প্যারেন্টিং (প্রথম পর্ব)


প্যারেন্টিং খুব গুরুত্বপূর্ন একটি ব্যাপার। একজন মানুষ বড় হয়ে কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে তাকে কিভাবে এবং কোন পরিবেশে বড় করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ভুল মনে না হলেও এমন অনেক ব্যাপার আছে যা একজন মানুষের মানসিক গঠনে সমস্যা তৈরি করে, ভুল ভাবে বেড়ে ওঠে। আপনার বাচ্চাকে কিভাবে বড় করবেন, কী শেখাবেন এবং কিভাবে শেখাবেন, এগুলো সব প্যারেন্টিং এর আওতাধীন। প্যারেন্টিং নিয়ে এই ধারাবাহিকের এই পর্বে সংক্ষেপে বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ও পরিচর্যার কিছু বিষয় নিয়ে বলা হবে।

প্যারেন্টিং - ১
ভালো প্যারেন্টস নিশ্চিত তখনি হবে যখন ম্যারেজটা ভালো হবে। দুইজনের যেকোন একজন ভালো প্যারেন্ট হয়ে লাভ নাই।

প্যারেন্টিং - ২
ভালো ম্যারেজ এবং দুইজনই ভালো প্যারেন্ট হওয়ার পরেও ফ্যামিলির কারণে অনেক সময় বাচ্চারা স্পয়েল হতে পারে।

#প্যারেন্টিং - ৩
কোনকিছু নিষিদ্ধ করার চাইতে ভালো এবং খারাপের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়া বেশী ইফেক্টিভ।

#প্যারেন্টিং - ৪
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর বাচ্চাদের মনিটর করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আত্মসম্মানবোধ তৈরি করে দিন। যথেষ্ঠ।

#প্যারেন্টিং - ৫
যেধরনের মন্তব্য আপনাকে নিয়ে কেউ করলে আপনার খারাপ লাগবে, আপনার বাচ্চাকে নিয়েও সেধরনের মন্তব্য করবেন না। আদর করেও না।
অনেকে বিনয়(!) দেখাতে গিয়ে অন্যের কাছে নিজের বাচ্চার সমালোচনা করেন। এটা করবেন না।

#প্যারেন্টিং - ৬
আপনার বাচ্চার অভিভাবক শুধুমাত্র আপনারা (বাবা-মা) হবেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের এক্ষেত্রে বেশী সুযোগ দিবেন না।

#প্যারেন্টিং - ৭
আপনার বাচ্চাকে সরাসরি ইউটিউবের একসেস না দিয়ে শুধুমাত্র বাচ্চাদের কনটেন্টগুলো ডাউনলোড করে দিন। ইউটিউব, ফেসবুক থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখুন।

#প্যারেন্টিং - ৮
বাচ্চাদের সাথে নিয়ে বড়দের অনুষ্ঠান দেখবেন না। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই ঘন্টার বেশী টিভি দেখতে দিবেন না।

প্যারেন্টিং - ৯
বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দিবেন না। 

প্যারেন্টিং - ১০
বাচ্চাদের হাতে মোবাইল/ট্যাব যত কম দিবেন তত ভালো। একটানা ব্যবহার ক্ষতিকর।

প্যারেন্টিং - ১১
মানুষের মন যদি একটা সফটওয়্যার হয় তাহলে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে কোডিং। আপনি ক্রমাগত কোড করে করে নিজেকে গড়ে তুলছেন। ভালো লাগা বা খারাপ লাগাটা মূলত হার্ডওয়্যার রেসপন্স। ব্রেইন আর নার্ভাস সিস্টেম মিলে ঐ হার্ডওয়্যার। ব্রেইন যাতে মজা পায় আপনার তাই করতে ভালো লাগে। ব্রেইনের এই মজা পাওয়াটা আবার আপনার ঐ মন নামক সফটওয়্যারের কোডের উপরে নির্ভর করছে। একারণে যে ছেলেটা স্কুলে একবার প্রথম হয় সে বারবার প্রথম হয়। কারণ, পড়তে বসলেই তার ভালো লাগে। নিজেকে সে ওভাবে কোড করে নিয়েছে। যে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করে, তার ব্যপারটাও সেরকম। সে নিজেকে ওভাবে কোড করেছে।

মন নামক এই সফটওয়্যারটার বেজ (যেটাকে কম্পিউটার সায়েন্সের ভাষায় কার্নেল বলে) তৈরি হয় ছোটবেলায়। বাবা-মা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও ছোটবেলার শিক্ষা এটা তৈরি করে। এজন্য একটা বাচ্চার ছোটবেলার প্রতিটা মূহুর্ত গুরুত্বপূর্ন। বড় হয়ে সে কেমন মানুষ হবে সেটা তার ঐ ছোটবেলার উপরে পুরোপুরি নির্ভর করছে। এটা মায়ের পেটে থাকতেই শুরু হয়।

তাই, "বাচ্চা মানুষ" ভেবে খারাপ কোনকিছুতে বাচ্চাদের প্রশ্রয় দেয়া উচিত না। বাচ্চারা কিছু বোঝে না মনে করা ভুল। প্যারেন্টদের এই ভুলের কারণে অনেকে মানুষ হতে পারে না।

প্যারেন্টিং - ১২
বাচ্চারা ভুল করলে না বকে বড়দের মত করেই বোঝান, বুঝবে। বকা দিলে বা মারলে উলটো হতে পারে।

প্যারেন্টিং - ১৩
'বাচ্চা মানুষ, বুঝবে না' ভাবা ভুল। বাচ্চাদের বোঝার ক্ষমতা ভালো। ওদের ব্রেইন সব গ্রহণ করে, মন খোলা থাকে।

প্যারেন্টিং - ১৪
যেহেতু বাচ্চাদের ব্রেইন সব গ্রহণ করে ও মন খোলা থাকে, সেহেতু ওরা কি দেখছে কি শুনছে নিয়ন্ত্রন করুন।

প্যারেন্টিং - ১৫
তাতিনকে আমরা স্যরি বলা শিখিয়েছিলাম। তারপর সে ভুল কিছু করলে স্যরি বলতো। একদিন রাস্তায় একটু ভাঙা থাকায় রিকশা ঝাঁকুনি লাগলো, সে রিকশাকে স্যরি বললো। রাস্তা নাকি রিকশাকে ব্যথা দিয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে টেবিল, চেয়ার, তেলাপোকা, টিকটিকি, পিঁপড়া... সবাইকেই স্যরি বলা শুরু করলো। আজকে হঠাৎ সে কারণে অকারণেই আমাকে স্যরি বলতে শুরু করেছে।

এখন ওকে স্যরি কম বলা শেখাচ্ছি। কোথায় স্যরি বলতে হবে কোথায় হবে না, সেটা। বেশী বললে 'স্যরি' অর্থহীন হয়ে যায়।

প্যারেন্টিং - ১৬
যেকোন সংস্কৃতিতে Conception of cleanliness একটা খুব গুরুত্বপূর্ন জায়গা। আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষ সংস্কৃতি বলতে শুধুমাত্র নাচ/গান-নাটক/সিনেমা বুঝে থাকে (সংস্কৃতি বা কালচার বোঝার জন্য একটা লিংক দিলাম), ফলে এই পরিচ্ছন্নতার ব্যপারটা তারা আমলে নেন না। বাচ্চাদের শেখান না। একারণেই মানুষ রাস্তা-ঘাটে চিপসের প্যাকেট ফেলতে দ্বিধা করে না। একারণেই দেখবেন বেশীরভাগ এলাকার রাস্তাঘাট, ঘর, দোকান.. সব কত নোংরা। একারণেই এদেশের পাবলিক টয়লেটগুলোতে আপনি কখনো ঢুকতে পারবেন না।

তাতিয়ানাকে আজকে কিছু পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান দিলাম। শুরু করেছি ঘর থেকে। প্রথমেই ঘুম থেকে ওঠার পর দাঁত ব্রাশ, বেসিনের ব্যবহার ও ওয়াশরুম পরিস্কার রাখা যায় কিভাবে দেখালাম। অল্প কথায় পয়েন্ট আউট করি-

১) বেসিন ব্যবহারের সময় অবশ্যই পানি বাইরে ছিটকে আসতে পারবে না
বেসিনের পারপাসই হচ্ছে পানির সুন্দর ড্রেনেজ নিশ্চিত করা। বেসিন ব্যবহার করার সময় যদি পানি বাইরে ছিটকে পড়ে, তাহলে বেসিনের সঠিক ব্যবহার হলো না। বেসিন শান্তভাবে ব্যবহার করতে হবে। অপ্রয়োজনে ট্যাপ ছেড়ে রাখা যাবে না।

২) ওয়াশরুমের ফ্লোরে পানি ফেলা যাবে না
ওয়াশরুমে এমনিতেই জীবানু বেশী থাকে। ফ্লোরে পানি ফেলে স্যাঁতস্যাতে করে ফেললে সেখানে আরো বেশী জীবানু জন্মে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবহারের জন্যও অস্বস্তিকর। ওয়াশরুমের ফ্লোর সবসময় শুকনো রাখতে হবে। কখনো ভুলক্রমেও যদি পানি পড়ে যায়, মপ দিয়ে সেটা মুছে ফেলতে হবে। যাদের ওয়াশরুমে গোছল করার জন্য আলাদা করে জায়গা নেই তারা প্রতিবার গোছলের পর ফ্লোর মপ করতে পারেন।

৩) টয়লেট টিস্যুর ব্যবহার ও কমোড ফ্লাশ ব্যবহার করা
টয়লেট টিস্যুর সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার গুরুত্বপূর্ন। এখানে পরিমিতিটা যেহেতু ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত, তাই পরিমানটা উল্লেখ করলাম না। কমোড ব্যবহারের পরে অবশ্যই ফ্ল্যাশ করতে হবে।

৪) ওয়াশরুমে বেশী সময় অবস্থান অস্বাস্থ্যকর
জায়গাটা জীবানু পরিবেষ্টিত। তাই ওখানে যত কম সময় অবস্থান করা যায় তত ভালো। টিনেজদের ওয়াশরুমে মোবাইল নিয়ে ঢোকার ব্যপারে গাইডলাইন প্রয়োজন। মোবাইল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলে সময় খেয়াল রাখা কঠিন। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ন সমসাময়িক ব্যপার।

প্যারেন্টিং - ১৭
তাতিয়ানার বয়স এক বছর হওয়ার আগেই নানা ধরনের শ'খানেক রাইম ভিডিও ভিডিও নামিয়ে দিয়েছিলাম। রাইমগুলোর ভেতরে এবিসি, ওয়ানটুথ্রি শেখার ভিডিওগুলো ওর বেশী প্রিয়। এগুলো দেখে দেখে সে ৯ মাস বয়সেই এবিসি ওয়ান টু থ্রি শিখে ফেলেছিলো। আমার বাসার বুকসেলফগুলো এবং আমাদের পড়ার অভ্যাস ওর এই আগ্রহ তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ, সে খুব মনোযোগ দিয়ে এবিসি শিখে প্রথমেই সেলফের সব ইংরেজী বইয়ের অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করে দিয়েছিলো। মূলত ঐ বইয়ের লেখাগুলোর সাথে রাইমের এবিসির মিল দেখতে পেয়েই ওর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। 

বাংলা বইগুলো ওর কাছে দুর্বোধ্য ছিলো। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম বাংলাও সে পড়তে শুরু করেছে। তখন বয়স এক থেকে দেড় এর মত। আমি আর ফারাহ অবাক! ক্যামনে কী? পরে আবিষ্কার করলাম- ৭/৮ বছর আগে আইফোনের জন্য বাংলা বর্ণমালা শেখার যে এপটা বানিয়েছিলাম সেটা সে আমার মোবাইল ঘেঁটে বের করে ওখান থেকে অ আ ক খ শিখছে। অ আ ক খ শিখে প্রথমেই সে আমার সেলফের নাগালের ভেতরে থাকা বাংলা বইগুলো নামিয়ে বইয়ের ভেতরের বাংলা অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করেছিলো। এরপর অনেক খুঁজে ভালো কিছু বাংলা কনটেন্ট নামিয়ে দেই। দুই/আড়াই বছর বয়সে ও যখন বলতো, বাবা স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণ দাও, আমার কাছে বেশ মজা লাগতো। ব্যাঞ্জনবর্ণ শব্দটা আমার নিজেরই উচ্চরণ করতে কষ্ট হয় আর সে কি সুন্দর করে বলে।
তাতিয়ানার বয়স এখন চার। এখনো স্কুলে দেইনি। পড়তে বসার জন্যও বলি না। কিন্তু সে নিজেই খাতা-কলম-বই নিয়ে পড়তে বসে যায়। পড়ালেখা ওর কাছে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যপার।
যাহোক, যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, বাসায় ছোট একটা লাইব্রেরী বানান। বাচ্চাদের হাতের নাগালে রাখুন বইগুলো এবং বাচ্চাদের সামনে পড়ুন, ওদের পড়ে শোনান (বাচ্চাদের বইগুলো)। আপনার বাচ্চাদেরও পড়ালেখার আগ্রহ তৈরি হবে, নিজে থেকে। তবে জোর করবেন না। যেটায় জোর করা হয় সেটার ব্যপারে মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহন থাকে না।

প্যারেন্টিং - ১৮
তাতিয়ানা হঠাৎ কোত্থেকে যেন সবকিছু নিজের বলে ঘোষণা করতে শিখে গেছে। যেগুলো তার নিজের সেগুলোকে সব 'আমার' বলতে শুরু করেছে। 'আমার বই', 'আমার খেলনা' ইত্যাদি ইত্যাদি। আগে সে সবকিছু শেয়ার করতো। নিজের জিনিষ অন্যেরা ধরতে পারবে না, এরকম কোন ধারণা ওর ছিলো না। কোথাও বেড়াতে গিয়ে এই ব্যপারটা তার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। ব্যপারটা নোটিশ করলেও কিছু বলিনি। সরাসরি বললে কাজের কাজ কিছু হবে না।

মাঝে মাঝে সে আমার ফোন নেয় খেলতে। ঐদিন রাতে এসে বলছে- 'বাবা, আমার ফোন দাও'। আমি বললাম, 'এটা তোমার ফোন?' সে একটু থমকে গেল। মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো। কোন একটা জিনিষ নিজের না হলেও অন্যকে দেয়া যায় কিনা, নিজেরটা অন্যের সাথে শেয়ার করা যায় কিনা.... এসব ভাবছিলো হয়তো। আমি আবার বললাম- 'এটা কার ফোন বলো?' সে এবার হেসে বলে, "বাবার ফোন। আমার বাবার ফোন..."। ফোনের নেটওয়ার্ক অফ করে দিলাম ওর হাতে।

আমার খেলনা, আমার এটা/আমার ওটা... এগুলো বাচ্চাদের ভেতরে ঢুকে গেলে বিপদ আছে। স্বার্থপর হয়ে যাবে। বাচ্চাদের স্বার্থপর বানাবেন না। বাচ্চাদের স্বার্থপর বানানোর ফল সবার আগে আপনি নিজে ভোগ করবেন, তারপর বাকী জীবন সে নিজে ভোগ করবে। দীর্ঘমেয়াদে স্বার্থপররা কখনো জেতে না। খালি হারায়। তারা এটা বুঝতে পারে না।

প্যারেন্টিং - ১৯
বাংলায় ভালো কিডস কনটেন্ট না থাকাতে তাতিয়ানাকে সব ইংরেজী রাইম আর কার্টুন নামিয়ে দিতে হয়েছে। এতে যেটা হয়েছে, বাংলা থেকে সে ইংরেজী বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলা বললে সে খুব একটা জবাব দেয় না, ইংরেজীতে বললে জবাব দেয়। এজন্য প্রথম কিছুদিন ওর সাথে ইংরেজীতেই কথা বলেছি। কিন্তু সম্প্রতি খেয়াল করলাম খেলনাদের সাথে সে ইংরেজীতে কথা বলছে। এরকম চললে কিছুদিন পর বাংলা ভুলে যাবে। সুতরাং ওর সাথে ইংরেজী আলাপ বন্ধ করে দিয়েছি।

ইংরেজী অবশ্যই জরুরী। কিন্তু ভাষা হিসেবে ইংরেজী অনেক সহজ। যেকোন বয়সে যেকেউ কিছুদিন চেষ্টা করলেই ইংরেজীতে ভালো লিখতে ও বলতে পারে। বাংলা অত সহজ না। সুতরাং আপনার বাচ্চাদের ইংরেজী শেখাবেন অবশ্যই কিন্তু বাংলা আগে শেখান। আপনার বাচ্চা যতগুলো ভাষা জানবে তার জন্য তত ভালো। বাংলা ভালো জানাটা বরং অনেক বড় যোগ্যতা, কারণ চাইলেই যেকেউ সহজে এই ভাষা শিখতে পারবে না।

প্যারেন্টিং - ২০
তাতিয়ানা যখন আরো ছোট ছিলো, তখন খেলা শেষে নিজের খেলনাগুলো গুছিয়ে ঝুড়িতে রেখে দিতো। ইদানিং সে নিজের খেলনাগুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। কাল রাতে বললাম, চলো আমরা রুম পরিষ্কার করে ফেলি। এরপর সে নিজেই ঠিক করেছে যে খেলনাগুলো শুধু সে গোছাবে, আমাকে হাত দিতে দিবে না। দুজন মিলে সব সাজিয়ে, ঝাড়ু দিয়ে মুছে রুম ঝকঝকা করে ফেললাম। আজকে দেখলাম ব্যাগ থেকে খেলনা বের করে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখছে। রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছে না।

আপনার বাচ্চাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে শেখান। ছোটবেলা থেকেই যদি সে অপরিচ্ছন্ন আর নোংরার মাঝে বড় হতে থাকে, তাহলে বড় হয়েও পরিচ্ছন্ন থাকতে পারবে না। এটা তার বাচ্চাদের ভেতরে এবং বন্ধুদের ভেতরেও সংক্রামিত হবে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা মানুষ আরো নোংরা হতে শেখে। এটা আবার রোগের জীবানুর মত সে ছড়িয়ে বেড়ায়। অন্যদেরও অপরিচ্ছন্ন আর নোংরা করে ফেলে। এভাবে একটা গোটা জাতি অপরিচ্ছন্ন আর নোংরা হয়ে পড়ে।

প্যারেন্টিং - ২১
একজন মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য একদম ছোটবেলা থেকে নির্ভীক পরিবেশ লাগে। সে যেন ভয় পেয়ে চমকে না ওঠে। আমাদের দেশে ব্যপারটা পুরোপুরি উল্টো। এখানে শাসনের নামে বাচ্চাদের উপরে অমানবিক অত্যাচার চলে। এটা প্রথমে শুরু হয় বাবা অথবা মায়ের তরফ থেকে। তারপর আত্মীয় স্বজন হয়ে শিক্ষক পর্যন্ত। বড় হওয়ার পর চলে সামাজিক অত্যাচার। সব মিলিয়ে এদেশটা একজন মানুষের ভালো ও মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য খুব বেশী অনুপোযোগী।

ভালো মানুষ তৈরি হওয়ার জন্য এই ভূমি খুব বেশী অনুর্বর। এই অনুর্বরতা আপনি ঠেকিয়ে দিতে পারেন একজন ভালো প্যারেন্ট হয়ে। দুই চারটা ফ্যামিলিও যদি ভালো প্যারেন্ট হয়ে ওঠে তাহলে তাদের বংশধরেরা আরো বেশ কিছু ফ্যামিলি ও অনেক ভালোমানুষ রেখে যেতে পারবে। এভাবেই হয়তো একদিন পরিবর্তন হবে।

এখন কথা হচ্ছে, আপনি কিভাবে ভালো প্যারেন্ট হবেন? আমার লেখা পড়ে? নাহ, তার দরকার নাই। আপনি নিজে বইপত্র কিনে পড়ুন। অনলাইনে সার্চ করে জানুন। হিউম্যান সাইকোলজি বোঝার চেষ্টা করুন। ভালো প্যারেন্ট হওয়ার পথে একটু হলেও এগিয়ে যাবেন।

প্যারেন্টিং - ২২
ক্রিয়েটিভ ও প্রোডাক্টিভ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে একটা পজেটিভ, আনন্দপূর্ন, নির্ভয় পরিবেশে রাখতে হয়। পরিবেশটা একই সাথে কোলাহল ও বিদ্বেষ মুক্ত হতে হবে। আপনার বাচ্চার জন্য এরকম পরিবেশ নিশ্চিত করুন।

প্যারেন্টিং - ২৩
সরাসরি উপদেশের চাইতে ইনডাইরেক্ট উপদেশ বেশী কার্যকরী।
তাতিয়ানা এসে বললো, এলসা তার কথা শুনছে না। সুতরাং এলসাকে এক গাদা উপদেশ দিয়ে দিলাম। তাতিন মনোযোগ দিয়ে শুনলো কী কী বলেছি। তাতিনকে কখনো আমি সরাসরি উপদেশ দেই না। উপদেশ জিনিষটাই আসলে কেমন যেন। তার ভেতরে আমাদের দেশে বড়রা উপদেশকে একটা বিরক্তিকর জিনিষ বানিয়ে ফেলেছে। উপদেশ দেয়ার চাইতে আলোচনার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে বলা বেশী ভালো। আর  উপদেশ যদি দিতেই হয়; সরাসরি না দিয়ে ইনডাইরেক্টলি দেয়া ভালো। 
পুনশ্চঃ এই পর্বে বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার বিষয়ে লেখার কথা ছিলো। ঐ পর্বটা একটু সময় নিয়ে লিখতে হবে। আপাতত সময় কম। আগামী পর্বে চেষ্টা করবো।

প্যারেন্টিং - ২৪
'সবকিছু জানা থাকতে হবে', এরকম ধারণা আমাদেরকে মূর্খে পরিনত করে। তাই আপনার বাচ্চার সকল প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞের মত দেয়ার চেষ্টা করবেন না। মাঝে মাঝে তাকে বলুন, 'আমি জানি না, চলো আমরা ব্যপারটা জানার চেষ্টা করি'। তাকে বুঝতে দিন— সবকিছু আগে থেকেই জানা থাকা জরুরী না। এতে তার শেখার পথ তৈরি হবে।

প্যারেন্টিং - ২৫
আপনার বাচ্চার সামনে যখন অন্য কারো সাথে অভদ্রতা করবেন, তখন আপনি আসলে বাচ্চাকে অভদ্র হওয়া শেখাচ্ছেন। আপনার অভদ্র বাচ্চার অভদ্রতার সবচাইতে বড় শিকার হবেন আপনি নিজে।

প্যারেন্টিং - ২৬
ইনডাইরেক্ট গাইড করা হচ্ছে বেস্ট গাইডিং সিস্টেম। 'এটা কর, ওটা কর, এটা করলি কেন, ওটা করা যাবে না' এসব যত কম বলতে পারবেন তত ভালো। আপনার বাচ্চাকে যতটা সম্ভব ন্যাচারালি বড় হতে দিন। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন সে কী করছে এবং তার কী করা উচিত।

'তার কী করা উচিত', এটা জানা ও বুঝতে পারা প্যারেন্ট হিসেবে আপনার প্রথম কাজ। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে এই জ্ঞানের উপরে ভিত্তি করে বাচ্চাকে গাইড করা। তৃতীয় ব্যপার হচ্ছে, সবচাইতে ইফেক্টিভ পদ্ধতিতে গাইড করা। এখন তৃতীয় ব্যপারটার পারফেক্ট কোন পদ্ধতি নাই। মানে, আমার বাচ্চাকে যেভাবে গাইড করলে সবচাইতে ইফেক্টিভ হবে আপনার বাচ্চার ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। কারণ, এর সাথে আপনার বাচ্চার মেধা, আপনার বাসার পরিবেশ, আপনার সমাজ, দেশ, বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যপার জড়িত। জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা ব্যপার আছে যেটা প্যারেন্টিং এর সাথে গভীর ভাবে জড়িত। সুতরাং বই আর আর্টিকেল পড়ে আপনি ভালো প্যারেন্টিং শিখে যেতে পারবেন, এরকম না। বিশেষ করে, পুরানো বই থেকে। কারণ, সময় যত যাচ্ছে পারিপাশ্বিক বিষয়গুলো ততই পরিবর্তন হচ্ছে আর ইফেক্টিভ প্যারেন্টিং এর ব্যপার স্যপারগুলো বদলে যাচ্ছে। তবে, কিছু বেসিক থিওরী আছে আর কিছু ব্যপার সবসময় অপরিবর্তিত থাকে, সেসব আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে।

প্যারেন্টিং - ২৭
"না" বলতে শেখা খুব জরুরী। 'না' বলা শিখতে আমার অনেক সময় লেগেছিলো। 'না' বলার ক্ষেত্রে আমি মূলত বিবেচনা করি সময়। সময় সবচাইতে দামী কারেন্সী। কত কাজ করার আছে, অথচ আমাদের জীবন কত ছোট! গত আট বছরে অনেক ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, তারপরেও বহু ক্লায়েন্টরে 'না' বলে দিয়েছি শুধুমাত্র সময় নষ্ট হবে বলে। তারপরেও কত সময় নষ্ট করেছি জীবনে। অধিকাংশ সময় নষ্ট হয়েছে এই 'না' বলতে পারার কারণে।
আপনার বাচ্চাকে 'না' বলতে শেখান।

প্যারেন্টিং - ২৮
যখন আপনি নিজের জন্য কিছু বানাবেন তখন  বাকীদেরও জিজ্ঞেস করবেন তারা খেতে চায় কিনা। সেটা এক কাপ চা হলেও। আপনার বাচ্চাকে এটা শেখাবেন। এবং আপনার সকল বাচ্চাকে রান্না করা শেখাবেন। শুধু মেয়েদের না, ছেলেদেরও।

প্যারেন্টিং - ২৯
আপনার বাচ্চাকে বলবেন, কোনকিছু না জানা থাকা দোষের কিছু না। দোষ আছে শিখতে না চাওয়াতে। অজ্ঞতা ও মূর্খতার ভেতরে পার্থক্য শেখাবেন। কোনকিছু না জানাকে 'অজ্ঞতা' বলে। অজ্ঞতা সহজে দূর করা যায়। জ্ঞানের অভাবে মানুষ মূর্খ হয়। জ্ঞান অর্জন করার অক্ষমতা মূর্খদের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট। একারণে মূর্খতা সহজে দূর হয় না।

জ্ঞান অর্জন করার এই অক্ষমতার পেছনে হাজারটা কারণ আছে। তার ভেতরে অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে- তথ্য ও জ্ঞানের ভেতরে পার্থক্য করতে না পারা।

আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) মনে করা হয় যে যত বেশি তথ্য জানে সে তত বড় জ্ঞানী। কিন্তু, তথ্য আর জ্ঞানের ভেতরে পার্থক্য আছে। ব্যাপারটা একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। উইকিপিডিয়াতে অনেক তথ্য আছে। একটা কম্পিউটারে যদি উইকিপিডিয়ার সমস্ত তথ্য রেখে দেন সে কি জ্ঞানী হয়ে যাবে? নাহ! সে দুনিয়ার সকল তথ্য জানবে কিন্তু সে জ্ঞানী না। তথ্যরে যেভাবে প্রসেস করার পর জ্ঞান হয়, সেই প্রসেস করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন কম্পিউটারের এখনো হয়নি। ফলে পৃথিবীর সবচাইতে বেশী তথ্য মেমরীতে নিয়ে বসে থেকেও একটা কম্পিউটার একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার চাইতে কম জ্ঞানী। এজন্য কম্পিউটার/রোবটকে গবেট বলা হয়। আপনার বাচ্চাকে গবেট বানাবেন না।

পরবর্তী লেখাগুলো পেতে এখানে ক্লিক করুন

পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকুন... আপডেট পেতে লাইক দিন GleeEra-র ফেসবুক পেজে

প্রাসঙ্গিক লেখা