানুষের চামড়ায় বইয়ের মলাট


অ্যালান কোয়াটারমেইনের অমর স্রষ্টা নন্দিত লেখক হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কালজয়ী এক গ্রন্থের নাম মিস্টার মিসনস উইল। লেখিকার পিঠের ত্বকে ট্যাটু করে জনৈক প্রকাশকের উইল লিখে যাওয়ার যে বিশেষ ঘটনা সেটা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। তবে যাই হোক তখনকার সমাজে হয়ত এ ধরণের হিংস্র ঘটনার প্রচলন ছিল বলেই লেখক হ্যাগার্ডের কলমে, কল্পকথায়-গল্পগাথায় ঠাঁই নিয়েছে তা। অন্যদিকে বিপ্লবী নিগ্রো নেতার শরীর থেকে খাল ছাড়িয়ে নেয়া; তারপর তার চামড়াতে নিষেধাজ্ঞা পত্র লেখার মত ঘটনাও ঘটেছে ১৮-১৯ শতকের বিশ্বে। যাতে করে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবের সাহস না দেখায় ঐ বিশেষ অঞ্চল কিংবা জনগোষ্ঠীর মানুষ। এমনি কিছু ঘটনা ঘটেছিল এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার অনেক ফরাসি উপনিবেশে। তাদের দেখাদেখি পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরাও এ ধরণের গর্হিত কাজ করে বসে। পাশাপাশি সম্মান ও কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে কেউ কেউ  নিজ চামড়া উৎসর্গ করে অর্ঘ্য কিংবা স্তুতি নিবেদনের কাজ করেছে।

মধ্যযুগের বর্বর ইউরোপে ক্যাথলিক ধর্মদ্রোহের অনেকগুলো শাস্তির একটি ছিল জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলা। ইনকুইজিশনের বিচারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার পাশাপাশি বীভৎস শাস্তি হিসেবে শরীরের চামড়া তুলে সেখানে লবণ ছিটিয়ে দিতে দেখা যায় অনেক দেশে। জলদস্যু পর্তুগিজরা বিশ্বের নানা দেশ থেকে মানুষ ধরে নিয়ে তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করেছে অন্যত্র। এক্ষেত্রে হাতের তালু ছিদ্র করে তার ভেতর দিয়ে দড়ি কিংবা বেতের ছিলা ভরে জ্যান্ত মানুষকে ধরে আনত তারা। বন্দীদশার নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে যারা পালানোর চেষ্টা করেছে তাদের উপর নেমে আসত বীভৎস নির্যাতনের খড়গ। এক্ষেত্রে করাতের মত ছুরির আঁচড়ে পিঠের চামড়া ছিলে ফেলা ছিল তাদের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। আমরা দেখতে চাই বিভিন্ন উৎসব কিংবা দিনানুদৈনিক খানাপিনার অংশ হিসেবে পশুহত্যার পর তার চামড়া ছাড়িয়ে নেয়ার কাজটা করে কসাইরা। তাই বলে জীবন্ত মানুষের চামড়া ছিলে নেয়ার পাশবিকতা কল্পনাশক্তিকেও মাঝে মাঝে হার মানায়। অন্যদিকে সেই চামড়া দিয়ে যদি বই বাঁধাই করা হয় তবে সেটা নিঃসন্দেহে আরও বিপত্তিকর, বর্বর ও পাশবিক। 

ব্রিস্টল রেকর্ড অফিসে একটি মানব চামড়ার বই

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি একটি বই পাওয়া গেছে। বইয়ের মলাট মানুষের চামড়ার তৈরি, এমন বিতর্ক থেকেই শোরগোল শুরু। ভয়ানক এই কাহিনী যে বাস্তব তা নিশ্চিতও করেছেন অনেকে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছেন এ বইটির মলাট মানুষের চামড়া দিয়েই তৈরি হয়েছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন ‘হৃদয়ের ঠিকানা’ তথা ডেস্টিনিজ অব সোল (Destinees de l'Ame) শীর্ষক এ বইটির মলাট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল মানুষের চামড়া। ১৮৮০ সালের দিকে অস্বাভাবিক এবং বর্বর এই বাঁধাইয়ের কাজটা করেছিলেন ডা. লুডভিচ বোল্যান্ড। এর কাছকাছি সময়ে ইংল্যান্ডে এলিজা বালসুমকে হত্যা করে প্রেম প্রত্যাখাত যুবক জন হোরউড। পরে বিচারে তার ফাঁসি হয়। এই বিচার কার্যকলাপের সব নথি তার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে রাখা হয়েছিল ব্রিস্টলে। পরবর্তীকালে ঐ নথি জাদুঘরে রাখা হলে অনেক দর্শনার্থীর কাছে আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল তা। সে সময়টাতে মানুষের চামড়া দিয়ে বইয়ের মলাট তৈরির ব্যাপারটা বেশ খ্যাপাটেরকম জনপ্রিয়তা পায়। ফলে ‘অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেগি’ পদবন্ধে ১৯ শতকের মানুষ এই ঘটনাকে অভিধানে ঠাঁই দেয়। 
বিশ্বের নানাস্থানে কমবেশি মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাইয়ের প্রচলন দেখা দিলেও তা সবথেকে ভয়াবহ রূপ নেয় ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালে। ফরাসি বিপ্লবের পর যাই হোক অন্তত ফ্রান্সে একটা জিনিসের তেমন অভাব ছিল না, সেটা হচ্ছে মানুষের মৃতদেহ। তাই সেখানে পশুর চেয়ে সহজলভ্য হয়ে পড়ে মানুষের চামড়া। সেখানে সবথেকে বেশি সংখ্যক বই মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করতে দেখা গেছে। তারা নানা ধরণের দাপ্তরিক নথি, দিনলিপি, স্মারক এমনকি জন মিল্টনের কবিতার বই পর্যন্ত মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করেছে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ধরণের একটি বইয়ের নমুনা আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে যার সময়কাল মনে করা হচ্ছে ১৮৯৩ সাল। তবে বাঁধাইকারকের কাছে অতটা বেশি পরিমাণ চামড়া ছিল না। তাই সে চামড়াটা ভাগ করে নিয়ে বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করেছে। সে চামড়ার বাইরের অংশ দিয়ে বইয়ের মলাটের উপরের অংশ বাঁধাই করছে; পাশাপাশি নিচের এবং পাশের অংশে ব্যবহার করেছে চামড়ার নিচের অংশ।

ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালে সবথেকে ভয়াবহ শাসক হিসেবে মনে করা হয় ‘রেইন অব টেররের’ ম্যাক্সিমিলিয়েন রোবেসপিয়েরকে। তার সময়কাল ফ্রান্সের সন্ত্রাসবাদী যুগের মধ্যে সবথেকে হিংস্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ১৭৯৪ সালে তার নেতৃত্বাধীন ফরাসি সরকার একটি ডিক্রি জারি করে। এর মাধ্যমে ফ্রান্সের প্রত্যেক গ্রামের মানুষকে একটি অনুষ্ঠানে (Festival of the Supreme Being) অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। প্যারিসের ঠিক দক্ষিণের একটি গ্রাম মিউদোঁ। সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল বিশেষ কার্নিভাল। এখানে রাজকীয় পোশাকে সাজিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল এক নারীকে। বিভিন্ন জনশ্রুতি মতে উৎসবের অংশ হিসেবেই তাকে হত্যা করেছিল রোবেসপিয়েরের সৈন্যরা। কিন্তু অন্য কিছু সূত্র থেকে জানা গেছে তারা মেয়েটিকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল সেন্ট মার্টিন গির্জার আঙ্গিনায়। আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত থাকা রোবেসপিয়েরে সাঙ্গ-পাঙ্গদের অনেকেই জানত এখানে কি হতে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্যারেড করে আসা সেনাদল এবং সমর্থকরাও যোগ দেয়। মিউদোঁর অনুষ্ঠান শেষ হতেই তারা গিয়ে হাজির হয় আইফেল টাওয়ারের কাছাকাছি চ্যাপস দ্য মার্শেঁ নামক স্থানে। সেখানে রোবেসপিয়ের এবং তার সন্ত্রাসবাদী শাসনের অন্যতম হোতা জ্যাক লুই ডেভিড সর্বোচ্চ সম্মান গ্রহণ করে। সেখানে মানুষের পিঠে মানুষ চেপে বিশালাকৃতির পিরামিডের মত বানানো হয়। 

মানুষের তৈরি পাহাড়সম সেই পিরামিডে ওঠার পর নানা ধরণের ফুল ও ফুলের তোড়া, ফল এবং শস্য দিয়ে সম্মান জানানো হয় ফরাসিদের নেতা রোবেসপিয়েরকে। তখন তার পরনে ছিল নীল রঙের বিশেষ পোশাক। এরপর উপর হাঁটু পর্যন্ত অনেকটা মেয়েদের স্কার্টের মত দেখতে বিশেষ চামড়ার তৈরি পোশাক ‘সুয়েত কুলোত’(Suède culottes) পরতে দেখা গেছে তাকে। তখন সমবেত জনতার অনেককে ফিসফিস করে বলতে দেখা গেছে তার এই সুয়েত কুলোত আর কিছুই না বিদ্রোহীদের পিঠের চামড়া থেকে তৈরি। তখন প্যারিসের আশেপাশে যত বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই পিঠের চামড়া ছিলে নেয়া হয়েছিল। পরে তাদের পিঠের চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ধরণের স্মারক যেমন তৈরি করা হয়েছে, তেমনি সেগুলোকে কাজে লাগানো হয়েছিল বই কিংবা ডায়েরির মলাট তৈরিতে। এ ধরণের মানুষের চামড়া ট্যান করে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে তখন প্যারিসের কাছাকাছি মিউদোঁ অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ ধরণের ট্যানারি।

Proven anthropodermic books from the Mutter Museum collection.

এখনকার দিনে এসে ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালের বীভৎস দৃশ্য কল্পনা করেও শিউরে উঠতে পারেন। তবে মানুষের চামড়া ছিলে নিয়ে তা দিয়ে বই বাঁধাই কিংবা পোশাক তৈরির চেয়েও বীভৎস নজির ইতিহাসে রয়েছে। অন্তত হালাকু খানের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গল সেনাদল বাগদাদ কিংবা দামেস্ক আক্রমণের সময় হত্যাকাণ্ডের যে নজির স্থাপন করেছিল সেটা এর থেকেও ভয়ানক ছিল। ক্রুসেডাররা যখন সিরিয়ার মা’আরা আল নুমান আক্রমণ করে সেখানে তারা স্থানীয় মুসলিম ও ইহুদি জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার পর তাদের মাংস বিক্রি করেছে। অনেক ক্রুসেডারের দিনলিপি থেকে পাওয়া গেছে তারা খাদ্যাভাব নয় শুধুমাত্র হিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই জীবন্ত শিশুদের শিকে গেঁথে পুড়িয়ে তাদের মাংস খেয়েছে। ১৭৯৪ সালের পর ফ্রান্সে যা ঘটেছে সেগুলোকে কেউ কেউ অতিকথন কিংবা কল্পকথা বলে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবেন। তবে সেখানে অনেক ঘটনা কল্পনাতীত জিঘাংসার নজির স্থাপন করেছিল নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে সেখানে বিপ্লবের নামে যা ঘটেছে সেটা আর কিছুই নয় নিছক পাশবিকতা। তারা মাত্র এক দিনের মধ্যে হাজার খানেক মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। গিলোটিনে মানুষের ধড় থেকে মাথা আলাদা করার পর সেখানে এত রক্ত প্রবাহিত হয়েছে যে পরপর কয়েকদিন রাজপথ চলাচলের জন্য উপযুক্ত ছিল না। তবে অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে ফ্রান্সের এই রাজনৈতিক  হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ হয়েছে গিলোটিনে। আর একটি দল থেকে অন্য দলের হাতে ক্ষমতার পালাবদলে নতুন করে আরেকদফা হত্যাকাণ্ডের সূচনা করেছে।  
রোবেসপিয়েরের পর থেকে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়েছিল মানুষ তার তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করে পর পর কয়েক বছর। বিশেষ করে এ সময়টাতে যে পরিমাণ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেট কল্পনাতীত। আর বিরোধী দলের কোন নেতাকে হত্যার পর তার চামড়া দিয়ে সুয়েত কুলোত তথা বিশেষ স্কার্ট তৈরি করে সেটা পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে অনেক বিজয়ী নেতাকে। বিপ্লবের সময়কালে ফ্রান্সের অন্যতম পরিচিত রিপাবলিকান জেনারেল ছিলেন বেইসার। তার সময়েই মূলত পরাজিত নেতাদের শরীরের চামড়া খুলে নিয়ে তা দিয়ে সুয়েত কুলোত তৈরির প্রচলন ঘটে। এর থেকে বাদ পড়েননি ফরাজি রাজা ষোড়শ লুইয়ের জ্ঞাতি ভাই লুই ফিলিপ্পে। তিনি নিজের জ্যাকোবিনদের দলে ভিড়ে নিজের নাম বদলে রেখেছিলেন ফিলিপ্পে এগালিতে। তার সময়ে মানুষের চামড়া থেকে তৈরি সেলাইবিহীন সুয়েত কুলোতের ব্যপক প্রচলন ঘটেছিল ফ্রান্সে। এসময় পোশাক হিসেবে মানুষের চামড়ার ব্যপক প্রচলন ঘটার পাশাপাশি কেউ কেউ বইয়ের মলাট তৈরিতেও আগ্রহ দেখায়। বই, দিনলিপি, দাওয়াতনামা, স্মারক প্রভৃতিতে ফ্রান্সের মানুষ তখন যেভাবে মানুষের চামড়া ব্যবহার করেছে সেগুলোই পরে ‘অ্যানথ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেগি’ পদবন্ধে ঠাঁই নেয় ইতিহাসে। 
ফ্রান্সের বিখ্যাত সমাধি ‘লে বাল দু জেফির’। সেখানে একটি বলের পাশাপাশি ‘দ্রোইতেস দ্য লা হোম্মি’ শীর্ষক বিশেষ লিফলেট রাখা হয়েছে যার যা বাঁধাই করা হয়েছিল মানুষের চামড়া দিয়েই। এই লিফলেট যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে এর পাশাপাশি আরও কিছু বই রয়েছে যেগুলো মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। সেখানে সবথেকে অবাক করার বিষয় হচ্ছে পঞ্চদশ লুইয়ের পর থেকে ফরাসি রাজাদেরও যে বংশলতিকা তৈরি করা হয়েছে সেই বইটিও বাঁধাই করা মানুষের চামড়া দিয়ে। ‘রেলিগাতাম দ্য পেল্লে হিউমানা’ কিংবা ‘রিলাইই এন পিয়াউ হিউমানি’ শীর্ষক লিপিগুলোর এর সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রচলিত ধারণাকে আরও শক্ত ভিত্তির উপর এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে বাস্তবে পুরোপুরি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বইয়ের প্রচলন ঘটেছিল উনিশ শতকে। ফ্রান্সের পাশাপাশি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও এমন নমুনা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও ফরাসিরা পাশবিকতায় সবাইকে  ছাড়িয়েছে। তারা ‘মার্কুইস দ্য সাদে’র ‘জাস্টিন এট জুলিয়েট’ বাঁধাই করা হয়েছে এক নারীর চামড়া দিয়ে। অন্যদিকে ফ্রান্সের কুখ্যত বই ‘এরাটিকা’ বাঁধাই করা হয়েছে এমনভাবে যে তার মলাটে মানুষের স্তনবৃন্ত দৃশ্যমান। এমনি সব কৌতুহলোদ্দীপক বীভৎস কীর্তিরাজির বেশিরভাগই ঠাঁই পেয়েছিল অনেক অভিজাত ফরাসির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় যা সত্যিকার অর্থে মানুষের চামড়ায় বাঁধাই কিনা যাচাই করে দেখার সুযোগও বেশ কম। ‘অ্যানথ্রোপোডার্মিক বুক প্রজেক্ট’ এর জনৈক গবেষক নিশ্চিত করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরিতে কম বেশি ৪৭ টির মত বই রয়েছে যেগুলোর বাঁধাই হয়েছিল আর কিছু নয় মানুষের চামড়া দিয়েই। এগুলো তাঁর পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে কারণ তার বেশিরভাগই রক্ষিত আছে বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে। তিনি সেখান থেকে নমুনা নিয়ে তার ল্যাবরেটরি পরীক্ষার পর নিশ্চিত করেছেন এগুলো আসলে মানুষের চামড়া দিয়েই তৈরি হয়েছিল। 
একটা বই সত্যিকার অর্থে মানুষের বাঁধাই করা নাকি অন্য কোনও পশুর চামড়ায় করার পরেও তাকে মানুষের চামড়া বলে মনে করা হচ্ছে এটা নিয়ে পরীক্ষা করতে হয় দুস্তর। বিশেষ করে ‘পেপটাইড মাস ফিঙ্গারপ্রিন্টিং’ এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। একে সংক্ষেপে পিএমএফ বলা হয়। প্রত্যেকটা প্রাণির চামড়ায় বিশেষ গাঠনিক বৈচিত্র্য থাকে যা এর শনাক্তকরণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতিটা প্রাণির চামড়ায় যে কোলাজেন তন্তু থাকে এগুলো গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে অনন্য। এর গাঠনিক ভিন্নতা থেকে সহজেই পরীক্ষাগারে শনাক্ত করা সম্ভব চামড়াটি কোন প্রাণির। তবে ট্যান করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন পড়ে থেকে এই বইয়ের মলাটগুলোর ডিএনএ নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে সহজে সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি ১৭০৯ সালের দিকে লেখা জন লকের একটি বইয়ের মলাট নিয়ে সম্প্রতি গবেষণা করেছে ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক। তাঁদের হিসেবে এই বইটির মলাট মানুষের নয় বরং পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। একইভাবে ১৬৭১ সালের দিকে লেখা একটি প্রার্থনার বইয়ের মলাট নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক্রফট লাইব্রেরি। আগে এই বইটি মানুষের চামড়ায় বাঁধাই বলে দাবি করা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করা গেছে এটা ঘোড়ার চামড়ায় তৈরি।

এক নারীর শরীরের চামড়া দিয়ে বাঁধানো হয়েছে এই বই

১৮৯১  সালের দিকে লেসবিয়ান থিম নিয়ে ফ্রান্সে একটি বিতর্কিত উপন্যাস লিখে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন অ্যাডলফে বেলোত। ‘মাদামোইসলে গিরাউদ’ নামেই এই বইটির মোড়ক অবিশ্যি মানুষের চামড়ায় তৈরি। এই বইটির মলাটের চামড়া ফরাসি বিপ্লবের সময় সংগ্রহ করা হয়নি। এই বইয়ের মলাটে ব্যবহƒত চামড়াটি জনৈক হতভাগ্য মার্কিন নারীর। ১৬৬৮ সালের দিকে এই নারী ফিলাডেলফিয়ার একটি হাসপাতালে যক্ষ্মায় মারা গিয়েছিলেন। ফ্রান্সের পরিচিত একজন চিকিৎসক ছিলেন আন্দ্রেস ভেসালিয়াস। তিনি অনেক মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে ঐ সময়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার পর হঠাৎ তার মধ্যে খেয়াল জাগে অদ্ভুতুড়ে সব আর্ট কালেকশন ও তৈরির। অন্তত সামাজিক অবস্থান ও অর্থবিত্তের দিক থেকে তিনি এমন একটা অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে কথা বলার সক্ষমতা সে সময়ে তেমন কারও ছিল না। তার সংগ্রহে থাকা অনেকগুলো ছবির পাশাপাশি বইয়ের মলাট তিনি তৈরি করেছিলেন মৃত মানুষের চামড়া থেকে। তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক অভাবী মানুষ দুরারোগ্য ব্যধিতে মারা গিয়েছিলেন। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত মৃতদেহ পর্যন্ত দাবি করতে দেখা যায়নি। এ ধরণের রোগীদের মৃতদেহ যেমন শবচ্ছেদসহ নানা পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে। তেমনি ডাক্তার ভেসালিয়াস তাদের চামড়া দিয়ে নিজের লেখা বেশ কিছু বই বাঁধাই করেছেন। বিখ্যাত এ শল্য চিকিৎসকের এমনি বাঁধাই করা বেশ কিছু বই এখনও পড়ে আছে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হে লাইব্রেরিতে। 
ফ্রান্সে শল্য চিকিৎসার প্রসারের সময়টাতে পরীক্ষনের কাটা ছেঁড়ায় ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় মৃতদেহের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের থেকে। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত খুনীদের শাস্তি কার্যকরের পর ফরাসি ডাক্তাররা ময়নাতদন্তের সময় কিংবা ডিসেকশনের আগে তাদের শরীর থেকে চামড়া খুলে নিতেন। এরপর সেই চামড়া বিশেষভাবে ট্যান করে তা দিয়ে বইয়ের মলাট থেকে শুরু করে এ ধরনের নানা কাজে লাগাতে দেখা গেছে তাদের। এক্ষেত্রে উইলিয়াম বার্কের ঘটনা বলা যেতে পারে যার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছিল একটি পকেট সাইজের বই। ডাক্তারদের কাছে মৃতদেহ বিক্রির লালসা তাকে একজন সিরিয়াল কিলারে পরিণত করে। সে অর্থলোভে মানুষ হত্যা করে তাদের বিক্রি করত বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে। একটা পর্যায়ে আইনের কাছে ধরা পড়লে তার মৃতদেহও ডাক্তারদের ছুরির নিচ থেকে রক্ষা পায়নি। তার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বইটি এখনও রক্ষিত আছে এডিনবার্গে সার্জন হল জাদুঘরে। এখনকার দিনে মৃত্যুদণ্ডের সময়টাতে উপস্থিত থাকতে চান না বেশিরভাগ ডাক্তার। তারা মনে করেন এটা অনৈতিক ও অমানবিক। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষেত্রে বিষয়টা ছিল অনেকটাই উল্টো। বেশিরভাগ ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইতেন না। যেভাবেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক ময়নাতদন্তের নামে পুরো দেশ কাটাছেঁড়া করতে পৈশাচিক উš§ত্ততা নিয়ে নিযুক্ত হতে দেখা গেছে অনেক চিকিৎসককে।

ফরাসি বিপ্লবের সময় মানুষের চামড়া দিয়ে পোশাক তৈরি কিংবা বই বাঁধানোর মত পার্ভাসিভ রিউমার যতগুলো শোনা যায় বলতে গেলে তার বিপরীতে আরও কথা ছিল। অন্তত ফরাসি বিপ্লবের আগে একমাত্র অভিজাত সম্প্রদায় বাদে কারও পক্ষে অসুস্থ অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সামর্থ ছিল না। অভিজাত ব্যক্তিরা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব যেমন ডাক্তার ও নার্সদের উপর বর্তাত। তেমনি সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার দায়ভার ছিল অনেকটাই তাদের পরিবারের। এর বাইরে যাদের পরিবার ও ঘর সংসার ছিল না তারা অসুস্থ হলে বিভিন্ন দাতব্য চিকিৎসালয় কিংবা চার্চের ডাক্তার-নার্সদের সেবা ভাগ্যে জুটত। নতুন করে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠলে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে চিকিৎসাসেবায় সবার সুযোগ বাড়ে। তখন বিভিন্ন রকম রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তারদের দক্ষতা যেমন বেড়ে যায়, তেমনি তারা অনেক অপকর্মেও যুক্ত হয়। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ফরাসি বিপ্লবের পর ডাক্তারদের দক্ষতা বেড়েছিল বহুগুণে, তবে তারা এ সময়টাতে যে পরিমাণ অপরাধকর্মে যুক্ত হয়েছিল সেটাও নজিরবিহীন এবং ভয়ানক। প্যারিস স্কুলের মেডিক্যাল শিক্ষা যেমন পুরো পশ্চিমা বিশ্বে নাম করেছিল তেমনি এদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধও নিছক ঠুনকো নয়। ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে লাশ চুরি করে শবচ্ছেদ তো বটেই নেক্রোফিলিয়া ও পেডোফিলিয়ার মত পাশবিকতা তাদের মাধ্যমে ঘটেছিল।
ফ্রান্সে মানুষের চামড়ার বই বাঁধাইকরণে ডাক্তারদের ভূমিকা কেমন ছিল এটা বোঝার ক্ষেত্রে মিশেল ফুঁকোর বিখ্যাত ‘দি বার্থ অব দি ক্লিনিক’ থেকে রেফারেন্স নেয়া যেতে পারে। ফুঁকো দেখিয়েছেন ফরাসি বিপ্লবোত্তরকালে ডাক্তাররা চিকিৎসা শাস্ত্রের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন ঠিকই। তবে তারা একের পর এক চিকিৎসা করতে গিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত অবস্থায় রোগীদের মানুষ না ভেবে সরাসরি ‘ডিজএমবডিয়েড সিম্পটম’ কিংবা সমাজের রুগ্ন অঙ্গ হিসেবেই মনে করতেন। এদিক থেকে চিন্তা করতে গেলে মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা বই আর কিছুই না এমনি চিন্তার প্রতিফলন। ডাক্তারদের কেউ কেউ মনে করেছেন মৃত রোগীর চামড়া দিয়ে তাদের মূল্যবান বইগুলোকে বাঁধাই করা দোষের কিছু না। অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের কেউ রোগী হলে তাদের চিকিৎসা এবং মৃতদেহ নিয়ে আÍীয়-স্বজন অনেক প্রশ্ন তুলতে পারে ভেবে সতর্ক থাকতেন ডাক্তাররা। তবে দরিদ্রদের চিকিৎসা করতে গিয়ে হেলাফেলা এবং মৃত্যুর পর তাদের শবদেহ নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা ছিল না কারও। তাই মানবাধিকারের প্রশ্ন চুলোয় দিয়ে ডাক্তারদের কেউ কেউ যেমন ফ্যান্টাসি থেকে রুগিদের একের পর এক ডিসেকশন করেছেন, তাদের শরীরের নানাস্থানের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই করতে তাদের বিবেক দংশিত হয়নি ঘুণাক্ষরেও।

The Guillotine

ফরাসি বিপ্লবের রক্তারক্তি আর লঙ্কাকাণ্ডের বিপরীতে কিছু ব্যাপার ঘটে যায় যেটা ইতিহাস বদলে ভূমিকা রেখেছিল নিঃসন্দেহে। বিপ্লবীরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৭৮৯ সালের দিকে ‘ডিক্লারেশন অব দি রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড সিটিজেন’ ঘোষণা করে। এর আলোকে ১৭৯৩ সালের দিকে ফ্রান্সের সংবিধান সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ছিল দাসপ্রথার বিলুপ্তিকরণ, তার বাইরে মানুষের সত্তাকে বিক্রি করে দেয়া বন্ধ হয় প্রথমবারের মত। মানুষ তার প্রয়োজনে যেকোনও কাজ করতে পারবে ঠিকই, তবে এর অর্থ সে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছে এমন নয়। অন্তত এই আইনের ভিত্তিতেই একজন মানুষ জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় তার শরীরের কোন অংশের উপর অন্য কারও অধিকার থাকবে না। এদিক থেকে চিন্তা করলে মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধাইয়ের বিষয়টি তার সত্তাকে আঘাত করে। শেষ পর্যন্ত এই বই যখন একটা আর্টিফ্যাক্টে রূপ নেয়; তা আদতে মানুষের অঙ্গ দিয়ে তৈরি, কার্যত অনৈতিক ও অমানবিকতার স্মারক। আর তাই মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বইগুলো আর সব বইয়ের মত সেলফে রাখার বৈধতা হারায়। ঠিক যেমনিভাবে একদল মানুষ আর হেঁটে যাওয়ার একপাল গরুর মধ্যে তখন সবাই পার্থক্য করতে শিখেছিল। তাই ডাক্তাররা চিকিৎসার পাশাপাশি অন্তত মানুষের মৃতদেহ নিয়ে যথেচ্ছাচারের সুযোগ হারিয়েছিল এ সময়টাতে। ১৭৯৩ সালের পর থেকে বিভিন্ন স্থানের মানুষের চামড়ায় বাঁধাই করা বই জব্দ হতে থাকে। তখনকার সংশোধিত সংবিধানে ‘ডিক্লারেশন অব দি রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড সিটিজেন’ নিয়ে সংরক্ষণ করা হয় প্যারিসের ‘মুজি দ্য কার্নাভালেত’। এর মাধ্যমে মূলত মানুষের চামড়া ও অঙ্গপ্রতঙ্গ শিল্প বা অন্যকাজে লাগানো নিষিদ্ধ হয়েছিল।

বিখ্যাত গবেষক লরেন্স থমসন লিখেছিলেন ‘মিউদো ট্যানারি থেকে যে পরিমান মানুষের চামড়া ট্যান করে নানা কাজে লাগানো হয়েছে, ফরাসি বিপ্লবের সময় নিহত ঐ পরিমাণ মানুষের মৃত্যুর সঠিক নথিভুক্তকরণ পর্যন্ত আজও সম্ভব হয়নি। তিনি কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন বীভৎস এ ধরণের বইয়ের উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে। তিনি নিজে ফ্রান্স ভ্রমণ করতে গিয়ে এ ধরণের বই নিজে চোখে দেখেছেন। মানুষের দ্রুত পচনশীল চামড়ার সংরক্ষণ যেখানে অনেকের কাছে ছিল অপার বিস্ময় সেখানে এই চামড়া দিয়ে বই বাঁধাই সবাইকে হতবাক করে। সহস্র বছর পূর্বে মিসরের পিরামিডে প্রাপ্ত মমি যেমন কৌতুহলোদ্দীপক, তেমনি মাত্র কয়েক’শ বছর আগে পাশবিক ধারণায় তৈরিকৃত এ ধরণের বই আমাদের এখনও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। লরেন্স যে বই দেখেছেন সেটা দেখে তিনি মন্তব্য করেছেন এটাকে দেখলে মনে হয় বাচ্চা শুয়োরের চামড়া ট্যান করে এমনটা বানানো হয়েছে। তবে পরবর্তীকালে পরীক্ষা করে দেখা গেছে বহুবর্ণিল মলাটের এই বইটির প্রচ্ছদ তৈরি হয়েছে মানুষের চামড়া ট্যান করে। অনেক জাঁকালো অলঙ্করণ ও রতœপাথরের মধ্যে সাজানো এ বইয়ের বাইরের অংশে রয়েছে বেশকিছু বুদবুদ। সেগুলোকে সুদর্শন করতে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে সবুজ, হলুদ, কালো, সাদা, লাল এবং বাদামি রঙ। এ বইটির ভিতরে সুন্দর হস্তাক্ষরে রয়েছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথি। এর ভেতরেই সংযুক্ত একটি নথি বলছে এই বই মানুষের চামড়ায় বাঁধাই করা। এই বইটি এত উপকরণ থাকতে কেন মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে তার উপযুক্ত বিবরণও যুক্ত হয়েছে এখানে। পরবর্তীকালে অ্যানথ্রোপোডার্মিক বুক প্রজেক্টের গবেষকরা এই বইয়ের চামড়ার গাঠনিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের অনুমতি প্রার্থনা করে। তারা এটা পরীক্ষার পর দেখেছেন অনুমান সত্য, আর কিছুই নয় মানুষের চামড়াতেই তৈরি হয়েছে এটি। তাদের হিসেবে এটা ঐ সময়ের স্বৈরশাসনের পাশাপাশি অনৈতিক আচরণ বৃদ্ধির স্মারক এই বই।

বইয়ের মত পবিত্র উপকরণের মলাট নিয়ে যে মর্মন্তুদ কাহিনী তার সূত্রপাত অনেকের হিসেবে মিউদো গ্রাম থেকেই। পঞ্চদশ লুইয়ের সময় এই গ্রাম অনেকটা হান্টিং লজ এর মত ছিল। তার সময়ে শিকার করে আনা নানা জন্তুর চামড়া ট্যন করে তার থেকে বিভিন্ন শৌখিন উপকরণ তৈরি শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ট্যানারি থেকে যে মানুষের চামড়াও ট্যান করা হবে সেটা ছিল কল্পনাতীত। ফরাসি বিপ্লবের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে এই গ্রামের গুরুত্ব প্রায় পুরোটাই ম্লান করে একে একটা কসাইখানার চেহারা দিয়েছিল। নৃশংস পাশবিকতার ষোলকলা পূর্ণ করতে মিউদো গ্রামের সেই কুখ্যত ট্যানারির কথা বলাই বাহুল্য যেখানে মানুষের চামড়া ট্যান করা হত। অবাক করার বিষয় হচ্ছে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সেই পাশবিক ট্যানারির ধ্বংসাবশেষ এখনও টিকে আছে জিঘাংসার স্বাক্ষী হয়ে। তাই মিউদো গ্রামে মানুষের চামড়া ট্যান করার গাল-গল্প যেমন মানুষের মুখে মুখে  ঘোরে, কিংবা ইতিহাসের বইয়ে ঠাঁই নিয়েছে সেটাকে অস্বীকার করার সুযোগ যথেষ্ঠ কম। এতকিছুর পরেও সম্প্রতি মিউদো শহরের হিস্টরিক্যাল সোসাইটি মিউদোর সেই ঘটনাগুলোকে মিথ হিসেবে দাবি করে। তাদের হিসেবে মানুষের চামড়া ট্যান করার সেই ট্যানারি আর কিছুই না নিছক প্রোপাগান্ডা এবং মানুষের ফ্যান্টাসির অংশমাত্র। তবে তারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে বিষয়গুলো স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে তার থেকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে এখানে অমন অপকর্ম কখনও ঘটেনি।

ফরাসি বিপ্লবের আগেও ফ্রান্সের সঙ্গে বিশ্বের আরও অনেক দেশের যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধ উপকরণের ক্রমবিস্তৃতির এক পর্যায়ে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনী বেশ সুনাম অর্জন করে। অন্তত উনিশ শতকের দিকে এসে ফরাসি বাহিনী অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। তারা একের পর এক প্র“শিয়া, অস্ট্রিয়া, গ্রেট ব্রিটেন কিংবা স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এই যুদ্ধগুলোতে পরাজিত সৈন্যদের মৃতদেহ থেকে খাল ছাড়িয়ে নেয়ার মত অপকর্ম ফরাসিরা করেছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে অনেক সূত্র থেকে। বিশেষ করে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালিন বেশ কিছু স্থানে মিউদোর মত ট্যানারি গড়ে উঠেছিল বলে প্রমাণও মিলেছে। অন্যদিকে ফরাসি বিপ্লবের আগে কিংবা পরে বাঁধাইকৃত বেশ কিছু বইয়ের মলাট থেকে নেয়া নমুনায় প্রমাণ মিলেছে এগুলো মানুষের চামড়া দিয়েই তৈরি করা হয়েছিল। ফলে ফরাসি বিপ্লবের সময় মিউদো গ্রামে মানুষের চামড়া ট্যান করার জন্য ট্যানারি প্রতিষ্ঠার যে গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কিংবা সমকালিন ইতিহাসের ঠাঁই পেয়েছে সেটা অবিশ্বাস করার সুযোগ আরও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ফরাসি বিপ্লবকে মহান করে দেখার যে প্রবণতা অনেক সাধারণ মানুষ এমনকি ইতিহাসবিদদের মধ্যে লক্ষ করা যায়, এ ধরণের পাশবিকতার ইতিকথা তাদের কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। যাই হোক এটা একঅর্থে ইতিহাসের অংশ হলেও ক্ষেত্রবিশেষে হরর চলচ্চিত্রের গল্পকেও হার মানায়। 

লেখক: ইতিহাসের শিক্ষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যলয়।

তথ্যসূত্রঃ

  1. Anita Dalton, Anthropodermic Bibliopegy: A Flay on Words, Odd Things Considered, 9 November 2015
  2. Carolyn Marvin, 'The body of the text: literacy's corporeal constant', Quarterly Journal of Speech 80(2) (1994), pages 129-149 .
  3. Jacob Gordon, In the Flesh? Anthropodermic Bibliopegy Verification and Its Implications, RBM: A Journal of Rare Books, Manuscripts, and Cultural Heritage 17(2) (2016), pages 118-133.
  4. Harrison, Perry Neil (2017). "Anthropodermic Bibliopegy in the Early Modern Period". In Larissa Tracy. Flaying in the Pre-Modern World: Practice and Representation. Woodbridge, Suffolk, UK: D.S. Brewer. pp. 366–383.
  5. Hertzberg, Edward (1933). Forty-four years as a bookbinder. Chicago: Ernst Hertzberg and Sons Monastery Hill Bindery. p. 43.
  6. Megan Rosenbloom, A Book by its Cover: Identifying & Scientifically Testing the World's Books Bound in Human Skin, Watermark: Newsletter of the Archivists and Librarians in the History of the Health Sciences, 39(3) (Summer 2016), pages 20–22
  7. Smith, Daniel K. (2014). "Bound In Human Skin: A Survey of Examples of Anthropodermic Bibliopegy". In Joanna Ebenstein, Colin Dickey (eds.). The Morbid Anatomy Anthology (First ed.). Brooklyn, New York: Morbid Anatomy Press. 
  8. Lawrence S. Thompson, Tanned Human Skin, Bulletin of the Medical Library Association, 34(2) (April 1946), pages 93–102
  9. Lawrence S. Thompson, Religatum de Pelle Humana, in Bibliologia Comica (Hamden, Connecticut: Archon Books, 1968), pages 119-160.  
  10. The Anthropodermic Book Project, The Science, checked 10 June 2017.
  11. একেএম শাহনাওয়াজ ও মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস (১৪৫৩-১৭৮৯ খ্রি.)
  12. একেএম শাহনাওয়াজ ও মো. আদনান আরিফ সালিম, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস (১৭৮৯-১৯৪৫ খ্রি.)

প্রাসঙ্গিক লেখা