মোগলনামা - ৫

বরফাবৃত গিরিপথে তাবু খাটিয়ে বিশ্রাম করছেন হুমায়ূন। পাশে হামিদা ও আকবর। হাড় কাঁপানো শীতের হাত থেকে আকবরকে বাঁচাতে ধাতব পাত্রে কয়লা জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে; ভাক্কার দুর্গ থেকে নিয়ে আসা কয়লা ফুরিয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত। হুমায়ূনের শিবিরে কয়লা এখন সোনার চেয়েও দামী। হঠাৎ পিঠে ইস্পাতের ফলার খোঁচা অনুভূত হতেই ঘুম ছুটে গেল হুমায়ূনের। চেয়ে দেখলেন দুটো সবুজ চোখ, যার মালিকের সে সময়ে গিরিপথ থেকে বহুদূরে, কান্দাহারে থাকার কথা। কামরান, তার সৎ ভাই। হুমায়ূনের সঙ্গী বলতে তখন গুটিকয়েক মানুষ, বিশ্বস্ত আর বন্ধুভাবাপন্ন। একজন সম্রাটের কাফেলার চেয়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো দস্যুদলের মত অবস্থা তার। এবং সেই দলটি যখন পথশ্রমে ক্লান্ত, ঘুমন্ত, ঠিক তখন কামরান আঘাত হানলো। সে চাইলেই হুমায়ূনকে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু চতুর কামরানের লক্ষ্য হুমায়ূন নয়, তার পুত্র আকবর। আকবরকে সঙ্গে করে কামরান চলে যায়। তবে আকবরের সাথে যায় আরও দুজন মানুষ। আকবরের দুধ-মা মাহাম আগা ও তার দুধ ভাই আদম খান।১ পুত্রহারা পিতা বুকে পাথর চেপে পথ চলতে লাগলেন। ...



মোগলনামা - ৪

চৌসার যুদ্ধের প্রায় চার মাস পরের কথা। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকের এক ছেলে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে। ছেলেটি শেষ পর্যন্ত শুধু সম্রাটের সাক্ষাৎ-ই পায় না, বরং পায় এক অভাবনীয় পুরস্কার। এই বালকটি নিজাম। ভিস্তিওয়ালা। চৌসার যুদ্ধে হুমায়ূনের জীবন বাঁচানোর পর হুমায়ুন তাকে একদিনের সম্রাট করার ওয়াদা করেছিলেন। অবাক করার মত বিষয় হল, হুমায়ূন তার প্রতিশ্রুতি ভুলে যাননি। তিনি নিজামকে সিংহাসনে বসতে দেন (#১)। এমনকি এ-ও বলেন যে এ সময়ে নিজামের জারি করা যে কোন ফরমান, রাজকীয় ফরমান বলে গন্য হবে এবং তা পালিত হবে। সম্রাটের এমন খেয়ালী আচরণে অনেক অমাত্যই ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু প্রতিশ্রুতি পালনে হুমায়ূন বদ্ধ পরিকর। হুমায়ূন সুরাসক্ত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ছিল জ্যোতিষ শাস্ত্রে অতিরিক্ত ভক্তি। সব মিলিয়ে তিনি খামখেয়ালী সম্রাট বলেই পরিচিত হয়েছিলেন। অসন্তোষ ছিল অনেকের মাঝে। কিন্তু চৌসার যুদ্ধের পরপর সে অসন্তোষের বাষ্প কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। তার সভাসদ, আত্মীয় সকলেই তার পরিবর্তন অনুভব করেছিলেন। কিন্তু...



মোগলনামা - ৩

হিন্দুস্তান। অর্থাৎ হিন্দুর দেশ। কিন্তু শাসন ক্ষমতায় হিন্দু ছিল কতদিন? এক সময়ে এ ভূখণ্ডে ছিল বৌদ্ধ ধর্মের জয়জয়কার। আর, বাবর যার কাছ থেকে হিন্দুস্তান ছিনিয়ে নেন, সেই ইবরাহীম লোদিও ছিলেন মুসলমান। তবু মোগল কিংবা সুলতানি আমলের ইতিহাস পড়তে গেলে এই ভূখণ্ডের নাম হিন্দুস্তান হিসেবেই চোখে পড়ে। তবে, আমি 'ভারতবর্ষ' লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ভ্যাঁপসা গরমের এই ভূমি অধিকার করে বাবর দেখলেন এখানকার লোকেরা নিরাকার প্রভুর উপাসনা করে না। বরং তাদের উপাসনালয়ে প্রচুর অদ্ভুত মূর্তি দেখা যায়। এদের কারও দশ হাত, কেউ নগ্নিকা। এক পুরুষের হাতে ত্রিশুল, গলায় সাপ। কালো পাথরের এক মূর্তিকে তারা লিঙ্গ বলে এবং লিঙ্গের পূজা করে। হিন্দুদের প্রধান উপাসককে পুরোহিত বলা হয়। এরা হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পড়ে আর ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধু একটা সুতো কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত আড়াআড়ি জড়ানো। গরুকে তারা ‘মা’ হিসেবে ভক্তি করে। এসব দেখতে দেখতে বাবর অবাক হয়ে যান। ভারতের হিন্দুদের উপাসনালয়ের নাম মন্দির। অবাক মোগলরা লক্ষ্য করে, মন্দির...



বাঙালি জাতি গায়ের রঙ কেনো নির্দিষ্ট নয়?

কখনো খেয়াল করে দেখেছেন, বাঙালি জাতির কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো কমপ্লেক্সন বা গায়ের রঙ নেই। আমরা না কৃষ্ণাঙ্গ, না শ্বেতাঙ্গ! আবার অস্ট্রেলিয়ান বা মঙ্গোলিয়ানদের মতোও না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরকম নজির পৃথিবীর আর কোনো জাতির নেই। তাই বাঙ্গালিদেরকে বলা হয় শঙ্কর বা মিশ্র জাতি। আর্য আর অনার্য- মূলত এই দুই জাতির মিশ্রণে আমাদের উৎপত্তি। আর্য অনার্য কারা সেটা বলার আগে বলে নেই, বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর যখন পৃথিবী বিভিন্ন মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়, তখন চারটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়ঃ নেগ্রেডো, ককেশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান আর অস্ট্রিক। নেগ্রেডো মানে যারা আফ্রিকান অঞ্চলে বাস করতো। ককেশিয়ানরা মূলত ছিলো ইউরোপিয়ান। মঙ্গোলিয়ানদের বাস ছিলো চীন-জাপান এই অঞ্চলে আর অস্ট্রিকরা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে।



পদ্মাবতঃ সিনেমা এবং ইতিহাস

১. ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দ। চৌসার যুদ্ধে দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ূনকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন দখল করলেন শের শাহ্‌ শুরি। এই বছরই এক 'সূফী' কবি, নাস্তালিক লিপিতে, অবধী ভাষায় 'পদ্মাবত' নামে এক মহাকাব্য লেখেন। কবির নাম মালিক মোহাম্মদ জায়েসী। রাজপুত শৌর্য এবং রাজপুত জাত্যাভিমান ফুটিয়ে তোলা এই মহাকাব্য অনূদিত হয় অনেক ভাষায়। আরাকান রাজসভার কবি আলাওল, পদ্মাবতের অনুবাদ করেন 'পদ্মাবতী' নামে। কাহিনী সংক্ষেপ যদি বলতে হয়, তা অনেকটা এরকম। সিংহল রাজের অনিন্দ্য সুন্দরী কন্যা, পদ্মাবতী। তার পোষা হীরামন পাখিটি একদিন উড়ে গিয়ে পৌঁছে চিতোরের রানা রতন সিং এর কাছে। পদ্মাবতীর রূপ-গুণের কথা শুনে রতন সিং শত বাঁধা পেরিয়ে, সিংহল গিয়ে তাঁকে জয় করে নেন। পত্নীরূপে পদ্মাবতীকে নিয়ে আসেন চিতোরে। কিন্তু সুন্দরীর রূপের বাখান তো এক জায়গায় থেকে যায় না, ছড়িয়ে পড়ে। পদ্মাবতীর কথাও ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। দিল্লীর সুলতান সে সময়ে আলাউদ্দিন খিলজি। পদ্মাবতীর সৌন্দর্যের কথা শুনে তিনি পদ্মাবতীকে অধিকার করত...



মোগলনামা - ২

একটা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ এবং তা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন যোগ্য উত্তরাধিকারী। তাই প্রায় সব সাম্রাজ্যের মত মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরও একটি যোগ্য পুত্র কামনা করতেন। বাবরের প্রথম সন্তান হুমায়ূন। পানিপাতে তরুণ হুমায়ূন ছিলেন কুশলী সেনাপতি। পিতার পাশে থেকে তিনি দিল্লী বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শুধু যোদ্ধা হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন চমৎকার। গোয়ালিয়রের এক রাজ পরিবারের সম্মান রক্ষার স্বরূপ হিসেবে সেই রাজ পরিবার তাঁকে একটি হীরা উপহার দেয়। যার নাম কোহ-ই-নূর, বা আলোর পর্বত। এই হীরাটিই ইতিহাসের সেই বিখ্যাত 'কোহিনূর'। পিতা-ভক্ত হুমায়ূন হীরাটি তাঁর পিতা বাবরকে উপহার দেন। দিল্লী জয় করেই আসলে হিন্দুস্তান অধিকার হয়ে যায়নি। সত্যি বলতে হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষকে মোগল শাসনে আনতে পেরিয়ে গেছে তিন পুরুষ। বাবরের দ্বিতীয় অধস্তন, আকবরের সময়েই প্রকৃতপক্ষে সমগ্র ভারতবর্ষে মোগল শাসন কায়েম হয়। বাবর ছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ। ভারতের এই গরম, ভ্যাঁপসা আবহাওয়া, তাঁর ভালো লাগেনি। ভারতকে আপন করে...



মোগলনামা (প্রথম পর্ব)

'পানিপথের প্রথম যুদ্ধে' ইবরাহিম লোদীকে পরাজিত করার মাধ্যমে ভারতবর্ষে মোগল শাসন শুরু হয়, তা আমরা সবাই জানি। যেটা জানি না সেটা হল, জায়গাটার না ‘পানিপথ’ না, বরং ‘পানিপাত’। মোগলদের কথা শোনার আগে চলুন, মহাভারত ঘুরে আসি। পাণ্ডবরা কুরুদের কাছে তাদের উত্তরাধিকারের অংশ দাবি করেছিল। যার মধ্যে ছিল পাঁচটি গ্রাম। তাদের নামঃ- ১. পাণ্ডবপ্রস্থ, পরবর্তীতে পানিপাত,  ২. সোনাপ্রস্থ, পরবর্তীতে সোনিপাত,  ৩. ইন্দ্রপ্রস্থ বা ইন্দ্রপাত, পরবর্তীতে দিল্লী,  ৪. ব্যঘ্রপ্রস্থ, পরবর্তীতে বাগপাত ও  ৫. তিলপ্রস্থ, পরবর্তীতে তিলপাত নামে পরিচিত হয়। কুরুরা দাবি মানতে অস্বীকার করলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়। কুরুক্ষেত্র থেকে তিলপাতের দূরত্ব সত্তর মাইল। আর দিল্লী থেকে নব্বই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পানিপাতে (বর্তমানে হরিয়ানা রাজ্যের অন্তর্গত) বাবরের সাথে ইবরাহীম লোদীর যুদ্ধ হয়। ভারতবর্ষে মোগল শাসনের কথা বললেই শক্তি, ক্ষমতা এবং জৌলুশের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু মোগলদের ...



স্মল পক্সের যুদ্ধে মানব জাতির বিজয়ের ইতিহাস

জীবনে বসন্ত এসেছে...  দরাজ গলায় চাইলেই এখন যে কেউ গেয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বসন্ত বা Pox আরো নির্দিষ্ট করে বললে গুটি বসন্ত বা Small pox ছিলো একসময় সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। এই রোগে আক্রান্ত ৩০% লোক মারা যেতো একসময়। যারা বেঁচে যেতো তারা যে সত্যিকার অর্থে বেঁচে যেতো, তা কিন্তু না- আজীবন শরীরে বয়ে বেড়াতে হতো বসন্তের চিহ্ন- অনেকেই হয়ে যেতো অন্ধ। এই ভয়ানক রোগের আক্রমণে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে মানুষ একসময় যুদ্ধ ঘোষণা করে এর বিরুদ্ধে। আর শেষমেশ জয়ীও হয়। যে কারণে আজ এই ভয়াল রোগটা বিলুপ্ত। কিভাবে জয়ী হলো মানুষ? সেটাই জানবো আজ আমরা। তবে তার আগে Pox সম্পর্কে একটু জানা যাক।  Variola এবং Varicella নামক দুটি ভাইরাসের আক্রমণে বসন্ত রোগ হয়। এর মধ্যে Variola-র আক্রমণে হয় গুটি বসন্ত। আর Varicella-র আক্রমণে হয় জলবসন্ত। Variola-র আবার আছে দুটো সাবটাইপঃ Variola major আর Variola minor. ভয়ংকর ছোঁয়াচে এই ভাইরাস আক্রমণ করে মানুষের ত্বকে। প্রথমে জ্বর দিয়ে শুরু হয়, তারপর গারা গায়ে গোটা ওঠে। রোগ সেরে গেলেও গোটার জায়গা গুলোতে থে...



মানুষের চামড়ায় বইয়ের মলাট

অ্যালান কোয়াটারমেইনের অমর স্রষ্টা নন্দিত লেখক হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কালজয়ী এক গ্রন্থের নাম মিস্টার মিসনস উইল। লেখিকার পিঠের ত্বকে ট্যাটু করে জনৈক প্রকাশকের উইল লিখে যাওয়ার যে বিশেষ ঘটনা সেটা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। তবে যাই হোক তখনকার সমাজে হয়ত এ ধরণের হিংস্র ঘটনার প্রচলন ছিল বলেই লেখক হ্যাগার্ডের কলমে, কল্পকথায়-গল্পগাথায় ঠাঁই নিয়েছে তা। অন্যদিকে বিপ্লবী নিগ্রো নেতার শরীর থেকে খাল ছাড়িয়ে নেয়া; তারপর তার চামড়াতে নিষেধাজ্ঞা পত্র লেখার মত ঘটনাও ঘটেছে ১৮-১৯ শতকের বিশ্বে। যাতে করে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা বিপ্লবের সাহস না দেখায় ঐ বিশেষ অঞ্চল কিংবা জনগোষ্ঠীর মানুষ। এমনি কিছু ঘটনা ঘটেছিল এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার অনেক ফরাসি উপনিবেশে। তাদের দেখাদেখি পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরাও এ ধরণের গর্হিত কাজ করে বসে। পাশাপাশি সম্মান ও কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে কেউ কেউ  নিজ চামড়া উৎসর্গ করে অর্ঘ্য কিংবা স্তুতি নিবেদনের কাজ করেছে। মধ্যযুগের বর্বর ইউরোপে ক্যাথলিক ধর্মদ্রোহের অনেকগুলো শাস্তির এ...